নতুন সংসদ ভবন হোক বা কুস্তিগীরদের অবজ্ঞা— বিজেপির চাল তবে সফল?

Wrestler's Protest: সব কিছুরই একটাই হাতে গরম সমাধান মোদি সরকারের কাছে রয়েছে — 'জাতীয়তাবাদ'।

এতদিনে আপনি হয়তো মনে মনে ভাবতে শুরুই করেছেন, মহিলা কুস্তিগীরেরা যে যৌন হেনস্থার অভিযোগ করে আসছেন তা নিশ্চয়ই সত্যি নয়। যদি তা সত্যি হতো, তাহলে কি এতদিনে কোনও ব্যবস্থা নিত না সরকার? যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই ব্রিজ ভূষণ শরণ সিংয়ের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপই কি করত না পুলিশ? আপনি নিশ্চয়ই এতদিনে জেনে গিয়েছেন, এর পিছনে রয়েছে হরিয়ানার জাট বনাম উত্তরপ্রদেশের কুস্তিগীরদের লবির লড়াইয়ের সেই ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব। হয়তো ভাবছেন, কোনও বড় ষড়যন্ত্র না থাকলে কি নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধনের দিনে এমন একটা 'মহাপঞ্চায়েতের' আয়োজন করেন কুস্তিগীরেরা!

আপনি যদি এত কিছু না-ও ভেবে থাকেন, আপনার বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন অনেককেই খুঁজে পাবেন, যাঁরা এই দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছেন। আর এটাই শাসকের লক্ষ্য। আম জনতার মনের মধ্যে সন্দেহের বীজ পুঁতে দেওয়া। আর সঙ্গে মন ভোলানো প্রতীকী ছবি তৈরি করা। একের পর এক। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ছবির উপর ছবি তৈরির কর্মযজ্ঞ চলল। এমনই সাধারণত হয়ে থাকে। শাসকেরা এমনটাই করে থাকেন।

এই নরেন্দ্র মোদি সরকারেরই মন্ত্রী ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক এম জে আকবর। বিদেশ দফতরের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন প্রথম মোদি সরকারের আমলে। #মিটু আন্দোলনের সময়ে একাধিক মহিলা যখন তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ আনলেন, মাত্র ১০ দিন লেগেছিল। মাত্র ১০ দিনের মধ্যে, ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর মোদি সরকারের মন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন এম জে আকবর।

আর এই ঘটনায় মাস পাঁচেক হতে চলেছে। অথচ বিজেপি সাংসদ ও ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজ ভূষণ শরণ সিং কিন্তু দিব্যি বহাল তবিয়তেই রয়েছেন। মাঝে মাঝে হুঙ্কার ছাড়ছেন। অযোধ্যার সাধুরা তাঁর জন্য মিছিল করতে শুধু প্রস্তুত ছিলেন তা-ই নয়, নাবালকদের যৌন হেনস্থার বিচার ও শাস্তির জন্য যে পকসো আইন রয়েছে, তাতে বদল আনতে আন্দোলনেও প্রস্তুত ছিলেন তাঁরা!

আরও পড়ুন- মহিলা কুস্তিগীরদের দিনের পর দিন যৌন হেনস্থার অভিযোগ! কে এই বিজেপির বাহুবলী ব্রিজ ভূষণ?

বিজেপির ছোট এবং মাঝারি নেতারা বলছেন, মহিলা কুস্তিগীরেরা তো ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে তেমন কোনও খাস প্রমাণই দিতে পারেননি এখনও। তদন্ত করা এবং প্রমাণ-সহ সেই রিপোর্ট আদালতে পেশ করার কাজ পুলিশের। অথচ সেই পুলিশই একটা এফআইআর লিখতে মাস কয়েক সময় নিয়ে নিল। আদালতের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করল। ব্রিজের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া মিলেছে না মেলেনি, এখন সে নিয়েই তরজা চলছে।

পুলিশ কোনও কড়া ব্যবস্থা নিতে পারছে না। শাসক দল কোনও পদক্ষেপ করতে পারছে না। তার মানে ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে কুস্তিগীরদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ নেই, এটাই মনের মধ্যে গেঁথে যাবে। আর শাসকেরা ঠিক এটাই চান।

তাই সোনাজয়ী সাক্ষী মালিক বা ভিনেশ ফোগাটরা রাস্তায় বসে থাকুন বা পুলিশের সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তিতে জড়ান, শাসক চায় সময় নষ্ট করতে। একে তো অভিযোগ নিয়েই যথেষ্ট সন্দেহ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে শাসক। আর এর উপরে যদি কোনও রকম ভুল পদক্ষেপ সাক্ষীরা করে ফেলেন, তা হলেই কেল্লা ফতে।

আগামী লোকসভা ভোটে শুধুমাত্র পাঁচ-দশটা আসন জেতানোর টোপ দিয়ে শাসক দলের নেতাদের নিজের পকেটে পুরে রেখে দিয়েছেন একজন বিজেপি সাংসদ, এটাই তো শাসক দলের পক্ষে যথেষ্ট লজ্জার বিষয়।

কিন্তু তাঁরা লজ্জিত নন। কারণ নারীদের প্রতি সম্মানের থেকেও বড় ধর্ম রক্ষা। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম ব্রিজ ভূষণ। অযোধ্যার সাধুদের সমর্থন তাঁর পাশে। সঙ্গে টাকা, বাহুবল, প্রভাব — এ সব তো আছেই। তাই অভিযোগকে লঘু হওয়ার সময় দাও শুধু। অভিযোগকারীদের লঘু করো।

নারী সম্মান ছেড়ে ধর্মকে রক্ষা করতে না চাইলে কেউ শিশুদের উপর যৌন অত্যাচারের আইনের বদল চেয়ে আন্দোলনে যেতে চায়! কিছুই হয়নি ভাব করে নিশ্চুপ থাকেন শাসক দলের শীর্ষ নেতারা!

আসলে এই ধরনের আন্দোলন সামলানোর ক্ষেত্রে বিজেপির মূল অসুবিধা এখানেই, যে এটিকে শুধুমাত্র কংগ্রেস-বিজেপির বাইনারিতে ফেলা যাচ্ছে না একেবারেই। কৃষক আন্দোলন নিয়ে বিজেপি সরকারকে পিছু হঠতে হয়েছিল কারণ সেই আন্দোলন রাজনৈতিক দলগুলির আন্দোলন ছিল না। নাগরিক আন্দোলনে উত্তীর্ণ হয়ছিল সেটি। সামনে অবশ্য পঞ্জাবের ভোট এসে দাঁড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই কৃষি বিল নিয়ে পিছু হঠতে বাধ্য হয় মোদি সরকার।

সিএএ-এনআরসি আন্দোলনও নাগরিক আন্দোলন ছিল। যথেষ্ট সমস্যায় পড়ে কেন্দ্রীয় সরকার। তখন কোভিড এসে গিয়েছিল বলে মান রক্ষা হয়। এবার কুস্তিগীরদের আন্দোলন একই রকম সমস্যায় ফেলেছে মোদি সরকারকে। কোনও দলের রং লাগানো যাচ্ছে না। রাহুল গান্ধিকেও টেনে আনা যাচ্ছে না।

তবে সব কিছুরই একটাই হাতে গরম সমাধান মোদি সরকারের কাছে রয়েছে — 'জাতীয়তাবাদ'। এই দিয়ে সব মুড়ে দাও। সব কালিমা মুছে দাও। যে খেলোয়াড়রা সারা বিশ্বে ভারতের মুখ উজ্জ্বল করলেন, তাঁদের মুখের আলো ছিনিয়ে নাও।

কর্ণাটকের পরাজয়, কুস্তিগীরদের আন্দোলনকে প্রদীপের নিচে রেখে প্রদীপ তুলে ধরো প্রধানমন্ত্রীর মুখে। তিনি নতুন ছবি তৈরি করে দেবেন। সেঙ্গোল নিয়ে মিথ্যের বেসাতি করে, সেই রাজদণ্ডকে গণতন্ত্রের পীঠস্থানে বসিয়ে, তার সামনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে, নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করে — তিনি ছবি তৈরি করে দিলেন।

সেই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং ভারতের প্রধান বিরোধীদলগুলির অনুপস্থিতিকে উপেক্ষা করে তিনিই শুষে নিলেন প্রদীপের সমস্ত আলো। সাধু-সন্ত পরিবেষ্টিত হয়ে, নামমাত্র সর্বধর্ম সমন্বয় সভা করে (যার ছবি আপনার মাথায় নেই কিন্তু), আবারও জানান দিলেন — 'ভারতের চরিত্র বদলে গেছে'। সে অবশ্য কোভিডকালে অযোধ্যায় রামমন্দিরের ভূমিপূজন করে প্রধানমন্ত্রী আগেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন- নয়া সংসদ ভবনে নরেন্দ্র মোদির ‘অভিষেক’! কোথা থেকে এল এই রাজদণ্ড?

এই জাতীয়তাবাদ,এই নায়কতন্ত্রের জোরেই তিনি বার বার বাজিমাত করে চলেছেন। যেই রাহুল গান্ধি নতুন সংসদ ভবন নিয়ে আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে মোদির সমালোচনা করলেন, অমনি মোদি বলে উঠলেন,"নতুন সংসদ ভবন তৈরি করে দেশের মুখ উজ্জ্বল করলাম। কিন্তু কংগ্রেস দেশের গর্বের দিনে এর উপরেও কাদা ছুঁড়ল। আসলে কংগ্রেস এটা সহ্য করতে পারছে না যে, একজন গরিবের ছেলে কীভাবে এঁদের রাজ করতে দিচ্ছে না আর এঁদের পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে কী ভাবে প্রশ্ন তুলছে।"

অর্থাৎ সেই 'আক্রান্ত' হওয়ার গল্প। নিজের উপর সমস্ত আলো টেনে নেওয়ার গল্প। ঠিক যেভাবে কর্ণাটকে দলকে জেতাতে না পেরে, তিনি কয়েকদিন আগেই জাপান, অস্ট্রেলিয়া ঘুরে এসে নিজেকে 'বস্' হিসেবে তুলে ধরেছেন। আবার সংসদ ভবনের উদ্বোধনের পরেই ভারত কীভাবে দ্রুত গতিতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলেছে, সেই প্রতিবেদনে চারদিক ছেয়ে ফেলেছেন।

আর এই ছবিগুলির মাঝেই চাপা পড়ে গেল সাক্ষী মালিকদের প্রতিবাদ। ন্যায় বিচারের আশা। হয়তো এমনই খবরের ভিড়ে ব্রিজ ভূষণের বিরুদ্ধে প্রতীকী ব্যবস্থা হবে। সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না।

আর আমরা ভুলে যাব অনেক ছবি। যেমন ভুলে গেছি, নোটবন্দির সময়ে হাজার হাজার মানুষের ব্যাঙ্ক ও এটিএমের সামনে লাইনে দাঁড়ানোর ছবি। যেমন ভুলে গেছি, হঠাৎ অপরিকল্পিত লকডাউনে হাজার হাজার শ্রমিকের রাস্তায় হাঁটতে থাকার ছবি। যেমন ভুলে গেছি, অক্সিজেনের অভাবে কিংবা হাসপাতালে বিছানা না পেয়ে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর ছবি। ভুলে গেছি, কোভিডে মৃত ব্যক্তিদের দেহ গঙ্গার জলে ভাসানোর ছবি। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, এই সব ছবির সঙ্গে সাক্ষী মালিকদের পুলিশের সঙ্গে ধ্বস্তাধ্বস্তি ও যন্তরমন্তরে ধরনার ছবির তুলনা হয় না।

কিন্তু প্রেক্ষাপটটি বোঝার চেষ্টা করুন। পরিকল্পনা বোঝার চেষ্টা করুন। শাসকের ছেলে-ভোলানো খেলার ছকটি ধরার চেষ্টা করুন। বিরোধী রাজনীতিকরা বুঝেও কিছু করতে পারছেন না। তাঁরা পরিচিত ছকেই 'বিরোধিতা' করছেন বা 'মোদি বনাম...' বাইনারিতে আটকে যাচ্ছেন। কৃষক আন্দোলন, সিএএ-বিরোধী আন্দোলন, কুস্তিগীরদের আন্দোলন পথ দেখাচ্ছে। বার বার পথভ্রষ্ট হচ্ছি আমরা। ছেলে-ভোলানোর খেলায়।

More Articles