ভারতের প্রথম সোলার ডোম নিউটাউনে! বিদ্যুতের ব্যাপক অপচয় কতটা শোধরাবে রাজ্য?

Eco Park Solar Dome: বাংলায় এখনও সেভাবে সৌরশক্তির উৎপাদন না হলেও নতুন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে মাত্র ৫% অচিরাচরিত শক্তি উৎপাদনে সক্ষম আমাদের রাজ্য।

শহরে নতুন চমক। শেষ কয়েক বছরে কলকাতার ইকোপার্ক জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে এসেছে। শীত হোক বা গরম সব সময়েই লোকসমাগম দেখা যায় ইকো পার্কে। সবুজে ঘেরা ইকোপার্কের আকর্ষণ আরও বাড়িয়ে তুলতে এবার যোগ হল সৌর গম্বুজ বা সোলার ডোম। বিশালাকার এই গম্বুজ ভারত তথা বাংলার প্রথম সৌর গম্বুজ। নিউটাউন ইকো পার্কের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে বাংলার গ্রাম এবং ধামসা রেস্তোরাঁর ঠিক পাশেই গোলাকার সৌর গম্বুজ তৈরি হয়েছে। শক্তিই মানবসভ্যতার প্রধান চালক। বিশ্বজুড়ে যে হারে শক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন শীঘ্রই ফুরিয়ে যাবে শক্তির ভাণ্ডার। এ অবস্থা থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় অচিরাচিত শক্তির উৎসগুলি ব্যবহার করা। একারণে উন্নত দেশগুলিতে অনেকদিন ধরেই সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি, গোবরগ্যাস শক্তি ব্যবহারের পরিমাণ বেড়েছে। আমাদের দেশ বিশ্বের বিভিন্ন তুলনায় অচিরাচরিত শক্তির ব্যবহারে পিছিয়ে থাকলেও এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। ভারতে উৎপাদিত অচিরাচরিত বিকল্প শক্তি সম্পর্কে আমজনতা থেকে স্কুল পড়ুয়া সকলকে সচেতন করতেই এই সোলার ডোম চালু হয়েছে।

সোলার ডোমের খুঁটিনাটি

২০১৭ সাল থেকে এই গম্বুজ তৈরির কাজ শুরু হয়। ২.৮৯ একর জমির উপর তৈরি হওয়া গোলাকার এই সোলার ডোমের গায়ে রয়েছে মোট ২০০০ টি সুদৃশ্য সোলার প্যানেল। দূর থেকে দেখে গ্লাস হাউজ বলে মনে হবে। অর্ধচন্দ্রাকৃতি এই গম্বুজের উচ্চতা প্রায় ২৭ মিটার এবং ব্যাস ৪৬ মিটার। হিডকো এবং রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা যৌথভাবে এই গম্বুজ তৈরি করেছে। সুইজারল্যান্ডের একটি নামী সংস্থার পরামর্শেই বানানো হয়েছে সোলার ডোম। পাশাপাশি রাজ্য নগরোন্নয়ন দপ্তরও আর্থিক সাহায্য করেছে। এটি তৈরির সময় ঠিক হয়েছিল প্রায় ৩০ কোটি টাকা ব্যয় করবে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থা। তবে সোলার ডোমের কাঠামোটি তৈরি করেছে ভারতের ব্রিজ অ্যান্ড রুফ কোম্পানি।

গম্বুজের গায়ে থাকা সোলার প্যানেল প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৮০ কিলো ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম। এর ভিতরে থাকা লাইট, পাখা, লিফট, কম্পিউটার, টিভি সবকিছুই চলবে সৌর বিদ্যুতের সাহায্যে। সকাল বা বিকেল সূর্যের অবস্থান যেদিকেই থাকুক, গম্বুজে থাকা সোলার প্যানেল বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। ডোমের ভিতর ন’তলা বাড়ির উচ্চতার সমান গোলাকার গ্যালারি রয়েছে, যেখানে দাঁড়িয়ে গোটা ইকো পার্ক দেখতে পাবেন দর্শকরা। ইকো পার্কে ঘুরতে আসা পর্যটকদের সকলেই বিনামূল্যে এই গ্যালারিতে ঢুকতে পারবেন। এর ভিতরে বিভিন্ন তলায় বিশ্ব উষ্ণায়নের উপর নানা প্রদর্শনী থাকবে। অপ্রচলিত শক্তির ব্যবহার সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে রাখা হবে নানা ধরনের ছবি ও গ্রাফিক্সের ব্যবহার। পাঁচতলা এই ডোমের চতুর্থ তলা পর্যন্তই দর্শনার্থীরা প্রবেশ করতে পারবেন, বাকি স্থানে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।

আরও পড়ুন- পরিবেশ রক্ষার মার্কশিটে ডাহা ফেল, কেন এই অবস্থা ভারতের?

হিডকো চেয়ারম্যান দেবাশিস সেন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ডোমের বাইরে সোলার প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সৌর বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞ শান্তিপদ গণচৌধুরী জানিয়েছেন, “এত বড় মাপের সোলার ডোম প্রকল্প এখনও ভারতের কোথাও তৈরি হয়নি। এ রাজ্যে এ ধরনের প্রকল্প যে গড়ে উঠেছে, তা চমকে দেওয়ার মতোই।”

কেন এই উদ্যোগ?

হিডকোর আধিকারিকরা জানিয়েছেন যে, তারা প্রথম থেকেই গ্রিন ও ক্লিন নগর তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছেন। শহরের বুকে সবুজায়নের উদ্দেশ্যেও নানা প্রকল্প গ্রহণ করেছে হিডকো কর্তৃপক্ষ। প্রায় তিন একর জায়গা জুড়ে ট্রি লাইব্রেরি বা গাছের গ্রন্থাগার তৈরির কাজ চলছে নিউ টাউনে। এমনকী নিউটাউনের রাস্তায় পরিবেশবান্ধব বাস, ট্যাক্সি, টোটো এবং সাইকেল চালানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। সরকারি বা বসত বাড়ি নির্মাণের ক্ষেত্রেও গ্রিন বিল্ডিং তৈরির উপর জোর দেওয়া হয়েছে। বিকল্প শক্তি বা সৌরশক্তি ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন অফিসের ছাদের মাথায় সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। হিডকো, এনকেডিএ ভবন, ইকো পার্কেও সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ তৈরির ব্যবস্থা করা হয়েছিল আগেই।

এক্ষেত্রে হিডকোর মূল লক্ষ্য হল বিকল্প শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করা এবং আগামী দিনে বিকল্প শক্তির ব্যবহার সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তোলা। জানা গেছে, এটি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রিন সিটি প্রকল্পের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। নিউটাউন এলাকায় কার্বন নিঃসরণ কমানোর আশায় একাধিক জায়গায় সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। এরই মধ্যে শীতের ছুটির মরশুমের আগেই এই সোলার গম্বুজ খুলে যাওয়ায় দর্শকদের মধ্যে যে বাড়তি কৌতূহল কাজ করবে তা আশা করাই যায়। পাশাপাশি মানুষের মধ্যে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতাও গড়ে তোলা সম্ভব হবে।

ভারতে সৌরশক্তির উৎপাদন

২০২১ সালে সৌর শক্তি উৎপাদনে ভারত বিশ্বে চতুর্থ স্থানাধিকারী দেশ হিসেবে উঠে এসেছে। তালিকার প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে যথাক্রমে রয়েছে চিন, আমেরিকা এবং জাপান। আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ২০২৪ সালের মধ্যে ভারত সৌরশক্তি উৎপাদনে আমেরিকা ও জাপানকে পিছনে ফেলে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসবে।

আরও পড়ুন- বৌদ্ধ ধর্মেই লুকিয়ে পরিবেশ বাঁচানোর মূল মন্ত্র? কী বলছে গবেষণা

ভারত সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল, ২০২২ সালের মধ্যেই দেশে ২০ গিগাওয়াট সৌরশক্তি উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করা এবং নির্ধারিত সময়ের প্রায় চার বছর আগেই এই লক্ষ্য পূরণ করেছে ভারত। এই মুহূর্তে দেশে ৬০.৪ গিগাওয়াট সৌর শক্তি উৎপন্ন হয়। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে সৌর শক্তি উৎপাদনে সক্ষম রাজস্থান। অন্যদিকে বাংলায় এখনও সেভাবে সৌরশক্তির উৎপাদন না হলেও নতুন লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে মাত্র ৫% অচিরাচরিত শক্তি উৎপাদনে সক্ষম আমাদের রাজ্য। পুনর্নবীকরণযোগ্য বিভাগের প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি নন্দিনী চক্রবর্তী এ প্রসঙ্গে জানিয়েছিলেন, “২০৩০ সালের মধ্যে বাংলায় ২০% অচিরাচরিত শক্তি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।” দূষণ থেকে বাঁচতে এই মধ্যেই বহু সরকারি স্কুলবাড়ির ছাদে সোলার প্যানেল বসানো হয়েছে। সুতরাং ভারত তথা বাংলাও সৌরশক্তি উৎপাদনে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শক্তির জোগান দিতে হাত হাত মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে, যা পরিবেশ রক্ষার্থেও অত্যন্ত সময়পযোগী উদ্যোগ।

More Articles