কলকাতা শহরের 'পাগল'-রা সব গেল কোথায়?

Madman of Kolkata: কলকাতা শহরের নানা অঞ্চলে বা এলাকায় গত একশো বছরে নানা ধরনের 'পাগল' থাকতেন। প্রতিবেশী এবং পাড়ার লোকজন তাঁদের যথেষ্ট প্রশ্রয় দিত।

কলকাতা নিয়ে এত পুরনো কথা লিখতে লিখতে খেয়াল হলো, এসব মোটামুটি বইপত্র বা নথিদস্তাবেজ থেকে অনেকটাই ধার করা। আরশির দিকে চোখ পড়ে যায়। নিজেকে দেখি। মনে হয়, এই প্রায়-বৃদ্ধের কলকাতাও তো ঢের পুরনো। সেসব তো আমার অভিজ্ঞতারই অংশ। আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের ঘটনা বা চরিত্র কি কলকাতারই একটা সময়ের চালচিত্র নয়? কয়েকদিন আগে 'শ্যামবাজার মুখোমুখি' দলের একটি নাটক দেখতে গিয়েছিলাম আকাডেমি মঞ্চে। বন্ধুবর সুমন মুখপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে। সুমন আবার নবরূপে পরিচালনা করছে মহাস্রষ্টা উৎপল দত্তের কিংবদন্তি প্রতিম নাটক 'টিনের তলোয়ার'। সেই নাটকটিতে কলকাতা শহর, বিশেষত উনিশ শতকের শেষ পর্বের কলকাতা নগরী, প্রায় নায়কোচিত একটা চরিত্র হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। সুমন সেই কলকাতার গল্প আবার শোনালেন একুশ শতকে। এই যে প্রাচীন বা সেকালের 'বাবু' কলকাতা, তাকে উৎপল একভাবে, সেই পথেই একটু আলাদা প্রয়োগ এবং প্রেক্ষিতে সুমন হঠাৎ জাগাচ্ছেন কেন? একে বলা যেতে পারে একধরনের আড়াল এবং ইতিহাসের পুনর্ব্যবহার। স্মৃতির উপাদান হিসেবে, কোনও সন্দেহ নেই, উনিশ শতকের কলকাতার কোনও জুড়ি নেই। একদিকে সাহেব শাসকদল, অন্যদিকে মোসাহেব বাবুর দল আর একেবারে সাদামাটা সাধারণ কালা আদমির প্রবাহ। নতুন নতুন ঢেউ এসে লাগছে সনাতন সমাজে আর ধীরে ধীরে গ্রাম-শহরে নুয়ে পড়া-রেগে ওঠা মানুষের মুখ জটলা পাকাচ্ছে, হাসছে, তাঁদের নিয়ে বেয়াড়া রকমের মস্করা করছে!

মনে রাখতে হবে, উৎপল দত্ত এই নাটক লিখেছিলেন এবং মঞ্চস্থ করেছিলেন ১৯৭১ সালে। এই নাটকের ভূমিকায় উচ্ছ্বসিত হয়ে জানিয়েছিলেন, '... যাহারা মুৎসুদ্দিদের পৃষ্ঠপোষকতায় থাকিয়াও ধনীদের মুখোশ টানিয়া খুলিয়া দিতে ছাড়েন নাই। যাহারা পশুশক্তির ব্যাদিত মুখগহ্বরের সম্মুখে টিনের তলোয়ার নাড়াইয়া পরাধীন জাতির হৃদয় বেদনাকে দিয়াছিল বিদ্রোহ মূর্তি। ... যাহাদের উল্লসিত প্রতিভায় সৃষ্টি হইল বাঙালির নাট্যশালা, জাতির দর্পণ, বিদ্রোহের মুখপত্র। যাহারা আমাদের শৈলেন্দ্র সদৃশ পূর্বসূরি।'

আরও পড়ুন- এ কলকাতার মধ্যে আছে চৈনিক কলকাতা

এই প্রণিপাত অবশ্য শুধুই শ্রদ্ধানিবেদন নয়। সন্দেহ হয়, এর পেছনে কাজ করছে এক সুচতুর রাজনৈতিক কৌশল। ইতিহাসের সঙ্গে নানামাত্রার কল্পনা মিশিয়ে এই নাটক লিখেছিলেন উৎপল। প্রকৃতপক্ষে, ঔপনিবেশিক শাসন এবং নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন সহ নানা অত্যাচার এবং কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে এই নাটক সেযুগের বলিষ্ঠ প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের কাহিনি। ১৯৭১ সালের স্মৃতি ব্যবহার করতে করতে এই নাটকের মাধ্যমে কী বার্তা দিলেন পরিচালক এবং নাট্যকার? একাত্তরে বাংলা তথা কলকাতার রাজনৈতিক বাস্তবতার কথা মাথায় রাখতে হবে। আজকের পাঠক অবশ্য সে বিষয়ে তেমন অবহিত হয়তো নয়। কমিউনিস্ট পার্টি তিনভাগে ভেঙে যাওয়া, ক্ষণস্থায়ী যুক্তফ্রন্ট, নকশালবাড়ি আন্দোলন, পুলিশের অকথ্য নির্যাতন, রাজনৈতিক বন্দি হত্যা, গুন্ডামি, কনস্টেবল খুন, স্কুল-কলেজ বন্ধ, বোমার ধোঁয়া আর সর্বত্র মিলিটারির ভারী বুটের আওয়াজ! মৃণাল সেন পরিচালিত 'কলকাতা ৭১' ছবিতে যার বেশ তাৎপর্যময় বর্ণনা আছে। ওই বাস্তবতায় উনিশ শতক মুখোশের মতো। প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো, দর্শক তথা জনমানসকে একনায়কতন্ত্রী ক্ষমতাদর্পকে চ্যালেঞ্জ করতে শেখানো। রাষ্ট্রশক্তি ৭০-৭১ সালে, তেমনই এক নিরঙ্কুশ বলপ্রয়োগকে সারা দেশে এবং বিশেষত এই বঙ্গে প্রয়োগ করেছিল। উৎপল দত্ত সেই শক্তিমত্ততার সামনে নাট্য হাতিয়ার ব্যবহার করলেন। দর্শককে 'রাজনৈতিক' প্রতিরোধে শামিল করলেন। আবার, একুশ শতকের ২০২৪ সালে, হিন্দুত্ববাদী কেন্দ্রীয় সরকারের দমবন্ধ করা প্রতিবেশে, নিপীড়ন আর বাকস্বাধীনতা হরণের পরিপ্রেক্ষিত মনে রাখলে, নতুন মাত্রায়, নতুন বাস্তবে তাকে আয়ুধ হিসেবে ব্যবহার করাই সুমন মুখোপাধ্যায়ের মূল লক্ষ্য।

এইভাবেই একটা নাটক, মূল ঐতিহাসিকতা এবং স্মৃতিসমেত দুই আলাদা কালখণ্ডে, আলাদা সংকটের মোকাবিলায় ব্যবহৃত হতে পারে। এইরকম বহুস্তরিক ব্যবহারে পুরনো কলকাতা আর সাম্প্রতিকের কলকাতার একটা সূক্ষ্ম সেতুবন্ধ যেন তৈরি হয়ে যায়। পরিসর আর নিজস্ব স্থান-কালে আবদ্ধ থাকে না, সে যেন প্রতীকী হয়ে ওঠে। সমস্যার নিজস্ব স্থান-কাল-পাত্র জরুরি হয়ে ওঠে শিল্পপ্রক্ষেপে। নইলে বিশ্বস্ততা থাকে না। আবার অন্যদিকে, দর্শক বা শ্রোতা যদি নেহাত স্থান-কাল-পাত্রের গণ্ডিতে নিজেকে আটকে ফেলেন, তাহলে সংকট-সমস্যা-দ্বন্দ্বের সর্বজনীন আভাসটা পাবেন না। শিল্পক্ষেত্রে যে কোনও পরিসর, আমার মনে হয়, এই দ্বান্দ্বিক টানাপড়েনের মাধ্যমে এগোতে থাকে। একটা মাত্রায় সে সময়ের চিহ্ন, অন্য মাত্রায় সে সমসময়ের, হয়তো আরেক মাত্রায় সে সময়হীনতার প্রতিনিধি। অঃশীল সমস্যা একদিকে কালসাপেক্ষ এবং অন্যদিকে কাল নিরপেক্ষ। মহানগর নিয়ে এত কথা শোনাচ্ছি, সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার তাগিদেই।

আরও পড়ুন- প্রাচীন কলকাতায় এসেছিলেন ক্যাপ্টেন হ্যাডক!

কলকাতা শহরের প্রতিটি কোণে এবং অঞ্চলে প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন দৃশ্য নির্মাণ হচ্ছে। ইট-কাঠ-পাথর জড়বস্তু থেকে বিশেষ বিশেষ মানুষ, সবাই সেই স্মৃতিগঠনের কুশীলব। তারা অনন্য, আবার হয়তো কাল নিরপেক্ষও বটে। ভেবে দেখুন, এই কলকাতা শহরের নানা অঞ্চলে বা এলাকায় গত একশো বছরে নানা ধরনের 'পাগল' থাকতেন। প্রতিবেশী এবং পাড়ার লোকজন তাঁদের যথেষ্ট প্রশ্রয় দিত। কোনও অজানা কারণে, তেমন ঘটনা এখন খুব দেখতে পাই না। সেই পাগলরাও বিলুপ্ত। যদিও বাস্তবতার যা সমকালীন মাত্রা, তদুপরি অনিয়ন্ত্রিত গরম, তাতে ঘরে-ঘরে উন্মাদ তৈরি হওয়ার কথা। যাই হোক, আমার ঠাকুরদার মুখে শুনতাম তাঁদের ছেলেবেলায় কুমোরটুলি অঞ্চলে ছিলেন 'নন্তে-পাগলা' নামের এক অদ্ভুত চরিত্র। আমাদের পাড়ায় ছিলেন 'নিতাই পাগলা' এবং নিমাইদা। নিমাইদার বাবা ছিলেন সিনেমার অভিনেতা। 'গল্প হলেও সত্যি'-র বুড়ো দাদুর চরিত্রে তিনি অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। একমুখ দাড়ি, ভবঘুরে উন্মাদ নিমাইদা তাঁরই ছেলে। সাহিত্যেও দেখি জটায়ুর স্মৃতিচারণায় 'হেদোর ধারের পাগল', আবার রণজিৎ দাশের কবিতায় সন্ধ্যার এবং দিনের নানা সময়ের পাগল। বিচিত্র এদের কীর্তিকলাপ। মহানগরের এরা অঙ্গ এবং প্রতীক। ঋত্বিক ঘটক তাঁর 'জ্বালা' নাটকে এমনই এক পাগলের অন্যমুখ ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।

নিজের কথায় ফিরে আসি। কোনও প্রগলভ আত্মকাহিনি নয়, কয়েকটি স্থান-কাল-পাত্র নিয়ে কথা বলতে চাইব। সাধারণ দু-একটি মানুষ, তাঁদের সামান্য-অসামান্য কীর্তিকলাপ, মুহূর্তযাপন। কালপারাবারে এমন অনেক মানুষ আর তাদের ইতিবৃত্ত স্বাভাবিক প্রবাহে হারিয়ে যায়। স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যম ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্তের 'কলিকাতার পুরাতন কাহিনি ও প্রথা' বইটিতে এমন অনেক তৎকালীন মানুষের সাধারণ জীবন মুহূর্তের ছবি ধরা আছে। সেখানেই তিনি একটি তৎকালীন প্রবাদ উল্লেখ করেছেন। 'সিমলার মাতাল আর বাগবাজারের গেঁজেল'। এখনকার কলকাতার সিমলাপাড়া এবং বাগবাজারের দিকে তাকালে নিশ্চয়ই এই প্রবাদের প্রসঙ্গে হাসি পাবে। ওই বইতেই বলা আছে, সে যুগে বাঙালি গৃহপরিচারক বা চাকরদের গোঁফ রাখা নিষিদ্ধ ছিল। 'চাকর যে মনিবের কাছে গোঁফ নেড়ে কথা কইবে এটা বড় অপমান'। এই আশ্চর্য আইনের বিরুদ্ধে অভূতপূর্ব একটা প্রতিবাদও সংগঠিত হয়েছিল। '১৮৯৭ বা এই সময়ের সব চাকরেরা এক সভা করিল এবং এক দরখাস্তে জারী করিল যে চাকরেরা গোঁফ রাখিতে পারিবে না কেন? কিন্তু তাহাদের সেই দরখাস্ত কেহ মঞ্জুর করিল না, এখনও বোধহয় সেই আইন চলিয়া আসিতেছে।' শেষ বাক্যটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মহেন্দ্রনাথ দত্ত লেখাগুলির সিংহভাগই লিখেছিলেন ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে। এখন, আমি কোনও ইতিহাস গ্রন্থ কিংবা কলকাতার মান্য ইতিহাসচর্চায় মনিবদের সঙ্গে গোঁফ রাখা নিয়ে চাকরদের দ্বৈরথের প্রসঙ্গ শুনিনি। চাকরদের দিক থেকে ইতিহাস লেখার কোনও সুযোগ তখন ছিল না। ১৮৬০ নাগাদ লেখা হুতোম পেঁচার নকশাতেই সম্ভবত একমাত্র কলকাতার নিম্নবর্গের মানুষজনদের জীবন নিয়ে কিছু বাস্তবচিত্র খুঁজে পাওয়া যাবে।

আরও পড়ুন- জীবনানন্দ তৃতীয় নয়নে দেখেন বিশ্বযুদ্ধোত্তর কলকাতা

ঠিক সেভাবেই ব্যক্তিস্মৃতি থেকে আমি কয়েকজন মানুষের কথা এবার পেশ করব। জায়গার নাম কলেজ স্ট্রিট। সাতের দশকের মাঝামাঝি থেকে নয়ের দশকের গোড়া পর্যন্ত হেয়ার-হিন্দু-সংস্কৃত স্কুলের ছাত্ররা তো বটেই, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও সকলে জানত ধেনু-র নাম। কে এই ধেনু? হেয়ার স্কুলের মূল ফটকের বাঁ-দিকে, হিন্দু স্কুলের উল্টোদিকে ধেনুর শরবতের দোকান। দোকান বললে ভুল হবে। একটা চৌকো পাটাতন, তলায় ছ-টা চাকা লাগানো। সেই কাঠের পাটাতনে হরেক রঙের, নানা স্বাদের সিরাপের বোতল। ধেনু সেখানে একটা বরফ কাটার করাত লাগানো কাঠের পিঁড়ের ওপর বরফ ঘষছে আর ভাঁড়ে বা বোতলে সিরাপে মিশিয়ে খদ্দেরের হাতে তুলে দিচ্ছে। ধেনুর দোকানে সবসময়ই হালকা ভিড় লেগে থাকত, আর ছুটির সময় সেটা চূড়ান্ত চেহারা নিত। তিন-তিনটে স্কুলের ছাত্রদের হাজার বায়না সামলাত ধেনু। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তিন দশক ধরে ছাত্রদের মুখে তাঁর নাম ছিল ধেনু। কস্মিনকালেও ধেনুদা বা ধেনুকাকা বলতে কাউকে শুনিনি। মোটামুটি ওই তিন দশকের ছাত্রস্মৃতিতে ধেনু উজ্জ্বল হয়ে আছে। ছাত্রদের সঙ্গে ধমক, খুনসুটি, মজা-মস্করা সবই করতো ধেনু। আমাদের এক বন্ধু অসুস্থ হয়ে পড়লে সে যুগে বাড়ি নিয়ে যেতে ট্যাক্সি ভাড়া পঞ্চাশ টাকা দিতে ধেনু কার্পণ্য করেনি। শুনেছি কখনও কখনও পরীক্ষার টাকা জোগাড় না হলে ধেনু ধারও দিয়েছে। আমরা যখন হিন্দু স্কুলের ছাত্র, ধেনু তখন বছর ত্রিশ-বত্রিশ। সে হলো সত্তরের শেষের দিকের বছরগুলো। ধেনু সম্ভবত বাঙালি ছিল না। সেসময় মুখে-মুখে একধরনের হিন্দিভাষী মানুষদের বলা হতো 'হিন্দুস্থানি'। তাঁরা উত্তরপ্রদেশ, বিহার না হরিয়ানার লোক ছিলেন, কে জানে! ধেনু অবশ্য বেশ পরিষ্কার বাংলা বলত। এখন কলেজ স্ট্রিটে গেলেই আমার ফুটপাথের ধারের সেই গাছ আর ধেনুর শূন্যস্থানে চোখ চলে যায়। তার কথা বলবে না মান্য কোনও ঐতিহাসিক কিন্তু তার উপস্থিতি আজও অনুভব করা যায়! আমাদের কয়েকজনের আয়ু ফুরোলে ধেনুও অন্তর্হিত হবে লোকমানস থেকে। নতুন কোনও চেহারার ধেনু আসবে। আমাদের সিনিয়র বা জুনিয়ররা ধেনুকে নিয়ে আরও নানা বিচিত্র গল্প বলতে পারবে, আমি জানি। আমি শুধু বলছি, এক-একটা প্রজন্মের স্মৃতিবিন্যাসে অনেক ধেনুর মতো মানুষ জড়িয়ে থাকে।

দ্য শো মাস্ট গো অন!

More Articles