প্রযুক্তি-অর্থ-ক্ষমতা, সবেতেই এগিয়ে NASA, তবু কোথায় টেক্কা দিতে পারে ISRO?
Space Research: শুরুর দিকে অবশ্য ISRO নয়, নাম ছিল INCOSPAR অর্থাৎ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ।
সালটা ১৯৪৭, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঠিক দু’বছর পর। ক্রমাগতই বিতর্ক বেড়ে উঠছিল আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে। এই দু’টি দেশই দুই মহাশক্তি হয়ে উঠে এসেছিল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে। আর এই দুই দেশের মধ্যেই রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভেদও পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। যার ফলে দু’ দেশের মধ্যে শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধ বা ‘কোল্ড ওয়ার’। বিশ্বযুদ্ধের ঘা মেখেই এই দুই দেশ নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরির কাজে উঠে পড়ে লাগে। দুই দেশই আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। এটি এমন একটি ক্ষেপণাস্ত্র, যার ব্যবহার হবে নিউক্লিয়ার অস্ত্রকে একটি মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে পৌঁছে দিতে।
সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে আমেরিকা, আবার আমেরিকা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন এই ICBM-কে এতটা দূরত্ব অতিক্রম করতে মহাকাশে রকেট পাঠানোর প্রয়োজন। এমতাবস্থায় কোনও দেশ যদি এমন প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে পারে, যাতে করে মহাকাশে পাড়ি দেওয়া সম্ভব তাহলে সেই দেশ নির্দ্বিধায় পৃথিবীর সব চেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসাবে বিবেচিত হবে। এই সম্ভাবনার আভাস পেয়েই দুই দেশই তেড়েফুঁড়ে শুরু করল মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার প্রায় অভাবনীয় চিন্তাকে বাস্তবের রূপ দিতে।
১৯৫৫ সাল। আমেরিকা ঘোষণা করল, খুব শিগগিরই মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাতে চলেছে তারা। এই ঘোষণার কিছুদিনের মধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নও পালটা ঘোষণা করল তারাও কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠাতে চলছে মহাকাশের বুকে। এই ঘোষণার দু’বছর পর অর্থাৎ ১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমেরিকাকে পিছনে ফেলে নিজেদের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ তৈরি করে ইতিহাসের পাতায় নিজেদের পরিচয় কায়েম করে। এটিই বিশ্বের প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ যার নাম দেওয়া হলো স্পুটনিক। তার ঠিক একমাস বাদেই সোভিয়েত আবারও একটি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাকাশে পাঠায়, যার নাম স্পুটনিক ২। তবে এবার একা উপগ্রহ নয়, তার সঙ্গেই মহাকাশে পাড়ি দেয় ছোট্টো প্রাণও, লাইকা। সারমেয় লাইকা মহাকাশে যাওয়া প্রথম প্রাণী হিসেবে রেকর্ড গড়ে।
আরও পড়ুন- সংস্কৃত শিখে গঙ্গার পুজো করেছিলেন বাংলায় প্রথম মসজিদের নির্মাতা এই তুর্কি সেনাপতি!
ঠিক পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে আমেরিকা নিজের প্রথম স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠায়। যার নাম ছিল ‘এক্সপ্লোরার ১’। এই দুই দেশের মধ্যেই প্রতিযোগিতা এতই চরমে ছিল যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই মহাকাশ বিজ্ঞানের বেশ উন্নতি হয়। ভারতীয় বিজ্ঞানী ড. বিক্রম সারাভাইকে অনুপ্রাণিত করে মহাকাশ বিজ্ঞানের এই প্রযুক্তিগত উন্নতি। বিশেষত স্পুটনিক আবিষ্কার হলে তিনি উপলব্ধি করেন, দেশের উন্নতির জন্য মহাকাশ বিষয়ক গবেষণার আশু প্রয়োজন। ১৯৬২ সালে, শেষমেশ প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুকে এ বিষয়ে রাজিও করিয়ে ফেলেন তিনি। জন্ম নেয় ISRO।
শুরুর দিকে অবশ্য ISRO নয়, নাম ছিল INCOSPAR অর্থাৎ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কমিটি ফর স্পেস রিসার্চ। প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এর সূচনা করেন, যার চেয়ারম্যান হন ড. বিক্রম সারাভাই। প্রথমদিকে স্বাভাবিকভাবেই প্রযুক্তি, পরিকাঠামো এবং সম্পদের অভাবে ভুগতে থাকে ISRO। কিন্তু এত অভাবের মধ্যেও INCOSPAR চালু হওয়ার মাত্র এক বছরের মধ্যে এই সংস্থা মহাকাশে নিজেদের প্রথম রকেট পাঠায়। এর পরে NASA সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় INCOSPAR-এর দিকে। এরপর ১৯৬৭ সালে ২০ নভেম্বর INCOSPAR স্বতন্ত্রভাবে নিজেদের রকেট উৎক্ষেপণ করে, যার নাম ছিল রোহিনী ৭৫। এর পর ১৯৬৯ সালের ১৫ অগাস্ট অর্থাৎ স্বাধীনতার ২২ বছর পর INCOSPAR-এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়ে ISRO।
১৯৭৫ সালে ভারত নিজেদের প্রথম স্যাটেলাইট লঞ্চ করে, যার নাম দেওয়া হয় আর্যভট্ট। যদিও এই বিশেষ মুহূর্তের সাক্ষী হতে পারেননি ড. বিক্রম সারাভাই। তাঁর মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান হন সতীশ ধাওয়ান। এরপর ধীরে ধীরে আরও স্বতন্ত্র হয়ে ওঠে ইসরো। এবং ASLV, PSLV, GSLV-র মতো বিভিন্ন স্যাটেলাইট নির্মাণের কাজ চলতে থাকে পুরোদমে। এরপর ১৯৮৩ সালে ইসরো ফের নাসার সাহায্য নেয় INSAT-এর নির্মাণ কার্যে। INSAT-এর মূল উদ্দেশ্য ছিল বেতার তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এর হাত ধরেই ভারতে টেলিভিশনের সূচনা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস জানার গোড়াপত্তন ঘটে এই বেতার তরঙ্গের সাহায্যে।
মজার বিষয়, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত, সেই সময়ই ভারত ক্রমাগত এই দুই দেশের থেকে সাহায্য নিয়ে মহাকাশ বিদ্যায় নিজের ভিত শক্ত করে চলেছিল। ১৯৮৪ সাল, ফের রেকর্ড গড়ে ভারত। এয়ার ফোর্স অফিসার হয়েও, প্রথম ভারতীয় হিসেবে মহাকাশে পাড়ি দেন রাকেশ শর্মা। সোভিয়েত ইউনিয়নের রকেট Soyuz 11-এই মহাকাশে পাড়ি দেন রাকেশ এবং ৮ দিন সেখানে ছিলেনও।
আরও পড়ুন- আমাদের শরীরে লুকিয়ে প্রাচীন ভাইরাসের জিন! নতুন গবেষণায় তোলপাড় বিশ্বজুড়ে
কেন নাসা মহাকশ বিজ্ঞানের সমস্ত ক্ষেত্রে আজও শীর্ষস্থানে?
প্রথমত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতার জেরে খুব কম সময়ের সময়েই নাসার আবিষ্কারের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে। দ্বিতীয়ত, নাসা জানিয়েছে তাদের উদ্দেশ্য মানবজাতির জ্ঞানের বৃদ্ধি ঘটানো এবং মহাকাশে মানুষের অস্তিত্ব সৃষ্টি ও বৃদ্ধি করা। অন্যদিকে, কোনও দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জেরে তৈরি হয়নি ইসরো। ইসরোর উদ্দেশ্য ছিল মহাকাশ প্রযুক্তিবিদ্যার উন্নয়ন ঘটানো, দেশের উন্নতির জন্য। দুই সংস্থার কাজ এক বিষয়ে, ভিন্ন পথে। প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা করার প্রবণতা নাসার বরাবরই বেশি। তৃতীয়ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুই সংস্থার অর্থনৈতিক তহবিল। যেখানে NASA-র বাজেট ছিল বার্ষিক ২৪ বিলিয়ন, সেখানে ISRO-র খরচের ক্ষমতা ছিল ১.৭ বিলিয়নের কাছাকাছি। সুতরাং, অর্থের জোর NASA-কে আরও বেশি প্রযুক্তি পরীক্ষার সুযোগ দিয়েছে তা বলাবাহুল্য।
কিন্তু এমনও কিছু বিষয়ে আছে যেখানে ISRO এগিয়ে রয়েছে NASA-র থেকে। যেমন, দক্ষতা, সম্পদ এবং খরচের কার্যকাতা। ২০০৫ সালে NASA, XSTEREO নামে একটি সোলার মিশন লঞ্চ করে যার খরচ পড়েছিল ৫৫০ মিলিয়ন ডলার। ISRO একইরকম একটি সোলার মিশনের পরিকল্পনা করেছে যার খরচ পড়বে মাত্র ৫৫ মিলিয়ন ডলার।
অর্থ-উদ্দেশ্য-ক্ষমতা নিয়ে তুলনা চললেও ISRO, NASA বা অন্য কোনও সংস্থাকে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে এখন সর্বাগ্রে বিবেচ্য মহাকাশবিদ্যার উন্নয়ন। প্রথম বিশ্ব হোক বা তৃতীয় বিশ্ব, প্রতিযোগিতা নয় সহযোগিতাই যে উন্নয়নের পথ এঁকে দিতে পারে।