‘কাঠিবাজী’ই কি কাঁটা জয়ের মুখে! কীসের আভাস দিতে চাইলেন বেসুরো দিলীপ

Dilip Ghosh: বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে দিলীপ ঘোষ জানালেন, 'চক্রান্ত, কাঠিবাজি রাজনীতির অঙ্গ। আমি সেভাবেই নিয়েছি। আমি পুরো পরিশ্রম করেছি, কিন্তু সফলতা আসেনি।'

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, এবার বাংলায় সবচেয়ে ভালো ফল করবে বিজেপি। কিন্তু মঙ্গলবার লোকসভা ভোটের ফল হাতে আসার পর দেখা গেল, বাংলায় ভালো ফলাফলের আশা তো দূর, নিজের অস্থিত্ব টিকিয়ে রাখতেও কালঘাম ছুটে গিয়েছে বিজেপির। বাংলায় সবুজ ঝড়ে কার্যত ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়ে অথচ এই অবস্থা যে বঙ্গে বিজেপির বরাবর ছিল, তা কিন্তু নয়। বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষের জমানাতেই পদ্ম ফুটেছিল এ রাজ্যে। ২০১৯ লোকসভা ভোটেই অন্তত ১৮টি আসন পেয়েছিল বিজেপি। সেই সংখ্যা এবার নেমে এসেছে ১২-য়। নেপথ্যে কী কারণ? বঙ্গ বিজেপির সংগঠনের গলদ নাকি অন্য কিছু।

প্রতিবার মেদিনীপুর আসন থেকেই লড়েন দিলীপ ঘোষ। তবে এবার সেই মেদিনীপুর থেকেই সরিয়ে দেওয়া হল তাঁকে। অথচ ওই মেদিনীপুরেরই ভূমিপুত্র তিনি। পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুরে তাঁর জন্ম, ঝাড়গ্রামে তাঁর পড়াশোনা। সেই ভূমিপুত্রকে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করে এনে ফেলা হল বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রে। অথচ লোকসভা ভোটকে কেন্দ্র করে যা হোমওয়ার্ক তিনি করেছিলেন, সবটাই মেদিনীপুর। গত এক বছরে এলাকার হাজার দেড়েক গ্রাম চষে ফেলা থেকে শুরু করে জনসংযোগের সবটাই। বর্ধমান-দুর্গাপুরে প্রচারে বেরিয়ে বারবার ক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে দিলীপকে। সেই সমস্ত কিছুর উপর দিয়েই দলের নির্দেশ মেনে যাবতীয় চেষ্টা করেছেন দিলীপ। কিন্তু তবু পারেননি। ২০২৪ লোকসভা ভোটে হাতছাড়া হয়েছে তাঁর সাংসদ পদ। প্রথমে বিজেপির সভাপতি, তারপর দলের সাধারণ সম্পাদক। একের পর এক বিজেপির গুরুত্বপূর্ণ পদ হাত থেকে বালির মতোই খসে দিয়েছে দিলীপ ঘোষের। এবার গেল সাংসদ পদও।

আরও পড়ুন: বহিরাগতর কাছে শোচনীয় পরাজয়! অধীর আর দিলীপকে হারাল তাঁদের দলই?

অথচ দিলীপ ঘোষের এলাকা মেদিনীপুরে যাঁকে দাঁড় করাল দল, তিনিও কিন্তু গো-হারা হারলেন মেদিনীপুর কেন্দ্রে। জিততে পারলেন না দিলীপও। অর্থাৎ দলের সিদ্ধান্তে এক সঙ্গে দু'টি আসন হাতছাড়া হল তাঁর। বর্ধমান-দুর্গাপুরে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে যে দিলীপবাবুও খুব সম্মত ছিলেন, এমনটা নয়। মঙ্গলবার লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশ হতেই দেখা গেল প্রায় দেড় লক্ষ ভোটে হেরেছেন দিলীপ। হেরেছেন তৃণমূল প্রার্থী তথা প্রাক্তন ক্রিকেটার কীর্তি আজাদের কাছে। যাঁকে কিনা গোড়া থেকেই বহিরাগত বলে কোণঠাসা করার চেষ্টা করে গিয়েছেন দিলীপ। একসময় বিজেপির হয়ে প্রার্থী হয়েছিলেন কীর্তি। ২০২৪ ভোটে তৃণমূল প্রার্থী করে তাঁকে। এবং বাংলার পোড় খাওয়া রাজনীতিক দিলীপ ঘোষকে হারিয়ে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনটি জিতেও নেন কীর্তি।

আরএসএসের দীর্ঘদিনের কর্মী দিলীপ। ভূমিস্তরে ঘুরে ঘুরে বহু অভিজ্ঞতা পুরেছেন ঝুলিতে। বিজেপি নেতা ও বঙ্গ বিজেপির সভাপতি হিসেবে একদিন দলকে রাজ্যে যে স্থানে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন দিলীপ, সেই জায়গাটা ক্রমেই অপসৃয়মান। সঙ্ঘের অনুশাসন তাঁকে শিখিয়েছে প্রশ্নহীন হতে, বিশেষত দলের প্রতি তো বটেই। সেই শিক্ষা থেকেই দলের সিদ্ধান্তকে মাথা পেতে নিয়ে দিলীপকে বলতে শোনা গিয়েছে, গোটা বাংলাই বিজেপির এলাকা। তিনি যেখানে যান জেতার জন্যই যান। সেই চেষ্টাও নতুন কেন্দ্রে করেছিলেন দিলীপ। কিন্তু ফল মেলেনি। বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রের এই হার কি দিলীপের দলীয় আনুগত্যে কোথাও চিড় ধরাবে। মঙ্গলবার হারের পর কথা বলতে গিয়ে বহু চেষ্টার পরেও যেন চাপা রইল না সেই ক্ষোভ।

 

বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে দিলীপ ঘোষ জানালেন, 'চক্রান্ত, কাঠিবাজি রাজনীতির অঙ্গ। আমি সেভাবেই নিয়েছি। আমি পুরো পরিশ্রম করেছি, কিন্তু সফলতা আসেনি।' এর প্রেক্ষিতে ঠিক কার 'কাঠিবাজি'র কথা তিনি বলতে চেয়েছেন, সেই প্রশ্নের উত্তরে দিলীপ বলেন, 'রাজনীতিতে যা হয়, সবাই কাঠি নিয়ে ঘুরতে থাকে।' তবে কি দিলীপের এই কেন্দ্রবদলের নেপথ্যে রয়েছে দলেরই কারওর হাত? উঠেছে প্রশ্ন। যদিও হারের জন্য সেভাবে কাউকে দোষারোপ করেননি দিলীপ। জানিয়েছেন, "পার্টি নতুন ছিল, আমি নতুন ছিলাম, লড়াই করেছি। তখন পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। সারা ভারতে বিজেপির ফল খারাপ হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি সামনে ছিলেন, তাঁর ফলও আগের মতো ভাল হয়নি। আমি লড়াই করেছি, পরিশ্রম করেছি। সফল হতে পারিনি।"

মঙ্গলবার দিলীপ ও কীর্তির ভোটের ব্যবধান বাড়তে শুরু করতেই ভোটকেন্দ্রের সামনে ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েন দিলীপ। চারপাশের লোকজন ঘিরে ধরে দিলীপ ঘোষের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। যদিও স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হাত নেড়ে বেরিয়ে গিয়েছেন দিলীপ। দিলীপের এই হার কি কোথাও তাঁর ভাবমুর্তিতে আঁচড় ফেলল? সেই প্রশ্নের উত্তরে বিজেপি নেতা জানান, 'রাজনীতিতে ওঠানামা হয়। এটা চলতে থাকে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পার্টি কোথায় ছিল, নীচে চলে গিয়েছিল। আবার দাড়িয়েছেন, সরকার গঠন করেছেন। লোকসভায় হেরেছেন, আবার উঠেছেন। আপডাউন মেনে নিতে হবে। বিশ্লেষণ করতে হবে।" কিন্তু সত্যিই কি এই হার মন থেকে মানতে পেরেছেন দিলীপ? কারণ নির্বাচনী লড়াইয়ের কেন্দ্র বদল নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দিলীপকে বলতে শোনা গিয়েছে, 'ভূমিকা তো থাকেই পার্টির। কার ভূমিকা আমি জানি না। খোঁজ করারও কথা নয়। পার্টি বলেছে, আমি শৃঙ্খলাবদ্ধ কর্মী। আমায় পার্টি ইলেকশন লড়তে বলেছে, আমি লড়েছি,জিতেছি- তখন অনেককিছু আমার হাতে ছিল। এখন খালি লড়াইটা আমার হাতে ছিল।' এমনকী দিলীপ এ-ও বলেন, "সবে নির্বাচন শেষ হয়েছে। আমি পূর্ণসময়ের কর্মী। সভাপতি বানিয়েছে, সাধারণ সম্পাদক বানিয়েছে। কেন্দ্রের সহ সভাপতি বানিয়েছে। পার্টি ডিসিশন নেবে আমাকে নিয়ে, নয়তো আমি ডিসিশন নেব।"

আরও পড়ুন: ‘ভূমিপুত্রে’ আস্থা নেই? মেদিনীপুর থেকে কেন দিলীপ ঘোষকে প্রার্থী করল না বিজেপি?

আসলে এই ভূমিকা প্রসঙ্গে কার কথা বলতে চাইলেন দিলীপ। নিন্দুকেরা বলছেন, দিলীপ ঘোষকে ক্রমে দলের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে কোথাও না কোথাও হাত রয়েছে শুভেন্দু অধিকারী ও দলের বর্তমান সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের। দিলীপ দলের পুরনো লোক। তাঁর হাতেই একদিন সোনালি দিনের মুখ দেখেছিল বাংলার বিজেপি। অথচ সেই দিলীপকেই খাটো করে বিজেপি ভরসা রেখেছে দলবদলু শুভেন্দুতে। তাতে কি বিজেপিমনস্ক জনগণের আস্থাও কোথাও কমেছে বঙ্গ বিজেপির প্রতি? যার ফলাফলই বাংলায় ভুগছে গেরুয়া শিবির? অনেকে অবশ্য মনে করছেন, ২০২৪ ভোটে ধাক্কার পর ফের পুরনো দিলীপেই আস্থা রাখতে চাইবে দল? সে ক্ষেত্রে পুরনো ফর্মে ফিরতে পারবেন তো দিলীপ। যদি তা না হয়, তাহলে কি দলীয় রাজনীতি থেকে বিদায় নিয়ে সঙ্ঘের ছেলে ফের সঙ্ঘেই ফিরে যাবেন? থাকছে সেই প্রশ্নও।

More Articles