রামপুরহাট কান্ডে থ্রি-ডি লেজা়র স্ক্যানিং প্রযুক্তির ব্যবহার - কী এই প্রযুক্তি?
রামপুর হত্যাকান্ডে সিবিআই তদন্ত হচ্ছে। তদন্তে ব্যবহার করা হচ্ছে থ্রি-ডি লেজা়র স্ক্যানিং টেকনোলজি! কেন প্রয়োজন এই প্রযুক্তির? কতটা সুরাহা হবে এতে তদন্তের, আসুন বুঝে নেওয়া যাক।
ক্রাইম সিনে কেন লাগবে থ্রিডি মডেল?
থ্রি-ডি লেজা়র স্ক্যানিং–এর সাহায্যে তদন্তের স্বার্থে ক্রাইম সীনের মডেল বানিয়ে নেওয়া যায়। এই প্রযুক্তির সাহায্যে ক্রাইম সীনে থাকা প্রতিটি বস্তুর প্রতিটি বস্তুর অবস্থান, তারা কী অবস্থায় আছে এগুলি ডিজিটাল মাধ্যমে পুনঃনির্মান করে অপরাধের পরিস্থিতি সাজিয়ে নেওয়া যায়। এতে কেবল সিবিআই তদন্তেরই সুবিধে হবে এমন নয়, আদালতে ক্রাইম সিনের অনুকরণে একটি মডেল পেশ করতে সুবিধে হবে। প্রথাগত ভাবে তদন্তে ব্যবহৃত প্রযুক্তি বা ব্যবস্থার মাধ্যমে কিন্তু তা সম্ভব হয় না।
প্রথাগত ভাবে তদন্তে ব্যবহৃত প্রযুক্তি দিয়ে তদন্তের প্রমাণ রেকর্ড করতে সময় লাগে, ক্রাইম সীনে থাকা বস্তু ও মানুষের অবস্থান, তাদের দূরত্ব মাপজোক করতে সময় লাগে অনেক বেশি। একদিনে সব কাজ শেষ করাও যায় না, ফলে প্রমাণ লোপাটের সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। অন্যদিকে থ্রি-ডি লেজা়র স্ক্যানার দিয়ে ক্রাইম সিনের একটি থ্রি-ডি মডেল দ্রুত বানিয়ে নেওয়া যায়।
থ্রি-ডি লেজার স্ক্যানার খুব কোনো বস্তুর গঠন খুব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে মাপতে পারে। আর সেই জন্যেই কোনো জটিল গঠনযুক্ত বস্তুর গঠন, আকার, আকৃতিও জানা যায় এর থেকে। ক্রাইম সীনে এমন অনেক কিছুই থাকে যা সাধারণত নজরে আসে না - বা এত কিছুর ভিড়ে নজর এড়িয়ে যায়। থ্রি-ডি স্ক্যানিং পদ্ধতি সেটাও তুলে ধরে ওই ক্রাইম সীনের ওই থ্রি-ডি মডেলে।
এবং এরকম ত্রুটিহীন একটি মডেল বানাতে গেলে প্রয়োজন ওই বস্তু বা স্থানের প্রতিটি বিন্দুর অবস্থান এবং গঠনগত তথ্য। এত পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাওয়া লেজারের ব্যবহার ছাড়া সম্ভব নয়।
কী ভাবে কাজ করে থ্রি-ডি লেজা়র স্ক্যানার?
থ্রি-ডি লেজা়র স্ক্যানারে লেজা়র রশ্মি নির্গত হয় একটি লেজা়র প্রোব থেকে। এই প্রোবটিকে আবার চালনা করে একটি সফ্টওয়্যার। এবার লেজা়র রশ্মিটি বের হয়ে কোনো বস্তু বা স্থানের উপর গিয়ে পড়ে। যেহেতু আমরা রামপুরহাটের সূত্র ধরেই এগোচ্ছি, ধরা যাক এখানে একটি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ির ত্রিমাতৃক ছবি পাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে, সেই বাড়ির উপরিতলে লেজা়র ফেলা হল। ঠিক এই সময়ে দুটি সেন্সার ক্যামেরা লেজা়র আলোর রেখার গঠন কী ভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে, একটি রেখার থেকে আরেকটি রেখার দূরত্ব কত এই বিষয়গুলি মাপতে থাকে। তখনও কিন্তু বাড়ির উপরেতলে লেজা়র আলোর রেখাগুলি বয়ে চলেছে।
ঠিক যেমন একটি রেখা - সে সরল হোক বা বক্র - একাধিক বিন্দু দিয়ে তৈরি, ঠিক তেমনই জ্যামিতির সংজ্ঞা দিয়ে দেখলে কোনো বস্তু - যেমন এই বাড়িটিও - লক্ষ লক্ষ বিন্দু দিয়ে তৈরি। লেজা়র রশ্মি খুব দ্রুত ঘুরতে থাকে প্রতিটি বস্তুর উপর এবং সেকেন্ডে প্রায় সাড়ে সাত লাখ বিন্দুর অবস্থান রেকর্ড করে।
এই বিন্দুগুলির অবস্থান, এবং গঠন সম্পর্কিত তথ্য "পয়েন্ট ক্লাউড" হিসেবে কম্পিউটারে জমা হয়। এই সমস্ত বিন্দু সম্পর্কিত ডেটা সংগ্রহ করা হয়ে গেলেই, সেই বিন্দুগুলিকে জড়ো করে বস্তুটির থ্রি-ডি আকার দেওয়া সম্ভব হয়। সমস্ত বিন্দুকে জড়ো করলেই ঘটনাস্থলের একটি নমুনা বানানো যাবে।
কিন্তু লেজা়রই কেন?
লেজা়র স্ক্যানিং-এর সময়ে, লেজা়র প্রোব থেকে প্রতিবার ইনফ্রারেড লেজা়র বিম তৈরি হয়। ইনফ্রারেড রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য কম, কিন্তু শক্তি বেশি। প্রত্যেকবার যখন এই লেজা়র রশ্মি বিচ্ছুরণ করা হয় ক্রাইম সিনে, সেই রশ্মি আবার বিচ্ছুরিত হয়ে ফিরে আসে। সেই সময় সেন্সর ক্যামেরাটি মাপতে থাকে ঠিক কত সময় নিলো বিচ্ছুরিত সেই রশ্মি ক্যামেরার দিকে ফিরে আসতে। বিচ্ছুরিত রশ্মির ক্যামেরার দিকে ফিরে আসার সময়কে ধরে, সেন্সর ক্যামেরাটি হিসেব করে ফেলে থ্রি-ডি লেজা়র ক্যামেরা থেকে ক্রাইম সীনের প্রত্যেকটি বস্তুর দূরত্ব কত।
ইনফ্রারেড রশ্মি কেবল কম আলোতেই যে ছবি তুলতে পারে এমন নয়, কয়েক কিলোমিটার দূরত্ব থেকে কোনো বস্তুর নিখুঁত ছবি এক নিমেষে তুলতে পারে।
আর কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার হয়?
অপরাধের তদন্দ বা ফরেন্সিক তদন্ত তো আছেই, তার পাশাপাশি ইলেক্ট্রনিক্স, চিকিৎসাশাস্ত্র, অটোমোবাইল, এরোস্পেস, স্থাপত্য, নির্মাণকার্য, ইঞ্জিনিয়ারিং, এরোস্পেস, এন্থ্রোপলজি ছাড়াও অগুন্তি ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তির ব্যবহার রয়েছে।