বিরো দাদা, দূর পাহাড় ও একটি সাইকেল
Barbil and Story of a Blind Girl: সে দিন ওই পড়ন্ত আলোয়, বিরো দাদা বিরোশমণিকে বলেছিল এক অন্ধ মেয়ের কথা, পড়শি বিরো দাদার। যাকে একদিন অমনই এক সন্ধ্যা-পূর্ব আলোয় বিরো দাদা পেয়েছিল জঙ্গল-ধারে।
বিরো দাদা, ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিল। কিন্তু মাঝেমাঝেই ল্যাব থেকে বেরিয়ে, বারান্দা থেকে ওই দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত। একটা ঘোরে যেন। কাজ ফাঁকির বান্দা ছিল না বিরো দাদা। কিছুক্ষণ দূরে তাকিয়ে থেকে আবার ঢুকে যেত— কাজে, পেল্লাই সব সালফিউরিক, নাইট্রিক অ্যাসিড রাখা কাচের বোতলের মাঝে। ওই কেমন যেন একটা ডিম পচা ঝাঁঝের মধ্যে। আমিও ফাঁকতালে হেঁটে-চলে বেড়াতাম ওই সবের মধ্যে দিয়ে। স্মুদ অথচ রাক্ষুসে ওই কাচের জারগুলোর মধ্য দিয়ে আমি ওপারে, কীসব দেখার চেষ্টা করতাম। নিশ্চিত ভাবেই অত জ্ঞানগম্যি ছিল না সেকালে, নয়তো বলতাম নির্ঘাৎ, অল্টারনেট রিয়্যালিটি খুঁজতাম আমি কাচের ওপারে!
কিন্তু আমি কি কিছু খুঁজতাম আসলেই? আরও বড় কথা হল, আমি কিছু একটা খুঁজলেও, এখন সেটা জরুরি নয়। বিরো দাদা কী খুঁজত? নাকি খোঁজার বিন্দু মাত্র প্রত্যাশা বুকে আর রাখেইনি বিরো দাদা? যদি তেমনটাই সত্য হয়ে থাকে, তবে কী কারণে বা কোন বিশেষ কাণ্ডের পর বিরো দাদার অমন মনোদশা, তা জানি না। সে সব ভিন্ন তর্ক যে আদৌ মানুষ মনখারাপ করলে পরেই দূর পাহাড়ের দিকে তাকায় কি না! আসলে এখানেই ফেল করে যাই আমরা আজকাল। একটা মৃদু তরঙ্গকে অনবদ্যতা না-দিতে পারলে কেমন যেন প্রাণ আনচান করে। মনে হয় বোধহয়, হায় হায়, একটা সাব-জুনিয়র মহাকাব্য হাত থেকে ফস্কে গেল। আরও খারাপ কি জানেন তো, বিরো দাদার ওই দূরে তাকিয়ে থাকাকে আমি এই ধারাবাহিক লিখতে গিয়ে, একটা আলাদা দ্যুতি দিচ্ছি। এবং আমি বুঝতেও পারছি, এটা না করলেও হত, তবুও আমি করে ফেলছি, কেন? অভ্যাসবশত? অন্যের আলোকবৃত্তে স্নাত হওয়ার অদম্য বাসনায়? যা ইচ্ছে হতে পারে, নো আইডিয়া। অবশ্য অকারণেই ফ্যালফ্যাল করে বা স্রেফ বিহ্বল হয়ে দীর্ঘক্ষণ কোনওখানে তাকিয়ে থাকার প্রশ্রয়টাই তো একালে এমন বিরল যে আমিও বোধ করি, বিরো দাদার তাকিয়ে থাকা লুপ-এ চালিয়ে যাই।
আরও পড়ুন: বিশ্বাসে মিলায়ে শোক, অঙ্কে বিয়োগফল
তাই বিরো দাদা ওই দূরে তাকিয়ে থাকত। বিরো দাদা একটা সাইকেল চালিয়ে কাজে আসত। ওই পাহাড়ের দিকেই কোথাও একটা কুঁড়ে ঘর ছিল বিরো দাদার। তা হলে কি অফিসে এসে এমন মন কেমন করত বিরো দাদার, যে আসলে ঘরের দিকে তাকিয়ে থাকত? জানি না। তবে একদিন বিরো দাদা অনেকক্ষণ পর কাজে এল। যে কোনওদিন লেট করে না, সে দেরি করলে চোখে পড়ে। তাই পাণ্ডা কাকু জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার। বিরো দাদা খুব একটা কথা বলত না। ওই একবার শুধু দেখেছিলাম, লাল চোখ নিয়ে ফুঁসছিল। বিরো দাদার সর্বক্ষণের সঙ্গী, ওর বাঁশিতে কেউ এক জন হয়তো বা খেয়াল না করেই চা ফেলে দিয়েছিল। বিরো দাদা হকচকিয়ে কিছুক্ষণ তা দেখেছিল, তারপর ওই লাল চোখ নিয়ে ফুঁসেছিল। বিকেল যখন পা ছড়িয়ে সন্ধ্যা লগ্নের সহিত সই পাতায়, তখন আহত দু'চোখ নিয়ে বিরো দাদা বাড়ি চলে গিয়েছিল। জঠরে বাঁশির মর্মাহত বাস্তব গুছিয়ে নিয়ে।
এমন নয় যে সে কারণেই পরের দিন দেরিতে এসেছিল। ইনফ্যাক্ট পরের দিন একগাল হাসি নিয়ে, বিরো দাদা একেবারে সময় মতোই চলে এসেছিল। যে না আসাটার কথা তুললাম, তা ঘটে, আরও কিছু দিন পরে। পাণ্ডা কাকুর প্রশ্নের উত্তরে, অল্প মাথা নেড়ে খুব একটা কিছু বলেনি বিরো দাদা। ঠিক আছে, এক দিন তো হতেই পারে, সমস্যা কী। কিন্তু বিরো দাদার দেরি করে আসা বাড়তে লাগল। পাণ্ডা কাকু ডেপ্যুটি ম্যানেজার ঘোষকাকুকে বলল, ঘোষকাকু বাবাকে। বিরো দাদা কাউকেই কিছু বলে না। শুধু বাবা কোমল গলায় 'কী হয়েছে বিরো' শুধোলে, লাজুক এবং বেশ খানিক বিব্রত হয়ে ফিরে যেত সালফিউরিক, হাইড্রোক্লারিকের সংসারে। তারপর দুপুর নাগাদ স্কুল থেকে ফিরে, খেয়েদেয়ে আমার সাধের স্পোর্টস্টার ম্যাগাজিনের ফোল্ড করা পোস্টার খুলে দেখার মাঝে খেয়াল করতাম ওই বারান্দায় এসে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বিরো দাদা। বিরো দাদার বন্ধু, সহকর্মী, নবীন দাদাকেও ও কিছু বলেনি। কেন যে এখন হেঁটে আসে, তা-ও না, সাইকেলটিও কোথায় গেল, তা-ও নয়।
তার পর একদিন বেলা নাগাদ, বারান্দার ঠিক পিছনে, যেখানে একটা ছোট বাগান মতো ছিল আমাদের, সাইডে ইয়া বড় নিম গাছ, সেখানে বিরো দাদা আর নবীন দাদা নিরাপদ দূরত্ব থেকে আমায় প্রথম (ও একবারই) দেখিয়েছিল লাইভ, একটি সাপ ও নেউলের মরণপণ পদক্ষেপ। বারান্দায় যখন অফিসের যাবতীয় ভিড় জমতে শুরু করল, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরো দাদা ও নবীন দাদার নেতৃত্বে, ওই দুই মুখে রক্ত-মাখামাখি প্রাণীর মধ্যে প্রায় জোর করে এক রকম যুদ্ধবিরতি ঘোষিত হল। অবশ্য আমার ধারণা যে পারস্পরিক অসূয়া ওই দুই প্রাণীর মধ্যে দেখেছিলাম, তাদের কোনও যুদ্ধবিরতি হারগিজ সম্ভব নয়। ওরা, আজও আমাদের বাড়ির ওই চোহদ্দির বাইরে নির্ঘাৎ চালিয়ে যাচ্ছে অশেষ রক্তের দেওয়া-নেওয়া। এত কথা বলা এ কারণে, কারণ সে দিন ওই পড়ন্ত আলোয়, বিরো দাদা বিরোশমণিকে (যিনি আমাদের বাড়ি কাজ করতেন) বলেছিল এক অন্ধ মেয়ের কথা। পড়শি বিরো দাদার। যাকে একদিন অমনই এক সন্ধ্যা-পূর্ব আলোয় বিরো দাদা পেয়েছিল জঙ্গল-ধারে। রাস্তা তীরবর্তী বৃক্ষ যত, তাতে আঙুলের কড় ছুঁয়ে ছুঁয়ে সে অন্ধ মেয়ে এগিয়ে চলেছিল কোন অবসাদ-পার— কেই বা হদিশ রেখেছিল। বিরো দাদা বিরোশমণিকে তারপর ঠিক আর কী কী বলেছিল, তা বিরোশমণি মা’কে রান্নার মাঝে আর তেমন করে বলেনি। কিন্তু বিরোশমণির মনে হয়েছিল, বিরো দাদা নিজের সাইকেলটা ওই অন্ধজনে বিলিয়ে এসেছিল।
আসলে কী হয়েছিল, বলাই বাহুল্য, জানি না। কিন্তু আমার কেমন যেন বদ্ধমূল ধারণা, বিরোশমণি ঠিক ভেবেছিল। বিরো দাদা নিশ্চিত এই কাণ্ডই করেছিল। আর তারপর বারান্দা থেকে ওই পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করত, মেয়েটা কদ্দুর পেরোল পথ। ওই দেখুন, আবার আমি একটা মহাকাব্যের গন্ধ খুঁজছি, বড় ন্যাচারাল-মাঝে। ইনফ্যাক্ট, বিরো দাদা পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করত, কদ্দুর পেরোল পথ — এই পঙক্তিটি লিখেও কেমন এখন মেলোড্রামাটিক লাগছে। লাগছে, কারণ সে আবহাওয়া আমরা (আমি তো বটেই) ক্রমশ ভুলতে বসেছি, যেখানে সত্যিই এক জন অন্ধ আদিবাসী মেয়ে কী ভাবনায় কে জানে, কোন ভরসায় না জানি, বেরিয়ে পড়ে সম্ভবত অতিক্রম করবে বলে তথাকথিত অলঙ্ঘ এক যন্ত্রণাবলয়। আর তাকে আপন বাহনখানি নির্দ্বিধায় ধরিয়ে দিতে পারে ক্ষুদ্র সম্বল-সহায় অন্য কোনও জন। এখন ভাবলে মনে হয়, আচ্ছা বিরো দাদা এক বারও ভাবল না, ওই সাইকেল নিয়েও বা মেয়েটি যাবে কোথায়? অন্ধ তো আফটার অল। বা ধরা যাক, এই যে লেখার সময় হঠাৎ বোধ হল, মেয়েটি অন্ধ বলেই কেন তাকে দুখী হতেই হবে? আদিবাসী, তাই সে খেয়ালবশে পিছুটান অগ্রাহ্য করে পদক্ষেপ করতে পারে না? ওই কন্ডিশানিং আমাদের, অ্যাট ওয়ার্ক। কিছু করার নেই।
আরও পড়ুন: স্টিল খোপ-থালা ও গোল্ড স্পট
মেয়েটিকে যে কোথাও একটা যেতেই হবে, নিষ্কৃতির লক্ষ্যে, বা বিরো দাদার সাইকেল দিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে কোন রিজনিং কাজ করেছিল! আদৌ করেছিল কি না, এ হেন ভাবনাপ্রবাহ ঠিক কখন থেকে অন্তরমহল গ্রাস করে ফেলল, টেরই পাই না। এগুলো ইদানীং বড় ফরেন লাগে। অন্য জগৎ লাগে। যা নিয়ে ঘটা করে একটা ধারাবাহিক লেখা যায়। এরা আজ আর সহজাত নয়। আর তখনই মনে হয়, না, যদি ফের কোনওভাবে ওই বিরো দাদা, ওই অন্ধ মেয়েটির সঙ্গে কানেক্ট করা যেত, ওই ইংরেজিতে যাকে বলে রিটার্নিং ব্যাক টু দ্য রুট্স…
কিন্তু অনির্বাণ, তোর কি আদৌ কোনও সময় মনে হয়েছে, ওরা তোকে ফেরত চায়? তেলে-জলে খাপ খাওয়াবি কোন মায়াবলে? তুই ধারাবাহিক লেখ, তুই কেঁদেকেটে বাড়ি-ফেরতা জল লুকো। ফেলে আসা আস্তরণে পলি জমতে দে।
ইউ হ্যাভ মুভ্ড অন