নবপ্রজন্মের রাজনীতিকদের কাছে এক ধ্রুবতারার নাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য
Buddhadeb Bhattacharjee: একজন মানুষ যে বিভিন্ন ধরনের কাজে একই সঙ্গে পারদর্শী হতে পারেন, একজন ভালো প্রশাসক, ভালো রাজনীতিবিদের যে একটা দুর্দান্ত মননের জায়গা থাকতে পারে, তার মস্ত প্রমাণ ছিলেন তিনি।
তখন আমি বেশ ছোট। একটি গল্প বলা- প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার হিসেবে হাতে এসেছিল একটি বই। গ্যাব্রিয়াল গার্সিয়া মার্কেসের লেখা একটি বইয়ের অনুবাদ। 'বিপন্ন জাহাজের এক নাবিকের গল্প'। ভাষান্তর: বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সমুদ্রের মধ্যে হারিয়ে যাওয়া এক নাবিকের ওই যে লাগাতার লড়াই, তাঁর দিন-রাত্রি, তাঁর আশা, ভয়ঙ্কর নৈরাশ্য থেকে জয়ের পথে যে অভিযান, তা আমাকে ওই বয়সেই দারুণ ভাবে রোমাঞ্চিত করেছিল। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয়। রাজনীতিক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তো অনেক পরে, সেই বয়স থেকেই সাহিত্যিক, লেখক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমি অনুরাগী।
আরও পরে একবার ওঁর মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ হয়েছিল। সে গল্প অবশ্য বেশ মজার। সম্ভবত ২০০০- ২০০১ সালের কথা হবে। তখন যে আমি বড় হয়ে গিয়েছে তা বলা যায় না। স্কুলে পড়ি। সে সময় বাংলা অ্যাকাডেমিতে শিশু-সাহিত্য উৎসব হত। আবৃত্তি করতাম বরাবর। তার দৌলতেই অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া। তো মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এসেছেন অনুষ্ঠানে। আমার ঘাড়ে দায়িত্ব পড়ল তাঁকে ব্যাজ পরানোর। আমি চিরকালই এসব কাজে অপটু। সেই অপটু হাতে ততক্ষণে এসে পড়েছে ব্যাজ আর সেফটিপিন এবং আমি পৌঁছেও গিয়েছি মঞ্চে। দু-তিনবার সেফটিপিন ফোটানোর পরেও দক্ষতার সঙ্গে অসফল হই ব্যাজ পরাতে। বুঝতে পেরে আদর করে তিনি বললেন, "ঠিক আছে দাও, আমিই পরে নিই। তোমাকে আর আমাকে কষ্ট দিতে হবে না।" ওঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ, প্রথম আলাপ বলতে ওটাই। পরবর্তীকালে আর কখনও সামনাসামনি দেখা হওয়ার সুযোগ হয়নি তাঁর সঙ্গে। তবে আমার বাড়ির লোকের সঙ্গে পরিচয় ছিল ওঁর। আমার বড়দাদুভাই যখন বিধায়ক, তখন বুদ্ধদেববাবু মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু আমার ওই সেফটিপিন ফোঁটানো আর ব্যাজ না পরানোর ব্যর্থতা ছাড়া তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত স্মৃতি নেই তেমন।
আরও পড়ুন: নিঃশব্দে যে যায় লাল পতাকা মুড়ে… বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যা শিখিয়ে গেলেন বাংলাকে
ওঁকে দেখে রাজনীতিতে আসার ইচ্ছা হয়েছে বললে ভুল বলা হবে। আসলে তেমন ভাবে কাউকে দেখেই যে রাজনীতিতে এসেছি, তা নয়। তবে এটা ঠিক আমাদের বড় হয়ে ওঠা, যখন থেকে নিজের জীবনে একটু আধটু রাজনীতি বুঝতে শিখেছি, তখন থেকেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমাদের জীবনে একটা ধ্রুবতারার মতো। তিনি যখন পার্টিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বা পশ্চিমবঙ্গের সরকারের হাল যখন তাঁর কাঁধে, সে সময়টা কঠিন। একটা পট পরিবর্তন, প্রজন্মের পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে চলেছে সময়টা। বদলে যাচ্ছে সমাজ। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা-চাহিদা, সব কিছুই অনেকখানি বদলে যাচ্ছে। আর সেই সময়কার কান্ডারি হিসেবে হাল ধরেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ওই পরিবর্তিত সময়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে কিছুটা নতুন করে ভাবার চেষ্টা করেছিলেন, তথাকথিত ধ্যানধারণাকে কিছুটা হলেও ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন, তা কিন্তু অস্বীকার করার জায়গা নেই। তাঁর সেই ভাবনা-চিন্তা, পরীক্ষানিরিক্ষা কতটা সফল হয়েছে বা কতটা ব্যর্থ, তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তবে উনি যে একটা উত্তরণের, পরিবর্তনের ভাবনা ভাবতে পেরেছিলেন, সেটা আমার মনে হয় আমাদের প্রজন্মের মানুষদের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।
কোনও জীবনই তো ঠিক-ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। অধিকাংশ মানুষই জীবনে অসংখ্য ভুল করেন। তবে নিজের সিদ্ধান্তগুলোকে পুনর্বিবেচনা করার সাহস ক'জনই বা দেখান জীবনে! বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সেদিক থেকে দেখতে গেলে এক বিরল ও ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। তিনি যা করেছেন, যে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাঁর দায় বা দায়িত্ব কাঁধে নিতে কখনও পিছু হঠেননি। সে ক্ষমা চাওয়াই বলুন আর বা নিজের কাজের সমালোচনা, কখনও সেই জায়গা থেকে চ্যুত হননি তিনি। আমার মনে হয়, এটা ওঁর কাছ থেকে শেখার মতো। একজন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে, একজন নেতা হিসেবে নিজের কাজের, নিজের ঠিক-ভুল পর্যালোচনা করার মতো সাহস আর ক'জনই বা দেখাতে পেরেছেন বলুন তো ওঁর মতো করে! ভুল স্বীকার করার এই যে সাহস, আমার মনে হয় যে কোনও কাজ করার ক্ষেত্রে বা ভুল সংশোধনের রাস্তায় প্রথম পদক্ষেপ। আর সেই জায়গাটা থেকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যে অন্য অনেক কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের থেকে অনেকটা বেশি এগিয়ে ছিলেন, তা অস্বীকার করার জো নেই।
তবে আমাকে যেটা সব সময় অনুপ্রাণীত করেছে, সেটা হল একজন রাজনীতিকের পাশাপাশি খুব উঁচু মাপের সাহিত্যিক ছিলেন বুদ্ধদেববাবু। আগেই বলেছি, রাজনীতিবিদ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আগে আমি সাহিত্যিক, লেখক বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বড় ভক্ত হয়ে পড়ি। একজন মানুষ যে বিভিন্ন ধরনের কাজে একই সঙ্গে পারদর্শী হতে পারেন, একজন ভালো প্রশাসক, ভালো রাজনীতিবিদের যে একটা দুর্দান্ত মননের জায়গা থাকতে পারে, তার মস্ত প্রমাণ ছিলেন তিনি। একজন দুর্দান্ত রাজনীতিক হতে গেলে যে একজন ভালো গায়ক বা আঁকিয়ে বা খেলোয়ার হওয়া যায় না, এই ধারণাকেই কার্যত ভেঙে দিয়েছিলেন মানুষটি। সফল রাজনীতিবিদ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন সফল লেখক, সফল সাহিত্যিক হয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন। সেটা আমার কাছে অবশ্যই ভীষণ প্রেরণার ও ভালোবাসার জায়গা। নিজের কাজের প্রতি, নিজের সৃষ্টিশীলতার প্রতি, ভালোবাসার প্রতি অবিচল থাকার শিক্ষা কার্যত ওঁর থেকেই পেয়েছি ভীষণ ভাবে।
তাঁর চলে যাওয়া আমাদের জন্য একটা শূন্যতা তো বটেই। সত্যি কথা বলতে শেষের দিকে অনেকটাই নিজের মধ্যে গুটিয়ে গিয়েছিলেন বুদ্ধবাবু— দুঃখ-কষ্ট, শারীরিক এবং মানসিক যন্ত্রণা, সবটা মিলিয়েই। তেমন ভাবে কারওর সঙ্গেই মিশতেন না আর। ফলে আমরা যাঁরা রাজনীতিতে নতুন, তাঁদের অনেকেরই ঠিক সেরকম ভাবে তাঁকে পাওয়া হয়ে ওঠেনি আর। তবে বুদ্ধদেববাবুর স্ত্রী মীরা ভট্টাচার্য, তাঁর সঙ্গে প্রায়শই কথা হত আমাদের। তিনি খুব আদরে-স্নেহে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ওঁর মুখেই শোনা, বুদ্ধদেববাবু শেষের দিকে নাকি আমাদের কথা প্রায়ই বলতেন। বিশেষত আমরা তথাকথিত বামপন্থায় যাঁরা নতুন, নতুন প্রজন্ম— তাঁদের বেশ কয়েক জনের কথা শুনতে চাইতেন, তাঁরা কী কাজ করছে জানতে চাইতেন তিনি। অনেকবারই ভেবেছি, ওঁর সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আসব। দল বেঁধে পরিকল্পনাও করেছি। কিন্তু নানা কারণে সেই পরিকল্পনা পরিকল্পনাই থেকে গিয়েছে। ওঁর সঙ্গে আর দেখা হল না। তার আগেই চলে গেলেন মস্ত মানুষটা। আর এটা আমাদের অনেকের কাছেই একটা আক্ষেপের জায়গা তো বটেই। তবু আমাদের প্রতি যে স্নেহ, যে আশা বা ভরসা তিনি আমাদের প্রতি রেখেছিলেন, আমরা যেন তা ভেঙে না ফেলি কখনও। তবু একবার যদি দেখা করে আসা যেত, বড্ড ভালো হত।
আরও পড়ুন:মৃত্যুর পরেও যেন হেঁটে যেতে পারি…
আমার খুব মনে হয়, বুদ্ধদেববাবুকে খুব রাজনৈতিক ভাবে দেখা উচিত আমাদের। নব্বই পরবর্তী সময়ে গোটা সমাজব্যবস্থাতেই তো একটা পরিকাঠামোগত পরিবর্তন হয়েছে। নব্বইয়ের আগে পর্যন্ত বামপন্থি রাজনীতির যে ধারা, সমাজ-রাজনীতির যে ধারা, তা অনেকটাই বদলে গিয়েছে ওই সময়টায়। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিজের মতো করে ভাবার চেষ্টা করেছিলেন। ভয়ঙ্কর গ্লোবালাইজড, নিউ লিবারল ইকোনমির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল যে সমাজটা, যেখানে বেসরকারিকরণ হচ্ছে, নানা রকম পালাবদল হচ্ছে। সেই সময়কার ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন স্বপ্ন, প্রত্যাশা তৈরি হচ্ছে, সেই স্বপ্নগুলোকে বাঁধতে এবং নতুন প্রজন্মের প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে একটা অঙ্গরাজ্য কীভাবে অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং রাজনৈতিক, এই তিন ক্ষেত্রেই দিশা দেখাবে, কীভাবে সেই স্বপ্নগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তার একটা অন্যরকম পথ কিন্তু ভাবার চেষ্টা করেছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তা তিনি কতটা পেরেছিলেন বা পারেননি তা তো ইতিহাস বলবে। কিন্তু সে সময় দাঁড়িয়ে যে একটা প্রস্তরখণ্ডকে ভাঙার চেষ্টা অনবরত করে গিয়েছেন তিনি, তা কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই। আমাদের দায় থাকবে, যাতে উনি ভুল প্রমাণিত না হন, যাতে ওঁর ফেলে যাওয়া পথে এগিয়ে যেতে পারি, সেটুকু নিশ্চিত করার।