মাছ-সবজির নিলামে শুরু ক্রিসমাস! কেষ্টপুরের বড়দিন এক অজানা অধ্যায়

Kestopur Christian Community : কেষ্টপুরের খ্রিস্টান উপনিবেশের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে দুশো বছর। এর নেপথ্যে আছে এক ভয়াবহ কালবৈশাখী ঝড়।

কেষ্টপুরের ক্রিসমাস! অবাক লাগছে? কলকাতার ক্রিসমাস বলতে অবশ্যই বোঝায় সাহেব পাড়ার কথা – পার্ক স্ট্রিট বা বো ব্যারাকস। একসময়ের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় শহর কলকাতাতে চিরকালই জাঁকজমক করে বড়দিন বা ক্রিসমাস পালিত হয়ে এসেছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও তার রেশ তো কমেইনি, বরং বেড়েছে। আজ পার্ক স্ট্রিট বা বো ব্যারাকস বড়দিনের আলোকসজ্জায় সেজে ওঠে। হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান কিন্তু কলকাতা ও তার শহরতলিতে বেশ কিছু খ্রিস্টান মহল্লা আছে। এই সব মহল্লাতেও বড়দিন পালিত হয়। জাঁকজমক হয়তো কিছুটা কম কিন্তু আন্তরিকতার কোনও খামতি নেই। এই রকমই এক মহল্লা কলকাতা শহরের পূর্বে অবস্থিত কেষ্টপুর। কেষ্টপুরে এক আদি খ্রিস্টান উপনিবেশ রয়েছে। কেষ্টপুরের মধ্যেই আছে খ্রিস্টান পাড়া ও মিশন পাড়া নামের লোকালয়ও।

ঝড় দিয়ে শুরু

কেষ্টপুরের খ্রিস্টান উপনিবেশের ইতিহাস ঘাঁটতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে দুশো বছর। এই বসতি স্থাপনের নেপথ্যে আছে এক ভয়াবহ কালবৈশাখী ঝড়। ১৮০৬ সালের এপ্রিল মাস, বিদ্যাধরী নদীর উপর ধেয়ে এল এক ভয়ানক কালবৈশাখী। বিদ্যাধরী নদী তখন নাব্যতা হারায়নি, বড় বড় জাহাজ চলত বিদ্যাধরী ধরে। সেই দিনের ভয়ানক ঝড়ের কবলে পড়ল ৪৭ টি জাহাজ, তার মধ্যে ৪২ টির সলিল সমাধি হয়। অতিকষ্টে রক্ষা পায় ৫ টি জাহাজ। ইংল্যান্ড, হল্যান্ড ও পর্তুগালের এই ৫ টি জাহাজ কেষ্টপুর খাল ধরে অধুনা কেষ্টপুর অঞ্চলে পৌঁছয়। স্থানীয় বাসিন্দারা ভাঙাচোরা জাহাজ থেকে নাবিক ও যাত্রীদের উদ্ধার করে আশ্রয় দেয়। উদ্ধারকারী দল আসা পর্যন্ত এই মানুষরা অস্থায়ী আস্থানাতেই থেকে যান। সেই সময় নরপিত সিং নামে এক স্থানীয় যুবক আর ১৪ বছর বয়সি ক্যাথারিন নামে এক পর্তুগিজ কন্যার মধ্যে প্রেম হয়। কিন্তু এই প্রেমের গন্তব্য কোথায়? সমাজ তো এমন প্রেমকে স্বীকৃতিই দেবে না। এই বিষয়টি বুঝতে পেরেই পালায় নরপিত আর ক্যাথারিন। নানা জায়গা ঘুরে এই প্রেমিক প্রেমিকা শেষমেশ পৌঁছন বেনারসে। নরপিত সিং সেখানে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন এবং ক্যাথারিনকে বিয়ে করেন। মাঝে বেশ কিছু বছর অন্যত্র কাটিয়েই ১৮১৮ সালে ফের ফিরে আসেন কেষ্টপুরে। লক্ষ্য খ্রিস্টধর্ম প্রচার।

আরও পড়ুন- কোনওকালেই নাকি ক্রুশবিদ্ধ হননি যিশু! চাঞ্চল্যকর দাবি বাইবেলে

বড়দিনের আগে কেষ্টপুরের এমানুয়েল গির্জাতে মাছ নিলাম

খ্রিস্টান উপনিবেশ

ধীরে ধীরে কেষ্টপুরের কিছু লোক খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হন। কেষ্টপুরে গড়ে উঠতে থাকে এক খ্রিস্টান উপনিবেশ। ১৮২৯ সালে তৈরি হয় প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টানদের এমানুয়েল চার্চ। প্রায় একই সময় রোমান ক্যাথলিকরাও তাদের গির্জা তৈরি করে ফেলে। এইভাবে কেটে যায় প্রায় ১৫০ বছর। এই সময় কেষ্টপুরের সমগ্র ও খ্রিস্টান জনসংখ্যা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। পুরনো ছোট গির্জাগুলোতে আর ভক্তদের স্থান হয় না। তাই সেগুলো ভেঙে ফেলে তৈরি হয়েছে বিশাল নতুন গির্জা। এক সুপ্রাচীন ইতিহাসকে ভেঙেই গড়ে ওঠে বর্তমানের গির্জাগুলি। বর্তমানে কেষ্টপুরে গির্জার সংখ্যা ৩। তবে বেশ কিছু বাড়িতে ব্যক্তিগত প্রার্থনা গৃহও আছে। এছাড়া রাস্তা আর খাল ধারে আছে বেশ কিছু যিশু, মেরি ও নানা খ্রিস্টান সেন্টদের মূর্তি, মাদার টেরেসার মূর্তিও আছে।

কেষ্টপুরের রাস্তার ধারে যিশুর জন্মের সময়ের দৃশ্য

বড়দিন উদযাপন

কেষ্টপুরের বড়দিন বা ক্রিসমাস উদযাপন হয় একমাস ধরে। শুরু হয় সাধারণত নভেম্বর মাসের শেষ রবিবার। শুরুটা হয় এক অদ্ভূত নিলাম দিয়ে। এক সময় কেষ্টপুর ছিল কৃষিকেন্দ্র। খেত থেকে উঠত তাজা ধান, ফসল। সঙ্গে থাকত টাটকা সবজি ও ফলমূল। আশেপাশের ভেড়ি থেকে আসত টাটকা মাছ। খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষরা তাদের খেতের ফসল, গাছের ফল ও পুকুরের মাছ নিয়ে চলে আসতেন গির্জায়, নিলাম হতো। নিলামের টাকা যেত গির্জার তহবিলে। আজ, না আছে খেত না আছে পুকুর। পুরো অঞ্চলটাই ভরে গেছে দেশলাই বাক্সের মতো বাড়িতে। কিন্তু এমানুয়েল চার্চের নিলাম আজও অব্যাহত। মাছের দোকানদার মাছ নিয়ে আসেন। মুদি নিয়ে আসেন চাল, ডাল ও ময়দা। সঙ্গে থাকে শীতের স্পেশাল পাটালি গুড় আর জয়নগরের মোয়া। মুরগি বিক্রেতা নিয়ে আসেন জ্যান্ত মুরগি, হাঁসও। বাড়ির গৃহবধূরাও এই নিলামে বাদ যান না, তাঁরা নিয়ে আসেন বাড়ির তৈরি কেক। সঙ্গে থাকে বাঙালির প্রিয় পাটিসাপটা ও পিঠে। সব মিলিয়ে জমজমাট ব্যাপার। হইহই করে নিলামে দর হাঁকা হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দাম ওঠে বাজারের থেকে বেশি কিন্তু ভক্তবৃন্দের তাতে কোনও। এই টাকা যাচ্ছে গির্জার তহবিলে, ফলে আপত্তির ঠাঁই নেই।

রাতে অলোকিত এমানুয়েল গির্জা

আরও পড়ুন- ‘খ্রিস্ট’ : ঈশ্বর নয়, রোমানদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী যিশুর প্রতিবাদের কাহিনি

বড়দিনের আগের রাতে হয় মিডনাইট মাস (প্রার্থনা) আর বড়দিনের সকালেও হয় মাস। দুটো মাসই সম্পূর্ণ বাংলাতে সঞ্চালিত হয়। হারমোনিয়ামে বাংলায় গান ধরা হয়। আর থাকে বাংলায় যিশু বন্দনা – যেন খানিক যিশু কীর্তন। সন্ধেবেলা সেজে ওঠে কেষ্টপুরের খ্রিস্টান ও মিশন পাড়া। চারিদিকে আলোর রোশনাই, পার্ক স্ট্রিটের আভাস মেলে খানিক। গির্জাগুলি সব ভেতর ও বাইরে আলো দিয়ে সাজানো হয়। গির্জা প্রঙ্গনে নানা মূর্তি দিয়ে যিশুর জন্মের সময়ের দৃশ্য গড়ে তোলা হয়। সান্টাক্লজের মূর্তি আর ক্রিসমাস ট্রি তো আছেই। কেষ্টপুরের রাস্তা ও খালের ধারের যিশু, মেরি আর অন্য মূর্তিগুলোও আলো আর মোমবাতিতে ঢাকা পড়ে। রাস্তার ধারে প্যান্ডেল গড়ে তাতেও যিশুর একখণ্ড জন্মদৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয়। কেষ্টপুর অঞ্চলের খ্রিস্টান পরিবারগুলি নিজেদের বাড়িও আলো, মোমবাতিতে সাজিয়ে তোলে। আসলে কেষ্টপুরের খ্রিস্টান পাড়ার উৎসব হলেও তা শুধু ওই এলাকাতেই, নির্দিষ্ট সম্প্রদায়েই সীমাবদ্ধ থাকে না। উৎসব তো এমনই। বড়দিন সকলের, সেখানে কোনও সীমানা নেই, কোনও বিভেদও না।

বড়দিনের সকাল বেলায় এমানুয়েল গির্জা

More Articles