বাঙালির দুর্গাপুজোর ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান ধরা রইল 'ইন দ্য নেম অফ গডেস'-এ
Book Review: তপতী গুহঠাকুরতার 'ইন দ্য নেম অব দ্য গডেস' দুর্গাপুজোর ইতিহাসের আকর।
ইউনেসকো-র স্বীকৃতি পাওয়ার পর এই প্রথম পুজো বাঙালির। তার ওপর অতিমারীর প্রকোপ নেই। কাজেই এবারের পুজো একটু বিশেষ বাঙালির কাছে। কিন্তু বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি পাওয়ার নেপথ্যে অবদান কার? এতদিনে অনেকেই জেনে গিয়েছেন তপতী গুহঠাকুরতার কাজটির কথা। মঞ্চে তাঁকে সম্মানিত করেছে রাজ্য। 'ইন দ্য নেম অব দ্য গডেস্' বইটির শুরু কিন্তু একটা নন-অ্যাকাডেমিক কাজ হিসেবেই। কিন্তু ধীরে ধীরে কীভাবে এই বিরাট বইয়ের ইটগুলি গাঁথা হলো, তা নিজেই একটা কাহিনি। সেই কাহিনির খোঁজ পেতে হলে পাঠককে পড়ে দেখতে হবে বইয়ের প্রাগকথন। বইটিতে ভূমিকা-সহ মোট ন'টি অধ্যায়। অধ্যায় বিভাগের মাধ্যমে সুচারুভাবে দুর্গাপুজোর বিভিন্ন দিকে আলোকপাত করেছেন লেখিকা।
ভূমিকা মূলত বইটির অবতারণা কী কারণে, তাই নিয়ে কিছু কথা। 'দ্য পাস্ট ইন দ্য প্রেজেন্ট' বলছে পুরাণের গল্প, দেবতাদের পরিচয়, যা বাঙালির মুখে মুখে ফেরে। কীভাবে এর সঙ্গে একাত্ম হন মানুষ, দেবীপক্ষ কী- ইত্যাদি নানা আলাপ-পরিচয়। "দ্য থ্রাস্ট অব দ্য 'নন-রিলিজিয়াস'" অংশটিতে রয়েছে 'ঠাকুর দেখা' উৎসবের কথা। ধর্মীয় কথকতা বাদে যে উদযাপনের ছোঁয়া আমরা এই ছোট ছোট ঘোরাঘুরিতে দেখতে পাই, তা থেকে শুরু করে বিজ্ঞাপন-বিপণনের মধ্য দিয়ে পুজোর প্রসার নিয়ে কথা রয়েছে সেই অধ্যায়ে। নতুন সহস্রাব্দ সঙ্গে করে এনেছিল থিমপুজো। এখন তা পুজোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, তাই নিয়ে দ্য স্কোপ অব মাইক্রোহিস্ট্রি। "ডিফাইনিং দ্য টার্ম 'পূজা' অ্যান্ড সিচুয়েটিং ইটস 'আর্ট'"-এ রয়েছে বিভিন্ন পাড়া, ক্লাব কীভাবে পুজো ব্যাপারটাকে উপস্থাপিত করছে, তার সঙ্গে কী কী জড়িয়ে যাচ্ছে- তা নিয়ে আলোচনা। 'এ টাইম ফর এন্ডিং' বাম আমলের শেষ ও 'দিদির কলকাতা'-র নানা ওলটপালট পুজোতে কী কী ছাপ ফেলে যাচ্ছে, তার একটা সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে ধরছে আমাদের সামনে।
'সিটি অফ দ্য ফেস্টিভ্যাল' দ্বিতীয় অধ্যায়ের নাম। 'এক্সপ্যানশন ইন দ্য টাইম অ্যান্ড স্কেল'-এ লেখিকা দেখাচ্ছেন, কীভাবে শহরের বুকে বহুদিন ধরে উদযাপিত হয়ে আসা এক উৎসব ফি বছর পাল্টে যাচ্ছে, যেন আরও বৃহত্তর উৎসবের আকার তাকে দেওয়া হচ্ছে অহরহ। বর্তমানের প্রায় ৪০০০ ক্লাব এবং প্রোডাকশন ইউনিটের দুর্গাপুজো গড়ে উঠেছে কেবলমাত্র কলকাতাতেই। 'ট্রান্সফিগারেশন অফ স্পেস'-এ দেখানো হচ্ছে বিজ্ঞাপন থেকে প্যান্ডেল, বৃহৎ পুজো থেকে কানাগলি, যাবতীয় স্থানে কীভাবে উৎসব নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। হেটেরোটপিয়াস অ্যান্ড টাইম ট্রাভেল, এর মূল প্রতিপাদ্য কীভাবে প্রাগৈতিহাসিক থেকে বর্তমান সময়কে নিজের শরীরে অবলীলায় ধারণ করে নেয় পুজো, দেশ-কাল-পাত্র কোনও কিছুই তেমন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। 'পূজা কার্টোগ্রাফি' আলোচনা করে শহরের প্রধান প্রধান পুজোগুলি নিয়ে যে ম্যাপ প্রকাশিত হয় প্রতি বছর, তারই সম্বন্ধে। 'প্যান্ডাল হপিং অ্যান্ড মাস স্পেক্টেটরশিপ' বর্ণনা করে মূলত ভিড় কীভাবে হেঁটে প্যান্ডেল পরিক্রমা করে, তাতে কী কী সুবিধা-অসুবিধা, কীভাবে প্যান্ডেল গড়ে ওঠে নানা বৈশিষ্ট্যকে নিয়ে, যা দর্শনে এই 'মানুষের ঢল'।
আরও পড়ুন: বিসর্জনের পর শূন্য বেদির বিষাদ, পুজোর সঙ্গে বাঙালির আবেগ এইভাবেই মিশে আছে এখনও
'দ্য মেকিং অফ এ নিউ সিভিক ইভেন্ট' তৃতীয় অধ্যায়। মূলত পুজো কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়, কী কী ঐতিহ্য এখনও বহন করে আসছে দুর্গাপুজো, কীভাবে কিছু বনেদিবাড়ির পুজো থেকে তা সর্বজনীন হলো, সাধারণ মানুষের দুর্গাপুজোয় অংশগ্রহণের ফলে ভদ্রবিত্তর কী কী অসুবিধা হতে শুরু করল, তা নিয়ে কেমন ঝামেলা হয়ে আসছে— এইসব বিষয় নিয়েই এই অধ্যায়ের কাজ। চতুর্থ ও পঞ্চম অধ্যায়ে বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির কাজ তথা শিল্পভাবনা কীভাবে দুর্গাপুজোকে প্রভাবিত করেছে, উৎসবে প্রতিমা ও প্যান্ডেলের উৎকর্ষর ভিত্তিতে চালু পুরস্কারের রীতিনীতি, কুমোরটুলির ইতিহাস, মৃৎশিল্পীদের নিয়ে দীর্ঘ চর্চা, প্যান্ডেলের নানান বিশেষত্ব এবং ইতিহাস নিয়ে চর্চা রয়েছে। বিশেষত 'প্যান্ডেল' শব্দটি কীভাবে মণ্ডপের জায়গা দখল করে নিল, তাও দাক্ষিণাত্য থেকে এসে— সেই ইতিহাস সত্যিই চমৎকৃত করে। কিন্তু এই অধ্যায়েই রয়েছে একটি অত্যন্ত বাজে ধরনের ভুল। হাই কোর্টের সামনে ক্ষুদিরামের মূর্তি তাপস দত্তর হাতে তৈরি, রামকিঙ্কর সে মূর্তি দেখে খুশি হয়েছিলেন— এমন কথাও শোনা যায়। সেই মূর্তির ছবি দিয়ে ঠিকানা দিয়ে শিল্পীর নাম রমেশ পাল লেখা হয়েছে। এমন বড় মাপের ভুল এই ধরনের গবেষণামূলক গ্রন্থে, যা কিনা বিদেশেও সমাদর পেয়েছে, সেখানে আশা করা যায় না। গোটা অধ্যায়ের মাহাত্ম্য এই জায়গাটিতে একেবারে ম্লান হয়ে গিয়েছে। অথচ এই অধ্যায় দু'টি বইটির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বললেও বোধকরি ভুল বলা হবে না।
এই অধ্যায়ের শেষেই থিমপুজোর প্রসঙ্গ এসে গিয়েছে, যা পরবর্তী অধ্যায়ে গিয়ে আরও বিশদে আলোচিত। অধ্যায়ের নাম 'দ্য এজ অব দ্য থিম পূজা'। দশ বছরের অভিজ্ঞতা এবং আর্কাইভাল কাজ, সংরক্ষিত ও ব্যবহৃত ছবি এই বইটির সম্পদ। এর পরের অধ্যায় কীভাবে দুর্গাপুজোয় বিভিন্নরকম শিল্প ব্যবহৃত হয়। ধাতব বিগ্রহর পাশাপাশি মাটির হাঁড়ি দিয়ে গণেশমূর্তি, রামকিঙ্করের 'সাঁওতাল পরিবার'-এর চিন্তার আধারে বিগ্রহ, বাসন দিয়ে তৈরি বিগ্রহ, শহরের বাইরে প্রকৃতির কোলে হওয়া পুজো, তার চারুশিল্প, সনাতন দিন্দা, ভবতোষ ছুতার, সুশান্ত পাল— এই সমস্তটা নিয়ে আলোচনা করে এই অধ্যায়। শেষের আগের অধ্যায়টিতে আলোচিত হয়েছে, শহরের আশপাশে কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে দুর্গাপুজোর ইতিহাস, এবং পুজোর শহরে হেঁটে যাওয়ার অভিজ্ঞতা। কীভাবে শহর খোদ একটি বুনন হয়ে উঠছে, যাকে পাঠ করা সম্ভব। এবং শেষ অধ্যায়। কীভাবে এই বিস্তীর্ণ কাজ, বছরের পর বছর যার কোনও সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না, শুধুমাত্র ছবি ছাড়া বাজারের তাগিদ ধুয়েমুছে সাফ করে দেয় যাবতীয় অতীত, যাবতীয় শিল্প, যাবতীয় শ্রম। মাত্র চারদিন এই স্বাদের ভাগ নেওয়ার জন্য বরাদ্দ। কাজের এই সংরক্ষণ না করার মানসিকতাকে সমালোচনা করছেন লেখক। বইটি শেষ হচ্ছে এক নতুন আশার আলো দিয়ে, এই সাংস্কৃতিক প্রাচুর্য কি চিরকালীন করে তুলতে পারবে কোনও দিন বাঙালি? এই প্রশ্ন রেখে দুর্গাপুজোর আয়োজনের মতোই বিপুল এই কাজটিকে শেষ করছেন তপতী গুহঠাকুরতা।