নগ্ন নারীর প্রতিবাদের আগুন, কান ফেস্টিভ‍্যাল মনে করাল মণিপুরের কথা

কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মহিলার নগ্ন প্রতিবাদ মনে করাচ্ছে দেড়-দু'দশক আগের কথা।

যৌনতা মানুষের জীবনের অঙ্গ। কিন্তু এই সুন্দর জিনিসটিই বিভীষিকা হয়ে ওঠে কখনও কখনও। নারীর দেহের ওপর পুরুষের নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা বা সার্বিকভাবে নারীকে নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা থেকেও নেমে আসে ধর্ষণের মতো অভিশাপ। দাঙ্গা হোক বা যুদ্ধ, সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুরা ও নারীরা। ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনার দ্বারাও ধর্ষিতা হয়েছেন বহু নারী- এমনটাই দাবি করা হচ্ছে। সম্প্রতি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে হুলুস্থূলু ফেলে দিয়েছেন এক নারী। নিজের পোষাক ছিঁড়ে নগ্ন গায়ে নীল-হলুদে লেখা 'স্টপ রেপিং আস' (আমাদের রেপ করা থামাও) মেলে ধরেছেন মস্ত ক্যামেরার সামনে। সেই দৃশ্য কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল থেকে ছড়িয়ে পড়েছে সমগ্র বিশ্বে। আন্তর্জাল এই নিয়ে উত্তাল।

 

এই প্রতিবাদের ধরন সঠিক না বেঠিক, এ প্রতিবাদ কতখানি দেখনদারি, কতখানি আন্তরিক- এইসব নানা মর্মে চলেছে তর্ক। রেড কার্পেটময় চাকচিক্যের দুনিয়াতে এই প্রতিবাদ অভিনব, সন্দেহ নেই। মেয়েটির কাপড়-জামা ছিঁড়ে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে একদল প্রতিবাদী ওই একই স্লোগান দিতে থাকেন চিৎকার করে। স্টপ রেপিং আস-এ মুখরিত হয়ে ওঠে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। মুহূর্তের মধ্যে রক্ষীরা মেয়েটিকে ঘিরে ফেলে। গত শুক্রবার ঘটে যাওয়া এই ঘটনা গোটা পৃথিবীকে আরেকবার মানবতার সংকটের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।

 

কীসের বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ? ফেব্রুয়ারি থেকেই রাশিয়া আক্রমণ শানিয়ে চলেছিল ইউক্রেনের ওপর, সেই আক্রমণের ট্যাকটিক হিসেবেই ইউক্রেনের মহিলাদের রেপ করেছে রাশিয়ান সেনারা- এমন দাবি করা হয়েছে বারবার। ইউক্রেন জানিয়েছে হাজার হাজার যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে, অপরাধীর সংখ্যাও কম নয়। জর্জ মিলারের ছবি 'থ্রি থাউজ‍্যান্ড ইয়ার্স অফ লঙ্গিং'-এর প্রিমিয়ার আটকে যে প্রতিবাদীরা প্রদর্শন করেছেন, জানা গিয়েছে তাঁরা 'স্কাম' নামক একটি সংস্থার সদস্য। ১৯৬৭ সালে 'স্কাম ম্যানিফেস্টো' নামে যে বইটি লেখা হয়েছিল, সেখান থেকেই 'স্কাম' কথাটি নিয়েছেন তাঁরা। ইউক্রেন দাবি করেছে, গত বৃহস্পতিবার একটি এক বছরের বাচ্চা রাশিয়ান সেনাদের রেপের শিকার হয়ে মারা গিয়েছে। দু'দিনে যে ষাটটি রেপের খবর এসেছে, তার মধ্যে ঐ বাচ্চাটিও ছিল। নারী এবং শিশু- রেহাই পাচ্ছে না কেউই। খারিভের গ্রামে দু'টি দশ বছরের ধর্ষিত ছেলের কথাও জানা গিয়েছে। এই ধরনের হিংসাত্মক ঘটনার দাবিতে গোটা বিশ্ব আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে। বুকাতে ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সি ২৫টি মেয়েকে রেপের খবর জানিয়েছেন লিউদমিলা ডেনিসোভা, ইউক্রেনের মানবাধিকার কমিশনার। এমতাবস্থায় কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে মহিলার নগ্ন প্রতিবাদ মনে করাচ্ছে দেড়-দু'দশক আগের কথা।

 

আরও পড়ুন: খুন-ধর্ষণের মতো ভয়াবহ ঘটনা চোখের সামনে, কী প্রভাব পড়ে মনে?

 

২০০৪-এর ১৫ জুলাই। ১২ জন মণিপুরী মহিলা নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছেন কাংলা ফোর্টের গেটের সামনে। হাতের ব্যানারে লাল কালিতে লেখা 'ইন্ডিয়ান আর্মি, রেপ আস', 'ইন্ডিয়ান আর্মি টেক আওয়ার ফ্লেশ'। সেসময় ভারতীয় সেনারা চূড়ান্ত অত্যাচার চালাচ্ছে মণিপুরে। আফস্পা ধারায় যাচ্ছেতাই অত্যাচারের স্বাধীনতা তাদের দেওয়া হয়েছে। আসাম রাইফেলস্‌-এর হেড কোয়ার্টার ছিল তখন ইম্ফলের কাংলা ফোর্ট। কথায় কথায় গ্রেফতার, অত্যাচার, নিগ্রহের ঘটনায় মণিপুরের মানুষ অতিষ্ঠ। ইতিমধ্যে বছর বত্রিশের মনোরমা থাঙ্গিয়ামের লাশ পাওয়া গেল। এই ঘটনার দিনচারেক আগেই মনোরমাকে আসাম রাইফেলস তুলে নিয়ে গিয়েছিল। গুলিতে ঝাঁঝরা অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল সেই লাশ। ঊরু ও যৌনাঙ্গেও গুলি করা হয়েছিল। রেপ করে খুন করার পর একটা ধানক্ষেতের পাশে লাশ ফেলে রেখে যায় সেনারা। লাশের শরীরে পাওয়া গিয়েছিল বীর্যও। এই ঘটনায় তোলপাড় হয়ে ওঠে মণিপুর। জুডিশিয়াল কমিশন নিয়োগ করা হয় তদন্তের জন্য। কী পরিমাণ শারীরিক নিগ্রহ সহ্য করে মারা গিয়েছিল মনোরমা, তার অভিঘাত বুঝে নড়েচড়ে বসেছিল ওপরমহলও।

 

এই ঘটনায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে মণিপুরের আমজনতা। দীর্ঘদিন ধরে অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ গড়ে উঠেছিল, তার আগল খুলে দেয় কেউ। একের পর এক খুন, ধর্ষণ, গুমের ঘটনা আর মেনে নিতে রাজি হয়নি তাঁরা। তবে এই দুনিয়াখ্যাত প্রতিবাদ দিবসের জন্যও রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছিল সেই মায়েদের। "আমরা তো মনোরমারই মা, আমাদেরও ধর্ষণ করে খুন করুক সেনারা"- ইংরেজিতে চেঁচিয়ে বলেছিলেন আইমা জ্ঞানবি। সেনাদের শোনানোর জন্যই উঠেছিল সেইসব স্লোগান।

 

মনোরমার ঘটনার পর মাত্র একদিনের প্রস্তুতিতে প্রাথমিক প্রতিবাদের একটি কর্মসূচি নেওয়া হয়। ৩২টি নাগরিক সংগঠন মণিপুরে 'অপূর্ণ লাব' নামে পরিচিত। তাঁদের একটি সম্মিলিত বৈঠক হয় ২০০৪-এর ১৪ জুলাই। মনোরমার ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে কী কী কর্মসূচি নেওয়া যায়- তাই আলোচনা হচ্ছিল সেখানে। কিন্তু সেই নানা মতের দীর্ঘ আলোচনায় আইমাদের ধৈর্যচ্যুতি হয়। আইমা আনন্দী, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা, নিজেদের মতো করে প্রতিবাদ সাজানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিলেন। অন্য একটি ঘরে মহিলারা বসেছিলেন। তাঁদের কাছে গিয়ে নিজের নগ্ন প্রতিবাদের পরিকল্পনাটি জানান আনন্দী। তাঁর বয়ানে, "আমার যেটা মনে হয়েছিল, এরা তো এমনিতেই আমাদের সম্ভ্রমের চোখে দেখে না, এদের সামনে প্রতিবাদে পোষাক পরতে যাব কেন? একবাক্যে সবাই রাজি হল। পুরুষমানুষদের সঙ্গে আলোচনা করতে গেলে এই ধরনের প্রতিবাদ দাঁড়াতই না।"

 

কাউকে জানাননি তাঁরা। নিজেদের পরিবারকেও জানাননি। ১৫ জুলাই। প্রতিবাদ হল প্রতিবাদের মতো। নিজের দেহের কর্তৃত্ব সম্পূর্ণ নিজের হাতে তুলে নিয়েই। বহু বেড়া ভাঙতে হয়েছিল চুপচাপ, দলকে জানানো হয়নি, পরিবারকে জানানো হয়নি, কোনও পুরুষকে কর্তৃত্বের ছাপ ফেলতে দেওয়া হয়নি কোথাও। আনন্দী মনে করেন, এছাড়া আর কোনও রাস্তা ছিল না। যদিও দল তাঁদের এই প্রতিবাদ খুব একটা ভালো ভাবে নেয়নি। মানবেই বা কীভাবে? মণিপুরের রাস্তা হোক বা কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, নগ্নতায় নারী নিজের অধিকার বুঝে নিলে সমস্যা হয় সবারই। কেঁপে ওঠে পিতৃতন্ত্র। বাঁধন তার আরও আলগা হয়ে ওঠে।

 

 

More Articles