মেট্রোর কাজেই খাল কেটে কুমির আনা? বউবাজারের আতঙ্কের নেপথ্যে এক হারিয়ে যাওয়া নদী
বউবাজারের মাটি ধসে যাওয়ার সূত্রে এবার কলকাতার মাটির নিচের আদিম মানচিত্রও গা-ঝাড়া দিচ্ছে। শহরের তলায় আজও লুকনো পলি আর জলখাত।
আতঙ্কে বউবাজার। এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে বাসিন্দাদের ঠাঁই নিতে হয়েছে হোটেলে। কবে তাঁরা আবার ঘরে ফিরতে পারবেন, জানেন না কেউ। মেট্রোর কাজে বাড়িতে ফাটল ধরা কাণ্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটল। আড়াই বছর পর নতুন করে বউবাজার এলাকার একাধিক বাড়িতে ফাটল ধরেছে। দুর্গা পিতুরি লেনের ১০টির বেশি বাড়িতে নতুন করে দেখা দিয়েছে ফাটল। ঠাঁইনাড়া প্রায় ২৮টি পরিবার। বউবাজারে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ চলছে।
পুলিশের নির্দেশে তড়িঘড়ি বাড়ি ছেড়ে এক কাপড়ে বেরিয়ে এসেছেন আবাসিকরা। রাতের বেলায় এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবেন, কেউ বুঝতে পারছিলেন না। ফিরেছে ২০১৯-এর স্মৃতি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, শুধু বাড়ির দেওয়াল, মেঝেই নয়, ফাটল ধরেছে রাস্তাতেও। আতঙ্কে রাস্তায় গোটা এলাকার বাসিন্দারা। সেবার প্রায় তিন মাস হোটেলের ঘরে কাটাতে হয়েছিল। এবার কত দিন? মেট্রোর কারণে বাড়িতে ফাটলে যাঁদের ঘর ছাড়তে হয়েছে, তাঁদের সবারই একই প্রশ্ন, ''কত দিন থাকতে হবে হোটেলে?'' সেই প্রশ্নের উত্তর আপাতত মেট্রো কর্তাদের কাছেও নেই। এই বিপর্যয়ের নাম শুধু মেট্রো নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কলকাতার ইতিহাস, ভূগোল। বউবাজারের মাটি ধসে যাওয়ার সূত্রে এবার কলকাতার মাটির নিচের আদিম মানচিত্রও গা-ঝাড়া দিচ্ছে। শহরের তলায় আজও লুকনো পলি আর জলখাত।
মরমিয়া কবি বলেছিলেন, 'লোকে বলে বলে রে, ঘর-বাড়ি ভালা নাই আমার’। বউবাজারের অভিশপ্ত গলির ঘরছাড়া বাসিন্দারা তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর সুড়ঙ্গ বিপর্যয় তবু সময় দিয়েছিল মৃত্যুগুহা থেকে বেরোনোর। কলকাতার মাটির তলার দৈত্যের নড়াচড়া ইডেন গার্ডেন্সের ভরা স্টেডিয়াম বা পার্ক স্ট্রিটের নিশ্চিন্ত নৈশভোজের ছন্দও নিমেষে টালমাটাল করতে পারে। ইতিহাসবিদ থেকে প্রত্নতত্ত্ববিদরা এই সেদিন পর্যন্ত কলকাতার অতীতের সীমানা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে বাঁধতে চেয়েছেন। ইংরেজ আমল, বড়জোর তার আগের জমিদারি-পর্ব— এর মধ্যেই যেন আটকে শহরটার অস্তিত্ব। বউবাজারের ট্র্যাজেডির কারণ বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে। শহরের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে ভূগোল আঁতকে তুলছে শহরবাসীকে।
আরও পড়ুন: আগামী দু’বছরে কলকাতার চেহারা বদলে দেবে ই-বাস?
গঙ্গার ব-দ্বীপ অঞ্চলের ভূখণ্ড যে কতবার ডুব দিয়েছে আর ভেসে উঠেছে, তার ইয়ত্তা নেই। পৌনে তিন শতক আগেও জলজ্যান্ত গঙ্গার একটি খাঁড়ির গল্প ফের জেগে উঠছে। চাঁদপাল ঘাট থেকে হেস্টিংস স্ট্রিট (আজকের কিরণশঙ্কর রায় রোড), ওয়াটারলু স্ট্রিট, বেন্টিঙ্ক স্ট্রিট, প্রিন্সেপ স্ট্রিট হয়ে ধর্মতলার উত্তর ছুঁয়ে ক্রিক রো বেয়ে সল্টলেক-অভিমুখী ছিল সেই খাল। যা পরে বিদ্যাধরীতে মিশে যায়। বিদ্যাধরীও এখন মজে গিয়েছে। একমাত্র বেলেঘাটা খাল সেই স্রোতের অংশ। ইতিহাসবিদেরা অনেকেই একমত নন, তবে কলকাতার রাজপথের খুঁটিনাটির ইতিহাসকার পরমেশ্বরন থনকপ্পন নায়ারের মত, এই ‘খাল কাটা’ থেকেই কলকাতা নামকরণ। ১৭৩৭ সালের এক ভয়াল ভূমিকম্প ও ঘূর্ণিঝড় সেই খালের বড় অংশ প্রায় বুজিয়ে ছাড়ে। সন্দেহ, মেট্রোর সুড়ঙ্গ কলকাতার পাতালঘরে সেই সুপ্ত নদীখাতকেই জাগিয়ে তুলেছে। ভূমিকম্পবিদরা বলেন, শুধু এক জায়গায় নয়, কলকাতার বুকের তলার আদিম জলের ভাঁড়ার কোনও জোরালো অভিঘাতে জ্যান্ত হয়ে অন্যত্রও পায়ের তলার মাটি সরাতে পারে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, মূলত পণ্য পরিবহণের জন্য ওই খালের ধারে গড়ে উঠেছিল মৎস্যজীবীদের পল্লিও। সেই জায়গা এখনও জেলেপাড়া নামে পরিচিত। আবার কোনও কোনও ইতিহাসবিদ বলেছেন, ওই ক্রিক বা খাল দিয়ে অতীতে ক্রীতদাস পাচারের ব্যবসাও চলত।
ইতিহাস বলছে, এই শহরের প্রথম ভিনদেশি অতিথি ইংরেজ নয়। তার আগেও বাংলা ছিল মগ, পর্তুগিজদের দখলে। যদিও সুষ্ঠু বাণিজ্য তো নয়ই, নবাবি আমলে দস্যুবৃত্তি ছাড়া অন্য কোনও দিকে ভিনদেশীরা মনোনিবেশ করেনি আগাগোড়াই। গঙ্গা ও তৎসংলগ্ন জলাভূমি ছিল তাদের বিস্তীর্ণ মুক্তাঞ্চল। কলকাতার এই হারিয়ে যাওয়া খালও ছিল তাদের মুক্ত বিচরণভূমি। শোনা যায়, একসময় ক্রীতদাস আমদানি-রপ্তানির একটা প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছিল খালটি। পাড় ঘেঁষে জেলে প্রজাতির মানুষের বসতি আর বিক্ষিপ্ত বাড়িঘর ছাড়া পুরো অঞ্চলটিই ছিল গভীর জঙ্গল। এরপরই শহরে এল বেনিয়া ইংরেজ। পলাশির যুদ্ধ জিতে জঙ্গল কেটে কলকাতার রূপ পরিবর্তনে হাত লাগাল তারা। হাজার হোক, এ তাদের নিজের হাতে তৈরি করা শহর। ধীরে ধীরে পাল্টাতে শুরু করল বাঙালির প্রাণের কলকাতা।
১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর দক্ষিণবঙ্গে এক প্রবল ঘূর্ণিঝড় হয়েছিল। ওই ঝড়ে কলকাতারও খুব ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। প্রবল ঝড়ে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়েছিল ইংরেজদের নতুন কাঁচা ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ, সেন্ট অ্যান'স চার্চ, এমনকী, ব্ল্যাক-জমিদার গোবিন্দরাম মিত্রর প্রতিষ্ঠিত নবরত্ন মন্দির, চিত্তেশ্বরী কালী মন্দির (যার নামে আজকের চিৎপুর)। ডুবে গিয়েছিল কোম্পানির বেশ কয়েকটি বড় বাণিজ্য-জাহাজ। ভেঙে গিয়েছিল প্রায় সমস্ত কাঁচা বাড়ি। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহ আর ভগ্নাবশেষের মাঝখানে একরকম শ্মশানে পরিণত হয়েছিল কলকাতা। এখনও তালতলার ক্রিক রো বা ডিঙিভাঙা লেন এই ঝড়ের রাতে এক নৌকোডুবির বিধ্বংসী স্মৃতিটুকু ধরে রেখেছে বুকে করে। আজকের উল্টোডাঙা নামের সঙ্গেও মিশে আছে সেই খালে নৌকোডুবির ইতিহাস। অর্থাৎ, আজকের কলকাতার অঞ্চলভিত্তিক নামগুলোই জানান দেয় সেই যুগের সেই হারিয়ে যাওয়া খালের গতিপথ। সেই সময়ে ঝড়ের পরে এই খালে অনেক ডিঙি নৌকো ভেঙে পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছিল বলে লোকমুখে এলাকাটা ‘ডিঙিভাঙা’ নামে পরিচিত হয়।
কিন্তু আজ কোথায় গেল সেই খাল? নিজেদের সুবিধামতো বারবার শহরের খোলনলচে বদলে ফেলেছে ইংরেজ কোম্পানি। তাই সেই প্রবল ঝড়ের পরে মজে যাওয়া খালও বুজিয়ে ফেলা হয়েছে ধীরে ধীরে। বদলেছে গঙ্গারও গতিপ্রকৃতিও। কিন্তু আজ আর খাল না থাকলেও রয়ে গেছে ক্রিক রো বা ডিঙিভাঙা লেন অথবা উল্টোডাঙার মতো জায়গার নামগুলো।
ইতিহাসবিদদের মতে, যে খাঁড়ি বা খাল বুজিয়ে আজকের ক্রিক রো-এর জন্ম, সেই খালই আদপে ‘গাঙুর’। যে জলপথ বেয়ে লখিন্দরের নিথর দেহ নিয়ে এগিয়েছিল বেহুলার ডিঙি। আবার কলকাতার চালু মেট্রো রেলের লাইনের নিচে গড়িয়া-বৈষ্ণবঘাটা লাগোয়া আদিগঙ্গার খালকেও বেহুলার ভেসে চলার গাঙুর বলে মনে করেন অনেকেই।
বউবাজারে হিদারাম ব্যানার্জির গলি দিয়ে দুর্গা পিতুরি লেনের ভেতরদিকে দাঁড়ালে এখনও অদূরে গ্রাউটিংয়ের কাজের শব্দ। ধ্বংসস্তূপের গা ঘেঁষেই দুর্গা পিতুরির দালানে এখন দুর্গাপুজোর তোড়জোড় মতিলালদের। লোককথা থেকে শুরু করে এত পুরনো মানচিত্রের ছড়াছড়ি, তবু বউবাজারের সুড়ঙ্গ খোঁড়ার সময় খালটাকে কেউ খেয়ালই করল না? কলকাতার ইতিহাস গৌরবের, অহংকারের, আর এর মধ্যেই লুকিয়ে এক খালের ভেতর দিয়ে রসাতলে ভেসে যাওয়ার ইতিহাস। আজ বউবাজার বিপর্যস্ত, গোটা কলকাতা কিন্তু নিশ্চিন্তে নিশিযাপন করতে পারে না। কারণ মেট্রো গর্ব, না খাল কেটে কুমির আনা- এই প্রশ্নই এখন তাড়া করছে।