বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতেও কালো চামড়ার সঙ্গে বৈষম্য! দায় আসলে কার?
Racism in Science: অ্যালগোদিম কেবল সাদা চামড়ার মানুষদের চিনতে শেখায়, কালো চামড়ার মানুষদের যন্ত্র হয় চিনতে পারে না, নয়তো ‘গোরিলা’ বা ‘শিম্পাজি’ হিসেবে চিহ্নিত করে
ছোটোবেলায় যখন মানুষের মুখ বা ছবি আঁকতেন, রঙ করার সময় হাতটা ঠিক কোন রঙে পৌঁছত? আপনি কি কোনও দিনও হলদেটে রঙ বাদ দিয়ে বাদামী বা কালো রঙে হাত দিয়েছেন? দেননি, তাই তো? দোষ যদিও আপনার নয় পুরোপুরি। বেশ কিছু ক্ষেত্রেই কেউ শিখিয়ে দিয়েছে ওই রঙটাই স্বাভাবিক, ওই রঙটাই সাধারণত মানুষের গায়ের রঙ। কোথাও বা আপনার অজান্তেই বৈষম্য আপনার মনের গভীরে গেঁথে গেছে। সমস্যার সূত্রপাত কিন্তু সেই তখন থেকে। সেই থেকে সাদা বা ফর্সাকেই গ্রহণযোগ্য এবং স্বাভাবিক রঙ বলে চিনে আসতে আমাদের শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই বৈষম্যমূলক আচরণের শিকড় এতটাই গভীরে পৌঁছে গেছে যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত জিনিসও বানানো হয় সাদা চামড়া বা তুলনামূলক ভাবে ফর্সা চামড়া যাঁদের, তাঁদের কথা মাথায় রেখে। সে রোগ নির্ণয়ের পদ্ধতিই হোক বা মেডিক্যাল ডিভাইস কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
যেমন ধরা যাক, পালস অক্সিমিটারের কথা। কোভিড মহামারি শুরুর পর থেকে হু হু করে বিকিয়েছে যন্ত্রটি। পালস অক্সিমিটার অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপতে ব্যবহার করা হয়। অক্সিজেন স্যাচুরেশনের অর্থ, কোনও একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে রক্তে অক্সিজেনের সঙ্গে আবদ্ধ না থাকা হিমোগ্লোবিনের তুলনায় কী পরিমাণ হিমোগ্লোবিন অক্সিজেনের সঙ্গে আবদ্ধ রয়েছে তার হিসেব। আপনি কি জানেন, পালস অক্সিমিটারে অক্সিজেন স্যাচুরেশনের যে রিডিংটি দেখায়, সেটা সাদা চামড়ার মানুষদের ক্ষেত্রে প্রায় নির্ভুল, কিন্তু কালো চামড়ার মানুষদের ক্ষেত্রে ত্রুটিপূর্ণ?
আরও পড়ুন- রামপুরহাট কান্ডে থ্রি-ডি লেজা়র স্ক্যানিং প্রযুক্তির ব্যবহার – কী এই প্রযুক্তি?
দেখা যাচ্ছে, কালো চামড়ার মানুষদের ক্ষেত্রে রক্তে আসলে যত শতাংশ অক্সিজেন স্যাচুরেশন, বাজারচলতি পালস অক্সিমিটারে তার থেকে বেশ কয়েক শতাংশ বেশি অক্সিজেন স্যাচুরেশন দেখায়। সুস্থ, স্বাভাবিক এবং সজাগ অবস্থায় রোগীর শরীরে ৯২ শতাংশের বেশি অক্সিজেন স্যাচুরেশন থাকে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৮৮ শতাংশের নীচে নেমে গেলেই তাকে হাইপোক্সেমিয়া বলে অর্থাৎ যে অবস্থায় অক্সিজেন স্বাভাবিকের তুলনায় কম থাকে। কালো চামড়ার মানুষদের ক্ষেত্রে ৮৮ শতাংশের নীচে অক্সিজেন স্যাচুরেশন নেমে গেলেও পালস অক্সিমিটারের রিডিং বলে তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন বিরানব্বইয়ের উপরেই রয়েছে। অথচ সাদা চামড়ার মানুষদের ক্ষেত্রে প্রায় নির্ভুল দেখায় সেই ফলাফল।
একটু বিশদে বলা যাক। কিন্তু তার আগেও সংক্ষেপে বলা যাক পালস অক্সিমিটার কীভাবে কাজ করে। পালস অক্সিমিটার থেকে লাল এবং ইনফ্রারেড রশ্মি বিচ্ছুরিত হয়। এই দুই রশ্মির তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলাদা। অক্সিজেনের সঙ্গে আবদ্ধ হিমোগ্লোবিন যতটা কার্যকারিতার সঙ্গে ইনফ্রারেড রশ্মি শোষণ করে, ততটা সে লাল রশ্মির ক্ষেত্রে করে না। আর ঠিক উল্টোটা দেখা যায় অক্সিজেনের সঙ্গে আবদ্ধ না থাকা হিমোগ্লোবিনের ক্ষেত্রে। তারা আবার লাল রশ্মিকে তুলনামূলকভাবে বেশি ভালো করে শোষণ করতে পারে।
বাজারচলতি পালস অক্সিমিটারে দু’টি তরঙ্গদৈর্ঘ্যের লাইট এমিটিং ডায়োড (বা এলইডি) থাকে- যাদের একটি লাল এবং অপরটি ইনফ্রারেড। এদের তরঙ্গদৈর্ঘ্য যথাক্রমে ৬৬০ ন্যানোমিটার এবং ৯৪০ ন্যানোমিটার। হিমোগ্লোবিন কী পরিমাণে কোন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের রশ্মি শোষণ করছে, তার একটি আনুপাতিক হিসেব এখান থেকে পাওয়া যায়। এই আনুপাতিক হিসেব থেকে রক্তে অক্সিজেন স্যাচুরেশনের মাত্রা আগে থেকেই ক্রমাঙ্কিত বা ক্যালিব্রেটেড রয়েছে। আর সেই ক্যালিব্রেশন অ্যালগোরিদম পালস অক্সিমিটারের মাইক্রোপ্রসেসারে সংরক্ষিত থাকে।
কালো চামড়ার মানুষদের ত্বকে মেলানিন থাকে বেশি, যা তৈরি হয় মেলানোসাইট থেকে। আর এই মেলানোসাইটের প্রভাবে লাল বা ইনফ্রারেড রশ্মির শোষণ এবং বিচ্ছুরণ প্রভাবিত হয়। সাদা চামড়ার মানুষদের তুলনায় কালো চামড়ার মানুষদের ত্বকে মেলানোসাইট কেবল বেশিই থাকে না, মেলানোসাইটের আকারও বড় হয়। শরীরে থাকা বিভিন্ন জৈব অণুর (যেমন মেলাটোনিন) প্রভাবে যে লাল ও ইনফ্রারেড রশ্মির শোষণ ও বিচ্ছুরণ বিঘ্নিত হতে পারে- এই বিষয়টিকে কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে মেনে আসা অক্সিমেট্রিক থিওরি হিসেবের মধ্যে ফেলে না। আর বিপত্তি হচ্ছে সেখানেই।
এ সমস্যা কালো চামড়ার লোকেদের সমস্যা বলে এড়িয়ে যেতেই পারেন, কিন্তু এখানে মনে রাখা দরকার, মেলাটোনিন গড়পড়তা ভারতীয়দের শরীরে কালো চামড়ার মানুষদের মতো না থাকলেও, বেশিই থাকে সাদা চামড়ার মানুষদের তুলনায়। মেলাটোনিন যত বাড়বে পালস অক্সিমিটার রিডিংয়ে ত্রুটির সম্ভাবনাও যে পাল্লা দিয়ে বাড়বে, এ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কালো চামড়ার মানুষরা এমনিতেই বৈষম্যের শিকার। উপরন্তু তাঁদের ক্ষেত্রে অ্যানিমিয়া, সিকল সেল ডিজি়জ, সিকেল সেল অ্যানিমিয়ার মতো গুরুতর সমস্যা রয়েছে। এই রোগগুলির ফলে হিমোগ্লোবিন কম থাকে তো বটেই, হিমোগ্লোবিনের অক্সিজেনবাহী ক্ষমতাও কমে যায়। ফলে ব্লাড স্যাচুরেশন দ্রুত হ্রাস পায়। পরিসংখ্যান বলছে, কোভিড মহামারীর সময় আফ্রিকান-আমেরিকানদের অসুস্থতার হার, হাসপাতালে ভর্তির হার এবং মৃত্যুর হার সাদা চামড়ার আমেরিকানদের তুলনায় অনেক বেশি। একই সমস্যা হিসপ্যানিকদের ক্ষেত্রে, যাদের চামড়ার রঙ বাদামী। ভারতীয়রাও যে এই সমস্যার শিকার হননি, তা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি না। আদতে আমাদের চামড়াও বাদামী বা বাদামীর দিকেই।
আরও পড়ুন- সবুজ রঙের বাজি মানেই কি পরিবেশবান্ধব? জানুন গ্রিন ক্র্যাকারের আসল সত্য
পালস অক্সিমিটার ছেড়ে আসা যাক আরেক বহুল ব্যবহৃত প্রযুক্তির আলোচনায়। আর তা হল আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, যা ওতোপ্রতোভাবে কম্পিউটার অ্যালগোরিদম নির্ভর। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আদতে মানুষের থেকে ধার করা বুদ্ধির মতো। বলা ভালো, মানুষই এখানে যেচে যন্ত্রকে বুদ্ধি দেয়। মানুষই যন্ত্রকে শেখায় অঙ্ক করতে, অক্ষর-বর্ণ চিনতে, রঙ চিনতে। অথচ মানুষ যা শেখায় না, তা হল মানুষের গায়ের রঙের ভিন্নতা।
বিশ্বজুড়ে সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোতে সাদা চামড়াওয়ালা মানুষদের রাজ। তারাই মূলত যন্ত্রদের শিখিয়ে-পড়িয়ে মানুষের মতো মানুষ, থুড়ি মানুষের মতো যন্ত্র বানায়। তারাই ফেশিয়াল রেকগনিশন অ্যালগোদিম বানায়। সেই অ্যালগোদিম কেবল সাদা চামড়ার মানুষদের চিনতে শেখায়, কালো চামড়ার মানুষদের যন্ত্র হয় চিনতে পারে না, নয়তো ‘গোরিলা’ বা ‘শিম্পাজি’ হিসেবে চিহ্নিত করে, জানা যাচ্ছে ২০২১ সালে অ্যালেক রাডফোর্ডের একটি প্রি-প্রিন্ট থেকে।
স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সিগন্যাল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কালো চামড়ার মানুষদের চিনতে পারে না। যার অবশ্যম্ভাবী ফল পথদুর্ঘটনা। অথচ এয়ারপোর্ট বা ট্রেন স্টেশনের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কালো চামড়ার মানুষদের আবার মুখ চিনে, রঙ মেপে তাঁদের সন্দেহভাজনের তালিকায় ফেলে দিতে পারে। অক্সিমেট্রির প্রচলিত থিওরি না হয় মেলানিনের মতো বায়োমলিক্যুলের উপস্থিতিকে হিসেবের মধ্যে ফেলে না কিন্তু মানুষ যখন যন্ত্রকে শিখিয়ে-পড়িয়ে স্বয়ংক্রিয় করে তোলে, তখন কালো চামড়ার মানুষকে হিসেব থেকে বাদই দিয়ে ফেলে!
সব ত্রুটি তো আর যান্ত্রিক ত্রুটি বলে দায় এড়ানো যায় না, তাই না?