সাম্যের চৈতন্য, প্রেমের ম্যানিফেস্টো
Shri Chaitanya Mahaprabhu : চৈতন্যদেবই স্পষ্ট উচ্চারণে ঘোষণা করেন, শালগ্রামশিলা পুজোর অধিকার শুধু ব্রাহ্মণের নয়, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং সকল শ্রেণির নারীদেরও আছে।
বৃথা রক্তপাত দেখে প্রশ্ন কিছু জেগেছে সম্প্রতি / মানবিক ধৰ্ম থেকে দূরে এসে ধৰ্মসভা কতদূর মেকি / নিরন্ন দিনের ক্ষুধা মিটে যাবে মঙ্গল আরতি আর / ভোরের আজানে? মোল্লা - পুরোহিত বল, আজ কোথা যাবে ওই পতিপুত্রহীনা? /
কে জানে কেমন রূপে দেখা দেবে পরবর্তী তোমার সকাল -
আশ্চর্য এমন কিছু হতে পারে - ওই নারী ভিক্ষা দেবে একমুষ্টি চাল।
(শম্ভুনাথ চট্টোপাধ্যায়)
এখন সময় খুব সংশয়ী। প্রতি পক্ষই এখন সাবধানী। মানুষের থেকে মানুষের দূরত্ব বাড়ছে। অথবা সকলেই আড়চোখে বুঝে নিচ্ছে সকলের গতি প্রকৃতি। গতি যদিও বোঝা সম্ভব হচ্ছে, প্রকৃতি বোঝা অসম্ভব হয়ে উঠছে। যাকে মনে হতো ভাবনার আত্মীয়, তাকেই মনে হচ্ছে সে তো প্রতিবেশীও নয়। তাহলে এই সময় কাকে ভরসা করবে? কার হাতে হাত রেখে বলবে, "এই রণরক্ত সফলতা সত্য / তবু শেষ সত্য নয়।" শেষ সত্য তবে কী? কবে আসবে সেই শেষ সত্য যার জন্য অপেক্ষায় আছে এই পৃথিবী? তার কোনও উত্তর নেই। পৃথিবীতে প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, স্নেহ নেই। নিস্তেল অন্ধকারে কেউ প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার নেই। অন্ধকার সুকেশী রাত কার হাতেই বা খোঁপা বেঁধে নেবে? যে হাতের একমাত্র কাজ ছিল ফসল ফলানো, একমাত্র কাজ ছিল গাছে গাছে আঙুল বুলিয়ে যাওয়া, একমাত্র কাজ ছিল অন্য হাতের ছোঁয়ায় পাহাড় পেরিয়ে যাওয়া, সেই সমস্ত হাত এখন রণরক্ত অন্ধকারে ভাগ করছে দেশ, ভাগ করছে প্রেম, এমনকী ভাগ করছে পরমকে। সেই পরম যা চিরশান্তির, চিরআনন্দের। এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে বেঁধে রাখার মন্ত্র জানে যে পরম বা যে পরম নিজেই এক আশ্চর্য ঘৃণাজয়ী মন্ত্র সেই পরমের হাতে অস্ত্র গুঁজে এখন এই অক্ষম সভ্যতা ঘৃণার উৎসবে উল্লাসে মশগুল। তাহলে শেষ যে সত্য, যে সত্য প্রেমের, গানের, ভালোবাসার তার আসন কোথায়? সে কি আর আসবে না? মানুষ কি আর কোনওদিন নিজের অন্ন ভাগ করে নেবে না ক্ষুধার্তের সঙ্গে? কোনওদিনই কি আর কেউ চণ্ডালিকার কাছে জল প্রার্থনা করবে না?
আরও পড়ুন- শ্রীচৈতন্যের জন্ম থেকে মৃত্যু- রহস্য আজও বহমানঃ ১
এই অসহায় প্রশ্ন তো শুধু আজকের নয়। বারবার সভ্যতার সামনে এই আশঙ্কা এসেছে। মনে হয়েছে, এই শেষ। সব রাস্তাই গণকবরের দিকে যাচ্ছেই যখন বৃথা রাস্তা খুঁজে কী লাভ? আমি যদি পথ তৈরি করতে না পারি, তবে পথের মতো করেই নিজেকে তৈরি করে নিই। কিন্তু আশার কথা এটাই, সকলেই পথ না হলেও কেউ কেউ নিজেই পথ হয়ে ওঠেন। বিকল্প সন্ধান করেন। রণরক্ত সফলতার মাটিতে গোলাপগাছের চারা লাগিয়ে যান। ঘৃণার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেন,
"মূর্খ নীচ পতিত দুঃখিত যত জন / ভক্তি দিয়া কর গিয়া সবার মোচন।।" (চৈতন্যভাগবত)।
শুধু ভক্তি, শুধু প্রেম। এমন এক আয়তন যেখানে কোনও যুদ্ধ নেই, ঘৃণা নেই, হিংসা নেই। মানুষের হৃদয় ছাড়া জয় করবার মতো কোনও ক্ষেত্র নেই আর। তৎকালীন হিন্দু ব্রাহ্মণ্যসমাজের সমস্ত একরোখা গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রেমই ছিল শ্রীচৈতন্যর একমাত্র হাতিয়ার।
চৈতন্যজীবনীকার স্বামী সারদেশানন্দ চৈতন্য প্রসঙ্গে লিখেছেন "তাহার জীবন বলবীর্যের উৎস, মৃতসঞ্জীবনীর সুধা।" সত্যিই তো। যে মানুষ আজীবন প্রেমের কথাই বলে গেছেন, প্রেমের গানই গেয়েছেন, প্রেমের মিছিলে যিনি হৃদয়ের জয়গান গেয়েছেন তিনিই তো মৃতসঞ্জীবনীর সুধা। অমৃত। প্রেমই তো মানুষকে আজীবনের করে রাখে। তাঁকে মৃত্যুঞ্জয়ী করে। সে প্রেম মানুষীর প্রতি মানুষের হোক বা নিরাকার পরমের প্রতি। গভীর বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলেও প্রেম চিরন্তন। কিন্তু 'বলবীর্যের উৎস' কেন? প্রেমের জগতে বলের কী কাজ, বীরত্বেরই বা কী ভূমিকা? প্রেম তো অসীম সমর্পণে দীক্ষিত। শুধু 'বলবীর্যের উৎস' নয়, কৃষ্ণদাস কবিরাজ লিখছেন,
"চৈতন্য সিংহের নবদ্বীপে অবতার।/ সিংহগ্রীব সিংহবীর্য সিংহের হুঙ্কার।।"
চৈতন্যকে ব্যাখ্যায় এই চূড়ান্ত মিসোজিনিস্ট প্রয়োগ শ্রী চৈতন্যের প্রেমের অভিমানকেই যেন গুরুত্ব দেয় না। যেন পৃথিবীতে প্রেম অনাদরে পড়ে থাকা ধুলোসমান। 'ইতিহাসের শ্রীচৈতন্য' প্রবন্ধে স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ লিখছেন,
"চৈতন্য সম্পর্কে সাধারণ্যে যে ধারণা রহিয়াছে তাহা হইল এই : তিনি ছিলেন পৌরুষহীন এক পুরুষ। সারাজীবন তিনি শুধু কান্নাকাটি করেই কাটাইয়াছেন।"
আরও পড়ুন- প্রতিহিংসায় প্রেম নেই, অহং আছে
স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ এই 'প্রচলিত'-তে বিশ্বাস করেননি। তিনি তাঁর প্রবন্ধের প্রথমেই ব্যাখ্যা করেছেন, শ্রীচৈতন্য একজন সিংহসমান পুরুষ ছিলেন। তাই তিনিই বলবীর্যের উৎস। শক্তির রাজনীতির মোহে তাঁরা প্রেমের ভাষ্যকে বুঝতেই পারেন না। বুঝতে পারেননি ভারতবর্ষের রক্তের ইতিহাসে ধীরে ধীরে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন ন্যারেটিভ। অজস্র আচার, শক্তি প্রবল, দুর্বোধ্য তন্ত্র-মন্ত্র-রক্তের বিকল্পে জন্ম নিচ্ছে সহজ পথে হাঁটার আহ্বান। হাঁটাই অস্ত্র। গান গাইতে গাইতে হাঁটা, নাচতে নাচতে হাঁটা। ধুলোবালির পথের ধারে ছায়ায় বসে পরমের সন্ধানের ভাষ্য। কোনও মন্দির নেই, কোনও মসজিদ নেই। বিধর্মী কেউ নয়, সমধর্মীও কেউ নয়। যে জন মনের ভাবের সঙ্গে গিট বাঁধছে সেই-ই আত্মীয়। তাঁর হৃদয়ে শুধু কৃষ্ণপ্রেমের গান। কোন কৃষ্ণ? যে কৃষ্ণের হাতে অস্ত্র- সে নয়, যে কৃষ্ণের ঠোঁটে বাঁশি সেই কৃষ্ণের প্রতি প্রেম। গান ছাড়া আর কোনও নৈবেদ্য নেই। সকলেই চৈতন্যের আত্মীয়। সে যেন পঞ্চকের অতীত। সমস্ত দেওয়াল সে ভেঙে ফেলতে চায়। শুধু এই বাংলায় নয়, আসমুদ্র ভারতে। ছোটনাগপুরের প্রান্তিক আদিবাসীরা যেমন সেই প্রেমের দীক্ষায় নিমগ্ন হচ্ছেন তেমনই বঙ্গের, ওড়িশার অজস্র, অসংখ্য মানুষ সেই জনস্রোতে পা মেলাচ্ছেন। নতুন মিছিল তৈরি হচ্ছে। শক্তির বিরুদ্ধে প্রেমের রাজনীতি, হৃদয়ের মিছিল। সে মিছিল শুধু ধর্মীয় ছিল এটা ভাবলে বোধহয় ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ভুল ব্যাখ্যা হবে। ভক্তিবাদের সেই মিছিল ছিল আসলেই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, ক্ষমতার বিরুদ্ধে, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে সময়ের গণমিছিল। এই মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্য। এমনকী চৈতন্যদেবই স্পষ্ট উচ্চারণে ঘোষণা করেন, শালগ্রামশিলা পুজোর অধিকার শুধু ব্রাহ্মণের নয়, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এবং সকল শ্রেণির নারীদেরও আছে। চৈতন্যদেবের সমকালে বৈষ্ণব নারীরা সমাজের সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে সমাজ গঠনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। স্বর্ণকুমারী লিখছেন,
"স্নান বিশুদ্ধ, শুভ্রবসনা গৌরী বৈষ্ণবী ঠাকুরাণী বিদ্যালোক বিতরণার্থে অন্তঃপুরে আবির্ভূত হতেন।"
এই উদাহরণ অশেষ। এবং এই সমস্ত উদাহরণ আসলে শ্রীচৈতন্যদেবের ঐতিহাসিক অবস্থানকে আরেকবার, এই সময়ের নিরিখে ব্যাখ্যা করার দাবি নিয়ে আসে। সেই সময় কঠোর ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, নির্দয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রীচৈতন্য যে ভক্তিবাদের আন্দোলনের সূচনা করেন, প্রেমকে সম্বল করে শক্তির বিরুদ্ধে যে উচ্চারণকে জনস্বরে উত্তীর্ণ করেন, হাঁটাকে অস্ত্র করে গানকে সম্বল করে নতুন রাজনৈতিক ভাষ্য তৈরি করেন - সেই বিকল্পের জন্যই আজ আমাদের প্ৰিয় দেশ অপেক্ষায় আছে।