১৫ বছর আত্মগোপন! পাকিস্তানকে দিশা দেখাচ্ছেন প্রথম রূপান্তরকামী চিকিৎসক

Pakistan's First Transgender Doctor: রূপান্তরকামীদের সমান শিক্ষা এবং সুযোগের অধিকারের লক্ষ্যে লড়ছেন সারাহ।

স্টিরিওটাইপ ভাঙা সহজ নয়, কোনও কালেই নয়। স্থান-কাল ভেদে জগদ্দল ধারণাদের সরিয়ে বিশ্বমাঝে স্থান করে নেওয়ার ইচ্ছা হাহাকার হয়ে ধাক্কা খায়। বিশেষ করে 'অন্য'দের কাছে। সামাজিকভাবে যারা নির্দিষ্ট বাঁধনে, নির্দিষ্ট খোপে পড়েন না, সমাজ সেই অন্যদের বাতিল করে সরিয়ে রাখতে পারলেই বাঁচে। তাতে প্রশ্ন এড়ানো যায়, যুক্তি খুঁজে কালঘাম ছোটানোর পরিশ্রম করতে হয় না। এই 'অন্য' হয়ে ওঠা আবার সামাজিক শ্রেণিভেদে বদলে যায়, দেশ ভেদে, ধর্মভেদে, সামাজিক অবস্থানভেদে বদলে যায়। তবে লড়াইয়ের বদল হয় না, নিজের সঙ্গে, সমাজের সঙ্গে এক নিরন্তর লড়াই। দীর্ঘ দীর্ঘ বছর নিজের পরিচয় লুকিয়ে বাঁচতে বাঁচতে যেমন লড়েছেন সারাহ গিল। পাকিস্তানের প্রথম রূপান্তরকামী চিকিৎসক!

স্কুলে পড়াকালীন অবশ্য সকলেই জানতেন সারাহ একজন ছেলে। নিজের বাস্তব পরিচয়, নিজের মেয়ে হয়ে ওঠার আকাঙ্খা চেপে রেখে নিজেকে ছেলে হিসাবেই পরিচয় দিতে হয়েছিল সারাহকে। আসল পরিচয় গ্রহণ করলে ঠিক কী হতে পারে সেই আশঙ্কা গিলে খেয়েছিল সারাহর পরিবারকে। "সমাজ কী বলবে" প্রশ্নের গুঁতো থেকে মুক্তি পেতে লেগেছে কয়েক দশক! "আমার বাবা-মা ট্রান্সজেন্ডার হিসাবে আমার পরিচয় গোপন করতে চেয়েছিলেন," সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন সারা। সমাজের চাপ তো বটেই, পরিবারের অন্দরে চলা কানাঘুঁষো এবং ব্যাপক সামাজিক অস্বীকৃতির আশঙ্কায় পুরুষ হয়েই বড় হচ্ছিলেন সারা।

আরও পড়ুন- সংবিধানই অস্ত্র! লক্ষ লক্ষ মানুষকে পথ দেখাচ্ছেন কেরলের প্রথম রূপান্তরকামী আইনজীবী!

“আমার মনে আছে আমার মা যখন চিকিৎসকের কাছ থেকে জানতে পারলেন যে আমি একজন ট্রান্সজেন্ডার মানুষ, অনেক কেঁদেছিলেন। ওটাই আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। কিন্তু ডাক্তারের সেই অনুমোদনই আমাকে আমার পরিবারের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে,” বলেছেন চিকিৎসক ও সমাজকর্মী সারাহ।

Sarah Gill Pakistan’s first transgender doctor

ছেলে হিসাবে নিজের পরিচয় ত্যাগ করা কঠিন কাজ ছিল। ১৪ বছর বয়সে করাচিতে তাঁর পরিবার এবং বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল সারাহকে। যা হওয়ার তাই হলো! বাড়ি সমর্থন না থাকা রূপান্তরকামীরা যে যে সমস্যায় পড়েন, পড়লেন সারাহও। পরবর্তী বছরগুলিতে দেশের আরও অনেক ট্রান্সজেন্ডারদের মতোই কঠোর বাস্তবতা এবং চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লেন সারাহ।

পিএএফ স্কুল এবং বাহরিয়া কলেজে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে, করাচির জিন্নাহ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পড়লেন সারাহ গিল। এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জনের পরই সারাহ তাঁর এই অর্জনকে তাঁর সম্প্রদায় এবং অন্য সবাইকেই, যাদের কাছ থেকে সম্মান, প্রশংসা এবং ভালোবাসা পেয়েছেন, উৎসর্গ করেন। নিজের সাফল্যকে কেবল নিজের লড়াই বা অর্জন নয়, পাকিস্তানের রক্ষণশীলতার গর্ভে বেড়ে ওঠা সমস্ত রূপান্তকামীদের সাফল্য হিসেবেই দেখেন তিনি।

আরও পড়ুন- রূপান্তরকামী সন্তানকে নিয়ে গর্বিত বাবা, ভারতীয় অভিভাবকরা শিখবেন?

সারাহ ট্রান্সজেন্ডার শিশুদের অভিভাবকদের অনুরোধ করেন, প্রথম থেকেই শিশুদের সমর্থন জোগানোর জন্য যাতে বাচ্চারা হেনস্থা, বৈষম্য, উদ্বেগ, হতাশা, আত্মহত্যার চিন্তা বা অবৈধ-অনৈতিক কাজেকর্মে জড়িয়ে না পড়ে।

পাকিস্তানে রূপান্তরকামীদের অধিকার ও কল্যাণের জন্য কাজ করার সময় ট্রান্স সম্প্রদায়ের কাছ থেকে মেলা উৎসাহের বশেই সারাহ গিল পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন। সারাহ বলছেন, “ট্রান্সজেন্ডার সম্প্রদায় ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। ভিক্ষা নয়, শিক্ষা ও সম্মানজনক চাকরি পাওয়ার দিকে বেশি আগ্রহী হয়েছেন তারা। কিন্তু সমাজের মনোভাবও বদলাতে হবে।" সারাহর বিশ্বাস, তিনি প্রথম রূপান্তরকামী চিকিৎসক হতে পারেন কিন্তু দেশের শেষ ট্রান্সজেন্ডার ডাক্তার হবেন না। তাঁর লড়াই ও সাফল্য শুরুর প্রথম ধাপ মাত্র। পাকিস্তানে আরও অনেক সারাহ শিক্ষায়, কাজে এগিয়ে আসবেন বলে বিশ্বাদ করেন তিনি। আর তার জন্য লড়তে হবে।

রূপান্তরকামীদের সমান শিক্ষা এবং সুযোগের অধিকারের লক্ষ্যে লড়ছেন সারাহ। এন্ডোক্রিনোলজিতে (হরমোন বিষয়ে) কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস ফেলোশিপের লক্ষ্যে এগোচ্ছেন তিনি যাতে দেশের চিকিৎসা পাঠ্যক্রমে রূপান্তরকামীদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

More Articles