ভারতে হু হু করে বাড়ছে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা, কেন এই পরিস্থিতি দেশের শৈশবের?
লক্ষ লক্ষ শিশু শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গনাইজেশন এবং ইউনিসেফ-এর তরফে এই সম্পর্কে দু'টি পৃথক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে।
বেআইনিভাবে ভারতে ১ কোটি শিশুকে শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করানো হচ্ছে, এফআইদায়ের হয়েছে নগণ্য সংখ্যক।
শৈশবের হাসিখুশির সময়ে লক্ষ লক্ষ শিশু শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে অসহনীয় দারিদ্রের হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনেতারা সেই ২০১৫ সালে অঙ্গীকার করেছিলেন, ২০২৫ সালের মধ্যে গোটা পৃথিবীকে শিশুশ্রমিক-মুক্ত করা হবে। কিন্তু সেই লক্ষ্য এখনও বহু দূরের পথ।
করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে হামলা চালানোর পর লক্ষ লক্ষ মানুষ জীবিকা খুইয়েছেন। লক্ষ লক্ষ শিশু শ্রমিকের জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গনাইজেশন এবং ইউনিসেফ-এর তরফে এই সম্পর্কে দু'টি পৃথক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে।
আরও পড়ুন: ‘ডিজিটাল’ ভারতেও কোটি কোটি মহিলা বঞ্চিত মোবাইল ব্যবহারে, নয়া সমীক্ষায় বৈষম্য স্পষ্ট
রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, করোনাকালে দুনিয়ার ১৬ কোটি নিষ্পাপ শিশু বনে গিয়েছে শিশুশ্রমিক। এদের মধ্যে ৯ কোটি ৭০ লক্ষ বালক এবং ৬ কোটি ৩০ লক্ষ বালিকা। শিশুশ্রম দূরীকরণ তো দূরের কথা, পরিস্থিতি আরও সঙ্গিন হয়েছে কোটি কোটি শিশুর জীবনে। দুনিয়ার প্রতি ১০ জন শিশুর ভেতর একজনই শিশুশ্রমিক।
এই মুহূর্তে ভারতে কত শিশুশ্রমিক রয়েছে, সেই সম্পর্কে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা রাজ্য সরকারগুলির হাতে নেই। তবে জনগণনার সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে এক কোটিরও বেশি শিশুশ্রমিক রয়েছে। এই সংখ্যাটা ফের হু হু করে বেড়েছে দু'বছরে করোনাকালে।
ভারতে শিশুশ্রম সম্পূর্ণ বেআইনি। যদিও শিশুশ্রম আটকাতে তেমন কোনও উদ্যোগ নেই সরকারের। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্ট অনুসারে, শিশুশ্রমিক হিসেবে বেআইনিভাবে কাজ করানোর দায়ে 'চাইল্ড লেবার প্রোহিবিশন অ্যান্ড রেগুলেশন অ্যাক্ট'-এ দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা নামমাত্র।
কেবল ভারতই নয়, পৃথিবীজুড়েই এই পরিস্থিতি। দুনিয়ায় যত শিশুশ্রমিক দু্র্ভাগ্যের কবলে, তাদের মধ্যে অর্ধেকেরই বসবাস আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের দেশগুলিতে মোট যত শিশুর বসবাস, আফ্রিকায় শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করছে এর চেয়ে বেশি সংখ্যার শিশু।
তবে এই চাকচিক্যময় আধুনিক দুনিয়া কি আজও শিশুর বাসযোগ্যর উপযোগী নয়? আন্তর্জাতিক স্তরের বিভিন্ন সমীক্ষার তথ্যে এমনই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। এও দেখা যাচ্ছে, আবিশ্বে ৭৪ শতাংশ শিশু কোনও ধরনের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পেরই সুবিধা পাচ্ছে না। এদের মধ্যে ৯০ শতাংশ শিশু নিম্ন আয়ের নানা দেশের বাসিন্দা। অভিশপ্ত জীবন কাটাতে বাধ্য করা হয়েছে যে শিশুদের, তাদের বয়স ৫ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে।
অথচ সুন্দর ও সুস্থ শৈশব কাটানো প্রতিটি শিশুর মৌলিক অধিকারের মধ্যেই পড়ে। শিশুশ্রমিকরা কলকারখানা, ইটভাটা, শহরাঞ্চলের চায়ের দোকান, ছোট ও মাঝারি হোটেলগুলিতে কাজ করছে নামমাত্র পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। দু'বেলা দু'মুঠো ভাতের তাগিদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে গৃহ-পরিচারিকা হিসেবে কাজ করছে বালিকারা।
কেন শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়? আর কীভাবে এই সমস্যা নির্মূল করা যেতে পারে? এ-ব্যাপারে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির মত, শিশুদের জন্য সর্বাগ্রে পুষ্টিকর খাদ্য এবং শিক্ষালাভের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
জনগণনার সর্বশেষ রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের যে শিশুশ্রমিকরা শৈশবকে উপভোগ করার পরিবর্তে শিশুশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে, ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেশের গ্রামাঞ্চলের বাসিন্দা ওরা। শিশুশ্রমিকদের নিয়ে কাজ করছে এমন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির দাবি, পঞ্চায়েতগুলির এব্যাপারে সচেতনতামূলক উদ্যোগ নেওয়াটা জরুরি। স্কুলছুট হয়ে শিশুরা যেন শ্রমিক না বনে যায় পঞ্চায়েতগুলির সে-বিষয়েও লক্ষ রাখা উচিত।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের অনুসন্ধানে ধরা পড়েছে, শিশুশ্রমিকদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশও ব্যাহত হচ্ছে। অভিযোগ উঠছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে। 'সবকা সাথ, সব কা বিকাশ' কি তাহলে মামুলি কথা? স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও স্বাধীন দেশের শিশুদের কপালে ঘাম ঝরছে আর দিনের শেষে ঝরছে চোখের জল। অথচ এই শিশুরাই দেশের ভবিষ্যতের নাগরিক।
২০০২ সাল থেকে বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে 'বিশ্ব শিশুশ্রমবিরোধী দিবস'। চলতি বছরের ১২ জুন এই দিনটি পেরিয়েছে। তাতে শিশুশ্রমিকদের দিন পাল্টায়নি গত ২০ বছরে। ভারতে শিশুরা মৌলিক অধিকারগুলি থেকে আজও বঞ্চিত। যদিও দেশের সংবিধানের ২৩ নম্বর ধারা এবং ২৪ নম্বর ধারায় শিশুশ্রম বেআইনি। এছাড়া ১৯৮৬ সালে প্রণয়ন করা চাইল্ড লেবার অ্যাক্ট প্রোহিবিশান অ্যান্ড রেগুলেশন অনুসারে ১৪ বছরের কমবয়সি কোনও শিশুকে শ্রমিক হিসেবে কাজ করানোটা বেআইনি।
শুধু ভারতই নয়, দুনিয়াজুড়েই বহু শিশুর জীবন কাটছে মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে। ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশনের রিপোর্ট অনুসারে, গত চার বছরে আবিশ্ব শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৮০ লক্ষ-রও বেশি বেড়েছে। 'বিশ্ব শিশুশ্রমবিরোধী দিবস' আজও আবিশ্ব কোটি কোটি শিশুশ্রমিকের জীবনের আর পাঁচটা সংগ্রামী দিনের মতো একটি দিন।
ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে শিশুশ্রমিকদের সংখ্যা-সংক্রান্ত যে খতিয়ান পেশ করেছে, সেই রিপোর্ট অনুসারে, দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশগুলির মধ্যে শিশুশ্রমিকের সংখ্যার নিরিখে ভারত সর্বোচ্চ স্থানাধিকারী। বর্তমানে ভারতে ৫০ লক্ষ-র বেশি শিশুশ্রমিক রয়েছে। এদিকে গত জনগণনার পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ছিল এর দ্বিগুণ।
অন্যদিকে, কৈলাস সত্যার্থী ফাউন্ডেশনের রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, গত চার দশকে ভারতে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ লক্ষ-র বেশি। এদের বয়স ৫ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে। ফলে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বিভিন্ন সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্টে নানা রকম।
তাও আশার আলো, আন্তর্জাতিক লেবার অর্গানাইজেশন শিশুশ্রম বন্ধর জন্য আন্তর্জাতিক আইন প্রণয়ন করেছে। ভারতেও শিশুদের শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানোটা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি। যদিও ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য হতাশাজনক। চাইল্ড লেবার প্রোহিবিশন অ্যান্ড রেগুলেশন অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে মোটে ১,৭১২টি এফআইআর দায়ের হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যানে।
শিশুশ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই নানা ধরনের পেশাগত রোগের শিকার। বিশেষত চর্মরোগের সমস্যা, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে যাওয়া, যক্ষ্মা, ফুসফুসের অসুখে আক্রান্ত বহু শিশু। এছাড়া শিশুশ্রমিকদের যৌন হেনস্থার ঘটনা উদ্বেগজনক বলে জানিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা।