'একলা চলো রে' মানেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন?
Solitude: তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪২-৪৩ নাগাদ 'একলা চলো রে' গানটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে এবং গানটি গাইবার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে।
সের্গেই ক্রিকালেভ ৩১৩ দিন ছিলেন মহাকাশে। একেবারে একা। নিঃসঙ্গ। রাষ্ট্রনৈতিক এবং কাকতালীয় – অভূতপূর্ব এক ঘটনার কারণে ক্রিকালেভ এইভাবে ঘুরপাক খেতে থাকেন কক্ষপথে। আমি ভেবে চলেছি কীভাবে কাটত তাঁর দিনরাত? তাঁর ভাবনাগুলো ঠিক কেমন ছিল? একাকিত্ব নিয়ে নানা সময়ে দার্শনিক এবং চিন্তাবিদেরা অনেক গভীর আলোচনা করেছেন, দেশে এবং বিদেশে। প্রকৃতপক্ষে লোকালয়, জনপদ, গ্রাম, মহল্লা, শহর এবং সর্বোপরি সমাজ মানেই কিন্তু বহু মানুষের সংস্পর্শে এবং বহু মানুষের সান্নিধ্যে গড়া দৈনন্দিন। হয়তো সেইজন্যই মানুষের হাতে বা বলা ভালো ক্ষমতার হাতে শাস্তি হিসেবে ব্যবহৃত হয় নিঃসঙ্গতা। আমাদের মনে পড়তে পারে, সোভিয়েত রাশিয়াতেই বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে পাঠানো হতো। আবার ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের অনেককেই পাঠানো হতো ‘সলিসিটার সেল’ বা একা কাটানোর বন্দি কুঠরিতে। অত্যাচার, পীড়ন এবং একাকিত্ব শারীরিক এবং মানসিক স্থিতাবস্থা নড়বড়ে করে দিত। অন্য বন্দি বা সহযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলবার বা মত-মনোভাব আদানপ্রদানের কোনও সুযোগ যেখানে নেই সেখানে প্রতিটা মুহূর্ত অব্যক্ত বেদনায় গুমরোতে থাকে। তখন সে হারাতে থাকে প্রত্যয় এবং দায়বদ্ধতা। এইভাবে সেই সময় বহু বিপ্লবী তাঁদের মানসিক স্বাভাবিকতা হারিয়েছিলেন। নিথর, নিষ্কম্প দেয়ালের সঙ্গে কতক্ষণ কথা বলা যায়?
একাকিত্ব বা নিঃসঙ্গতার আবার নানা স্তরও বর্তমান। সের্গেই ব্রিকালেভ যখন মহাবিশ্বে অপার শূন্যতায় দীর্ঘমেয়াদি ‘নির্বাসন’-এ ছিলেন, তখন তাঁর, অনুমান করি, দুই প্রধান মাত্রায় চিন্তাস্রোত প্রবাহিত হচ্ছিল। প্রথমত, পৃথিবীতে ফেরার অনিশ্চয়তা এবং তজ্জনিত ভয়। স্পেসশিপ থেকে মহাবিশ্বের যে বিপুল পরিধি দেখা যায়, সেখানে নানা গ্রহতারকা, উল্কা, ধূমকেতু, গ্যালাক্সি, উপগ্রহ থাকলেও কোনও প্রাণ বা প্রাণী নেই। ফলে, প্রাণবন্ত কোনও ব্যক্তির পক্ষে সেখানে দিনের পর দিন থাকা বেশ কষ্টকর। দ্বিতীয়ত, মনে রাখতে হবে ব্রিকালভের ফেরার কথা ছিল পাঁচমাস পরে। তখনই সোভিয়েত রাশিয়া বা USSR -এর আকস্মিক নাটকীয় পতন হয়। তারিখটা ছিল ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৯১। তেত্রিশ বছরের ব্রিকালেভ শেষপর্যন্ত ফিরলেন ১৯৯২ সালের ২৫ মার্চ। গিয়েছিলেন ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে, ফেরার কথা ছিল ডিসেম্বরের শেষে।
গল্পটি বলতে বলতে মনে পড়ছে, সুনীতা উইলিয়ামসের কথা। যিনি এই মুহূর্তে মহাকাশে স্পেস স্টেশনে রয়েছেন এবং প্রত্যেকদিন নানা যান্ত্রিক কারণে তাঁর পৃথিবীতে ফেরার তারিখ ক্রমাগত পিছিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ মহাকাশ অবস্থানে নানা ধরনের শারীরিক মানসিক অসুখের ভয় থাকে। ভয় থাকে মহাজাগতিক অবস্থানের বিরূপ প্রভাবের। সেইসব ভয় এবং মৃত্যুচিন্তাও নিশ্চয়ই ব্রিকালেভকে পীড়িত করত। অন্যদিকে, তাঁর নিজস্ব নাগরিকত্ব এবং স্বদেশস্মৃতিও তখন পরিবর্তনের আঁচে দিশাহারা। ব্রিকালেভ, বস্তুত, মহাকাশে যখন গিয়েছিলেন, তখন তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের নাগরিক, নানা টানাপড়েনে বিধ্বস্ত হয়ে যখন ফিরলেন তখন তিনি রাশিয়ার নাগরিক। এ এক অভূতপূর্ব ঘটনা! যখন মহাকাশে ছিলেন ব্রিকালেভ, তখন নিশ্চয়ই তাঁর মনে পড়ত পরিবার, বন্ধুদের সান্নিধ্য বা প্রতিবেশী, সহপাঠী, সহকর্মীদের কথা। নিশ্চয়ই রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের বিপুল তরঙ্গের খবর শুনে তাঁদের নিয়ে দুশ্চিন্তা হতো ব্রিকালেভের। স্মৃতি আর স্পেসশিপের বর্তমান মিশে তাঁর পৃথিবীপৃষ্ঠে ফেরার আকাঙ্খাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করত। অন্তত আমার তো তেমনই অনুমান। এই স্পৃহা হলো অপর মানুষ এবং পরিবার সমাজের প্রতি সংযোগের স্পৃহা।
আরও পড়ুন- প্রাচীন কলকাতায় এসেছিলেন ক্যাপ্টেন হ্যাডক!
২
একাকিত্বের অবশ্য ভিন্ন একটা অভিমুখ এবং তাৎপর্য দীর্ঘদিন আমরা ধর্মচর্চার ক্ষেত্রে লক্ষ্য করেছি। সেটা লক্ষ্য করেছি সাহিত্যেও। হিন্দু, বৌদ্ধ এমনকী ইসলামের ক্ষেত্রে সাধক এবং সাধনার শীর্ষস্তরে সত্য উদঘাটিত হয় একা মানুষের সামনে। হয়তো সেই কারণেই পর্বত, পর্বতগুহা এবং সাধনা একাকার হয়ে যেতে থাকে। সাধুসন্ত, এমনকী বাউল-ফকির-কর্তাভজা-চিস্তি সমস্ত সম্প্রদায়েই নিঃসঙ্গ সাধনা এক স্বীকৃত বিষয়। কোনও সন্দেহ নেই, তাঁদের অভিজ্ঞতাগুলো থেকে সহজেই একথা প্রতিভাত হয় যে, দিব্যোন্মাদ অবস্থায় ব্যক্তিমানুষের সামনে ধরা পড়ে অপার্থিব, অলৌকিক জ্ঞান বা মার্গদর্শন। ধর্মতত্ত্ব এবং অধ্যাত্মবাদে সেজন্য বারংবার একলা হয়ে সঙ্গীহীন হয়ে ঈশ্বরদর্শন বা ঐশ্বরিক অনুভবকে স্পর্শ করার উপদেশ আছে। সমবেত প্রার্থনা বা সমবেত ধর্মাচরণের প্রচলন প্রায় সমস্ত ধর্মমত তথা ধর্মগোষ্ঠীতে প্রচলিত থাকলেও, সমবেতভাবে ঈশ্বর পরশনের কোনও উল্লেখ নেই। মরমিয়াবাদীরা আবার কেউ কেউ মনে করেন, একা না হলে আত্ম-উপলব্ধি হয় না। নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলা। নিজের অভ্যন্তরে অতীন্দ্রিয় আলোককণাকে অনুভব করার ফুরসৎ নিশ্ছিদ্রভাবে একলা না হলে, কিছুতেই হবার নয়।
প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে এই একাকিত্বের সম্ভবত শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো ‘মেঘদূত’ কাব্যটি। মহাকবি কালিদাস এই গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন প্রিয়মহিষীর বিরহে কাতর এক যক্ষের কাহিনি। দীর্ঘ এই কাব্যপাঠ করলে দেখা যাবে, পুরোটাই মেঘের সঙ্গে এক নির্বাসিত একাকী যক্ষের কল্পিত সংলাপ। মেঘকে মিত্র বা বন্ধু হিসেবে কথা বলে চলেছে সেই কাতর যক্ষ। রামগিরি পর্বতে সে প্রভু কুবেরের অভিশাপে নির্জনে পরিত্যক্ত। অথচ তার স্ত্রী, তার প্রিয় রমণী রয়েছে অলকাপুরীতে। সেই বেদনার কথা অনর্গল জানিয়েছে মেঘকে। তার দূত হিসেবে পাঠাতে চেয়েছে দয়িতার কাছে। বিরহের অন্তরালে এমন মরিয়া সেতু বাঁধার প্রয়াস আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে শুধু বিস্ময়করই নয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
যুগে যুগে কালে-কালে কত বিখ্যাত মনীষী এবং চিন্তাবিদ 'মেঘদূতম' কাব্যের টীকাভাষ্য রচনা করেছেন, নানা মূল্যবান ব্যাখ্যা আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আমার কিন্তু সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় একা মানুষটির প্রেমবাসনা, একা মানুষটির দৃষ্টিবিস্তার আর তীব্র আসক্তিটিকে। এইখানে, আমি সবাইকে লক্ষ্য করতে বলব, অন্য কোনও চরিত্র এখানে দৃষ্টিগোচর হয় না, যে প্রাণী। মেঘ আর যক্ষের কথোপকথন। উড়ে যাওয়ার পথ আর পথদৃশ্যমালা নিয়ে একটানা কথা বলে যায় যক্ষ। তার বন্ধুর নাম জলদ, মেঘ, নীরদ। প্রাণহীন জড় পদার্থ। এখানেই কিন্তু কাব্যটি পড়তে পড়তে আমার মনে পড়তে থাকে সের্গেই ব্রিকালেভের কথা। যক্ষ তার নির্বাসন কাটাচ্ছে প্রকৃতি এবং পৃথিবীর বুকে, কিন্তু ব্রিকালেভ ছিলেন মহাকাশের স্পেসশিপে। প্রাণী নয়, দু'জনের সঙ্গী হয়ে উঠলো আকাশের মেঘ। আমি জানি না, জানা সম্ভবও নয়, ব্রিকালেভ কি মেঘ এবং মহাকাশের অন্যান্য উড্ডীন বস্তুমণ্ডলীর সঙ্গে একা-একা কথা বলতেন? তাঁর কি কখনও মনে হয়েছে, পৃথিবীতে তাঁর পরিবার পরিজনদের কারও কাছে কোনো 'দূত' পাঠানো যেতে পারে?
আরও পড়ুন- এ কলকাতার মধ্যে আছে চৈনিক কলকাতা
৩
মজার কথা হলো, দুই চরিত্রের ক্ষেত্রেই একাকিত্ব তথা নির্বাসনের জন্য দায়ী হলো এক বাহ্যিক শক্তি। যাকে কোনওভাবেই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মানুষের বা যক্ষের নেই। এ কোনও সাধুসন্তের নিজস্ব সিদ্ধান্তে-জনসমাগম, পরিবার, বন্ধুমণ্ডলী ত্যাগ করে একাকী সন্ন্যাসে সুদূর হিমালয়ে যাত্রা নয়। দু'ক্ষেত্রেই কাজ করে যাচ্ছে কোনও এক উচ্চবর্তী ক্ষমতার কারণে মানুষের নির্বাসনের বাস্তবতা।
রবীন্দ্রনাথের গানে অবশ্য 'একলা' মানুষের বা ব্যক্তিমানুষের তাৎপর্য বারংবার নব-নব রূপে দেখা দিয়েছে। নানাভাবেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে নির্জন মানুষ আর তার অনুভূতিকে এক ধরনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন। বসন্তের এই মাতাল সমীরণে সবাই যখন জ্যোৎস্না রাতে বনে চলে গেছে, তখন কেউ একজন একা হয়ে সন্ধান করছে অন্তরমহলের, যেখানে কেউ একজন আসবেন। এই 'ঘর' হয়তো ইটকাঠপাথরের কক্ষমাত্র নয়, হৃৎপ্রকোষ্ঠও বটে। এই জাগ্রত অপেক্ষা সেজন্য নানা অর্থে রঙিন, নানা অর্থে ভাস্বর। গানটি লেখা হয়েছিল ১৯১৪ সালের ৫ এপ্রিল তারিখে। এই অপেক্ষা আর অনাগত মিলনের আকাঙ্খা অবশ্য নানাভাবে ফিরে আসে রবীন্দ্রনাথের গানে। গীতাঞ্জলি ১২৬-সংখ্যক রচনায় তো স্পষ্ট করে বলাই আছে মিলন-বিরহের বহুস্তরিক দ্যোতনা। 'অলঙ্কার যে মাসে পড়ে,/ মিলনেতে আড়াল করে,/ তোমার কথা ঢাকে যে তার/ মুথর ঝঙ্কার।' এইসব অনুভব নিতান্ত একলা ব্যক্তির অনুভব। ইংরেজি তর্জমায় রবীন্দ্রনাথ চমৎকার বুঝিয়েছেন এই মুহূর্তটির কম্পমান দ্যুতি। 'Ornaments would our union; they would come between thee and me; there jingling would drown thy whispers.' এই যে ' thy whispers' - রহস্যময় অর্ধস্ফুট প্লুতস্বর, একে শুনতে হলে তো একাকিত্ব প্রয়োজন! এই পথ ধরেই আমাদের মনে পড়বে, মেঘের পরে জমা মেঘ এবং দ্বারে একা বসে বাদলবেলার অপেক্ষার কথা, গভীর রাতের জাগায় রং লাগার প্রসঙ্গ, কিংবা, বিজন ঘরে নিশীথরাতে একলা থাকার অনুভব। আরও কত গান!
আরও পড়ুন- কলকাতা শহরের ‘পাগল’-রা সব গেল কোথায়?
এখানেই আবার খানিকটা ভিন্ন মাত্রা নিয়ে আবির্ভূত হয় 'একলা চলো রে' গানটি। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের কালপর্বে গানটি লেখা হয়েছিল। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, গানটিকে সংকলিত করা হয়েছে 'স্বদেশ' পর্যায়ে। 'ভাণ্ডার' পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় 'একা' শিরোনামে প্রথমে গানটি প্রকাশিত হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধির প্রিয় এই গানটি কি আন্দোলনের এবং প্রতিবাদের প্রশ্নে 'একলা' মানুষের প্রত্যয়কে চিহ্নিত করতে চায়? যদি সেভাবেই গানটিকে পড়ি, তাহলে নিশ্চিতভাবে একথা বলতে হবে, এ আরেকধরনের 'একা' মানুষের সন্ধান। আবার, গানের সংকলন 'বাউল' -এ ওই গানটির অন্তর্ভুক্তি গৌণ তথা প্রান্তিক ধর্মগোষ্ঠীর সঙ্গে একধরনের কথোপকথনও তুলে ধরে। মোট কথা, এ গানে একক মানুষ আর সমাজ মানুষের দ্বিমুখী সংকট এবং পরিত্রাণের ইশারা লক্ষ করি। এখানেই কিন্তু ক্ষমতা, সমাজমানস, স্বীকৃত ভাবধারা, ব্যক্তিমানুষ, ব্যতিক্রম এবং বিধি উলঙ্ঘনের নানা প্রশ্ন ঢুকে পড়তে থাকে। একলা মানুষের আধ্যাত্মিক সন্ধানের সীমারেখা ভেদ করে অন্য সব অবয়ব মূর্ত হয়ে ওঠে।
মান্য চিন্তক সুবীর চক্রবর্তী তাঁর 'সে আগুন ছড়িয়ে গেল' শীর্ষক প্রবন্ধে এই গানকে ঘিরে এক ধরনের 'রাজনৈতিক' বিতর্কের ইতিহাস উন্মোচন করেছেন। সে ইতিহাস হলো সমাজ আন্দোলনকে এই 'একলা' মানুষের ভূমিকা এবং ব্যাখ্যা নিয়ে। সুবীর চক্রবর্তী জানাচ্ছেন, স্বদেশিদীক্ষার আর দেশপ্রেমের প্রসঙ্গে এই গান নিয়ে তাত্ত্বিক-রাজনৈতিক সমস্যায় পড়েছিলেন স্বনামধন্য হেমাঙ্গ বিশ্বাস। হেমাঙ্গ বিশ্বাস ভেবেছিলেন, 'যিনি সত্যের পূজারি তাঁকে সত্যের সপক্ষে বহু সময়ই একলা দাঁড়াতে হয়, বহুবার তাঁকে পরাণ খুলে মনের কথা একলাই বলতে হয়।' কিন্তু তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪২-৪৩ নাগাদ গানটিকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করে এবং গানটি গাইবার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করে। হেমাঙ্গ বিশ্বাস জানাচ্ছেন, জনৈক নেতার বক্তব্য - 'আমাদের কর্মপন্থা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আমরা জনগণকে নিয়ে চলতে চাই। যদি কেউ না আসে এরকম ব্যাপার ঘটলে বুঝতে হবে আমাদের ভুল হচ্ছে এবং ভুলটি হচ্ছে আপনাদের নীতিতে নয়তো আমাদের কর্মপন্থাতে।' এইসব সাংঘাতিক অজ্ঞতার সঙ্গে প্রতি দশকেই মোকাবিলা করতে হয় সাংস্কৃতিক চিন্তাবিদদের। হেমাঙ্গ বিশ্বাসও সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তিনি চিন সফরে গিয়ে ইউনান শহরের তখনকার সাংস্কৃতিক ব্যুরোর সভাপতিকে গানের তর্জমা শোনান। সেই 'কমিউনিস্ট' প্রবর জানান, 'যুগে যুগে যারাই সত্যের সপক্ষে দাঁড়াচ্ছেন, তাঁদের কি সময় সময় একাকী দাঁড়াতে হয় না? সেদিক থেকে তো মনে হয় গানটি ঠিকই আছে।' এই তাচ্ছিল্য এবং বাতিলকরণ, বনাম উচ্চতর নেতার শংসাপত্র দাখিল, পুরো প্রক্রিয়াটাই অবশ্য বেশ সারবত্তাহীন লাগে। একলা মানুষ আর সঙ্ঘবদ্ধ মানুষকে পুরো বিচ্ছিন্ন করে দেখা প্রকৃতপক্ষে মানুষের আংশিক পরিচয় নিয়ে কাটাছেঁড়ার সামিল।
শহর-গ্রামের ভেদ-অভেদ নয়, কিছু নিঃসঙ্গতার মুখোমুখি আমাদের হতেই হবে।