প্রায় প্রতিদিনের সঙ্গী AI? হিসেব করতে, গভীরে ভাবতে ভুলে যাচ্ছেন না তো?
AI Critical Thinking: ইমেল লেখা থেকে শুরু করে, ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা, আর্থিক পরামর্শ থেকে শুরু করে লেখা অনুবাদ এমনকী চাকরির ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতি সারতেও মানুষ AI ব্যবহার করছে।
কিছু মনে না পড়লেই, সেটা নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করে উত্তর বের করা বা হিসেব করা ক্রমেই আমাদের অভ্যাস থেকে চলে গিয়েছে। সহজতম যোগও আমরা চিন্তা না করে, মাথায় হিসেব না করে পকেট থেকে বের করে ফেলি মোবাইল ক্যালকুলেটর। তথ্য মনে না পড়লেই আঙুল চলে যায় গুগল সার্চের বোতামে। ২০১১ সালে সায়েন্স ম্যাগাজিনের একটি প্রতিবেদনে জানা গিয়েছিল, ইন্টারনেট সার্চ ইঞ্জিনের ঘন ঘন ব্যবহার করেন যারা, তারা অফলাইনে জানা বা শেখা কোনও তথ্য আর মনেই রাখতে পারছেন না। সময় গড়িয়ে গিয়েছে আরও অনেকটাই। মানুষের ইন্টারনেট নির্ভরতা বেড়েছে। ক্রমেই বাড়ছে এআই নির্ভরতাও। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষ এবং কম্পিউটার ক্রমেই 'আন্তঃসংযুক্ত সিস্টেম' হয়ে উঠছে। মানুষের মৌলিক স্মৃতি ক্রমেই কমছে৷
এই 'গুগল এফেক্ট'-কে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন 'ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া'। অর্থাৎ সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে সহজেই অনলাইনে পাওয়া যায় এমন তথ্য ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। কিন্তু কেন একটি ক্লিকে উপলব্ধ তথ্য সংরক্ষণ করতে গিয়ে মস্তিষ্কের সম্পদ নষ্ট হবে?
গুগল এখন বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েবসাইট। ইন্টারনেট নিজেই মানুষের জ্ঞানের নিশ্চিত ভাণ্ডার। এর সঙ্গে জুড়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। মানুষের জ্ঞান, উত্তর খোঁজার পথে ক্রমেই বিশালাকার হয়ে দাঁড়াচ্ছে ডিজিটাল অ্যামনেশিয়া। ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট থেকে শুরু করে ChatGPT, গুগল সার্চের AI ওভারভিউ— এক কথায় AI আমাদের সারাদিনের পরিকল্পনা করছে, আমাদের কাজ করছে এবং আমাদের প্রশ্নের উত্তরও দিচ্ছে। মোদ্দা কথা, এআই আমাদের হয়ে চিন্ত করে দিচ্ছে। তাহলে প্রশ্ন, এই নতুন মানব-এআই সম্পর্ক কি আমাদের চিন্তাভাবনা এবং আচরণকে নতুন করে সাজাবে?
আরও পড়ুন- হুজুগের ঠেলা সামলাতে ল্যাজেগোবরে! জিবলি ছবির চাহিদায় যে সমস্যার মুখে OpenAI
মানুষ ক্রিটিক্যাল থিংকিং করতে পারে। অর্থাৎ বিশ্লেষণমূলক, যুক্তিধর্মী চিন্তাভাবনায় সক্ষম। মানুষ কোনও যুক্তিযুক্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য তথ্য বিশ্লেষণ করে, তথ্যের মূল্যায়ন এবং সংশ্লেষ করে। যে মানুষের এই ক্ষমতা যত বেশি তাঁরাই চিন্তার জগতে এগিয়ে, বিজ্ঞানের জগতে এগিয়ে, তাঁরা কোনও কাজে পারদর্শী বেশ। ধরা যাক, আপনি একটি বাড়ি কেনার জন্য বিভিন্ন ঋণের শর্তাবলী তুলনা করে দেখছেন বা গাড়ির বীমা করানোর আগে নানা কিছু খতিয়ে দেখছেন, মানে আপনি ক্রিটিক্যাল থিংকিং করছেন। কোনও কবিতা পড়ছেন, কোনও সিনেমা বা শিল্পকর্মের অর্থ বোঝার চেষ্টা করছেন মানে গভীরে চিন্তা করেছেন। এমনকী, সারাদিনের ব্যস্ততা কীভাবে সামলাবেন সেই নিয়ে পরিকল্পনা করার সময়ও আপনি ক্রিটিক্যাল থিংকিং করেন।
AI এই সমস্ত কাজই করতে পারে। বরং একইসঙ্গে অনেক কাজ করতে পারে এবং আরও দক্ষভাবে করতে পারে। ২০২২ সালে চালু হওয়ার পর থেকে, ChatGPT নবম সর্বাধিক জনপ্রিয় ওয়েবসাইট এবং iPhone-এ চতুর্থ সর্বাধিক জনপ্রিয় অ্যাপে পরিণত হয়েছে। জানুয়ারির গোড়াতেই পাওয়া একটি হিসেব বলছে, বিশ্বজুড়ে ৩০০ মিলিয়ন মানুষ সপ্তাহে সক্রিয়ভাবে চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করেন এবং দিনে ১২৩.৫ মিলিয়ন মানুষ তা ব্যবহার করছেন।
আরও পড়ুন- AI ২০২৪: কতদূর এগোল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা?
ইমেল লেখা থেকে শুরু করে, ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা, আর্থিক পরামর্শ থেকে শুরু করে লেখা অনুবাদ এমনকী চাকরির ইন্টারভিউয়ের প্রস্তুতি সারতেও মানুষ AI ব্যবহার করছে। ২০২৪ সালের একটি সমীক্ষা বলছে, প্রায় অর্ধেক আমেরিকান বলেছেন যে তারা সপ্তাহে বেশ কয়েকবার AI ব্যবহার করে। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কার্যত সমস্ত আমেরিকানরাই AI যুক্ত পণ্য ব্যবহার করেন।
AI-এর নির্মাতারা বলেছিলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের সেই কাজগুলো সহজে করতে সাহায্য করবে যেগুলো সময় সাপেক্ষ এবং নেহাতই 'টেকনিক্যাল'। ফলে মানুষের সময় বাঁচবে আর মানুষের উত্পাদনশীলতা বাড়বে। এই সময় বাঁচিয়ে অন্য, আরও সৃজনশীল এবং উদ্ভাবনী কাজে তা ব্যয় করতে পারবে মানুষ। বিজ্ঞান বলছে, বিষয়টা ভুল না। মানুষের জ্ঞানীয় চেতনার ক্ষমতা সীমিত। তাই চাপ কমলে অন্য কিছু শেখার এবং কর্মক্ষমতা উন্নত হতেও পারে।
তবে বিষয়টি ব্যুমেরাং হতে পারে। AI আমাদের অন্য কাজগুলি কমিয়ে দিয়ে আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতাই আদতে কমিয়ে দিতে পারে। যেহেতু AI দৈনন্দিন জীবনে ক্রমেই সাধারণ বিষয় হয়ে উঠেছে তাই মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি ব্যবহারকারীদের ব্যস্ততা হ্রাস করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমালোচনামূলক, যুক্তিভিত্তিক চিন্তাভাবনার দক্ষতাও কমিয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, যদি মানুষজন সত্যিই উদ্ভাবনী কোনও কাজের জন্য AI-এর সম্পদ ব্যবহার করে, তাতে অসুবিধা নেই। তবে গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক মানুষই এআই এর ক্ষমতাকে অন্যভাবে ব্যবহার করছে। খুব সামান্যতম কাজেও এই নির্ভরতা বাড়ছে। সেখানে কাজের কাজ না হয়ে বিনোদন প্রাধান্য পাচ্ছে। এই অকারণ ব্যবহারের ফলে মানুষের নিজস্ব চিন্তা করার শক্তি কমছে। পাশাপাশি, আরও একটি বিষয় গবেষকরা লক্ষ্য করেছেন। সমস্যা সমাধান করতে এআই-এর উপর নির্ভর হয়ে মানুষ যে অতিরিক্ত সময় বাঁচাচ্ছে, মস্তিষ্কের যে শক্তি সে বাঁচাচ্ছে তা খরচ হচ্ছে নেটফ্লিক্স দেখে বা সোশ্যাল মিডিয়া স্ক্রল করে— তাও আসলে এআই অ্যালগরিদম পরিবেশিত পণ্যই। ফলে মানুষের চেতনার ঘরে তালা পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।