বুড়ো না হলে মেসির জ্বলে ওঠা অধরাই থেকে যেত
Lionel Messi: আগের থেকে ঢের বেশি ভঙ্গুর হয়েও অসীম কার্যকরী মেসি এমন একজন, যাঁর জন্য সর্বস্ব বাজি রেখে খেলোয়াড়েরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন কাপ জেতার লক্ষ্যে।
পেশাদার স্পোর্টসের দুনিয়ায় বয়স একটা চিরন্তন ভীতি। অবসরের বয়স যত এগিয়ে আসে তত ঘিরে ধরে অনিশ্চয়তা। জমকদার সাফল্যের ধনাঢ্য পৃথিবীতে সেই অনিশ্চয়তা অর্থনৈতিক না হলেও এতটাই জোরালো যে কখনও কখনও তা ডেকে আনতে পারে অস্তিত্বের সংকট। পেশাদার স্পোর্টসের অ্যাথলিটদের জ্ঞান হওয়া ইস্তক তাঁদের জীবন মোটামুটি আবর্তিত হয় যে খেলা ঘিরে, সেই খেলার মাঠে সক্রিয়ভাবে যুক্ত থাকার মেয়াদ ফুরনোর ভয় সীমাহীন। তাই বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই আদতে যযাতির মতো চিরযৌবনলিপ্সু।
অ্যাথলিটদের মধ্যে যাঁরা সেরার সেরা, তাঁদের অনেকের মধ্যেই একটা প্রবণতা দেখা যায়। বয়স দুর্বলতার বদলে হয়ে ওঠে তাঁদের শক্তি। ফুটবলের উদাহরণই যদি টানি, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে গেম রিডিং সেন্স, তীক্ষ্ণ হয় ট্যাক্টিকাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং, গতির অভাবকে তাঁরা পুষিয়ে দেন বুদ্ধিদীপ্ত কায়দায় এনার্জি বাঁচিয়ে তা ঠিক সময়ে প্রয়োগ করার প্ল্যানিংয়ে।
ফুটবলের মাঠে বহুবার দেখেছি খেলোয়াড়ের বয়স হলে প্রেমের মতো পাক ধরে ম্যাজিকেও, রোমান্স ঘনীভূত হয়। যাঁদের খেলা দেখে এ কথা বারবার মনে হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম লিওনেল মেসি। আমার যা বয়স, তাতে মেসির ঝলমলে তারুণ্যের জৌলুস লাইভ দেখার সৌভাগ্য সেভাবে হয়নি। যখন খেলা মোটামুটি বুঝতে শিখেছি, তখন মেসি উইং ছেড়ে ধীরে ধীরে আপন করে নিচ্ছেন একেবারে মার্কামারা দশ নম্বর ভূমিকাটা। গোল করছেন প্রচুর। পাশাপাশি গোল করাচ্ছেনও প্রচুর।
আরও পড়ুন- মেসি না রোনাল্ডো, কাদের নিজের সর্বকালের সেরার তালিকায় জায়গা দিয়েছিলেন পেলে?
মেসির বয়স বাড়ছে, এই কথাটা প্রথম আলোচিত হতে দেখেছিলাম মেসির ত্রিশতম জন্মদিনের আশেপাশে। ফুটবলে এই ত্রিশ সংখ্যাটা বড় ভয়ের। কেরিয়ারের যাকে 'পিক' বলে তা অস্তমিত হওয়ার সময়। মধ্য-ত্রিশের মধ্যেই বেশিরভাগ খেলোয়াড় অবসর জীবনের দিকে ঢলে পড়েন। মেসিকে অবশ্য তিরিশে মোটেই অবসরের জন্য ব্যস্ত বলে মনে হতো না। একত্রিশ বছর বয়সে নিজের জীবনের সবচেয়ে অসন্তোষজনক বিশ্বকাপ কাটিয়ে এসে বার্সেলোনার জার্সিতে প্রায় একার তেজে বার্সাকে জিতিয়েছিলেন লীগ আর কোপা দেল রে। আশ্চর্যরকম মানসিক দুর্বলতা দেখিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স লীগ সেমিফাইনালে অমনভাবে বার্সেলোনা না হারলে প্রায় ব্যক্তিগত নৈপুণ্যেই একটা অচিন্তনীয় ট্রেবলের দোরগোড়ায় মেসি পৌঁছে দিয়েছিলেন তাঁর ক্লাবকে। এই সময়কার মেসির খেলায় আশ্চর্য এক কনফিডেন্স দেখতে পেতাম। নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদে কোনও ছটফটানি ছিল না তখন। সমাহিত হয়ে জিনিয়াসের প্রয়োগ ঘটাতেন তাক বুঝে। বহু ম্যাচে অনেকটা সময় নিষ্প্রভ থেকে হুটহাট জ্বলে উঠতেন। বার্ধক্যের ছাপ স্পষ্ট ছিল। জরা একটুও ছিল না।
জাতীয় দলের হয়ে মেসির খেলা হঠাৎ নতুন করে কার্যকরী হয়ে উঠতে থাকল যখন তখন মেসির বয়স চৌত্রিশ। সেই কোপা আমেরিকায় আর্জেন্তিনার প্রায় প্রতিটি গোল তিনিই করেছিলেন বা করিয়েছিলেন। যেসব ম্যাচে তা করেননি, সেসব ম্যাচে একাই বিপক্ষ ডিফেন্সকে কুচি কুচি করেছেন। কোপার মেসির খেলায় বয়সের আরেকটা প্রয়োজনীয় ছাপ দেখা গেল। তাঁর নেতৃত্ব এক নতুন চেহারায় প্রকাশ পেল। যেসব খেলোয়াড়েরা তাঁর সঙ্গী হলেন এই কোপায়, তাঁদের অনেকেই তাঁর পুরনো সতীর্থ, কাছের বন্ধু আর বাকিরা ছেলেবেলা থেকে মেসির সঙ্গে খেলার স্বপ্ন দেখে এসেছেন। মেসির অধিনায়কত্ব তাই অদ্ভুত এক সম্মান লাভ করেছিল। এমন অটল শ্রদ্ধা সতীর্থদের থেকে খুব কম অধিনায়কই পেয়েছেন। মেসি, বৃদ্ধ মেসি, আগের থেকে ঢের বেশি ভঙ্গুর হয়েও অসীম কার্যকরী মেসি হয়ে উঠেছিলেন এমন একজন, যাঁর জন্য সর্বস্ব বাজি রেখে খেলোয়াড়েরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন কাপ জেতার লক্ষ্যে। অল্পবয়সে মেসি যা হতে পারেননি, বেশি বয়সে মেসি সেটাই ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন: আর্জেন্তিনার প্রতিভূ। তাঁকে নিয়ে কাপ জেতার প্রতিজ্ঞায় আর্জেন্তিনা এবং মেসির ট্রফি খরা এক হয়ে যায়।
আর্জেন্তিনা সেই কোপা জিতেছিল। তারপরের বছরে বিশ্বকাপে প্রথম ম্যাচে হেরে যাবার পর মেক্সিকোর বিরুদ্ধে ডেডলক ভাঙার ওই অনিন্দ্যসুন্দর গোল দিয়ে যখন মেসি দৌড় মারলেন, তখন সবাই জানতেন সাড়ে পঁয়ত্রিশেও তিনিই আর্জেন্তিনার সবচেয়ে বড় আশা ভরসা। আর মেসি সেরকমই খেললেন। ইতিহাসের সর্বসেরা টুর্নামেন্ট প্রদর্শনগুলোর পাশে জ্বলজ্বল করার মতো একটা বিশ্বকাপ কাটালেন তিনি। একটি মাত্র গ্রুপ ম্যাচ বাদে গোল করলেন প্রতি ম্যাচে। তার মধ্যে দুটো ফিনিশ প্রতিযোগিতার অন্যতম সেরা। অ্যাসিস্ট করলেন তিনটে। তার মধ্যে দুটো টুর্নামেন্টের শ্রেষ্ঠ দুই অ্যাসিস্ট। ফাইনালে আর্জেন্তিনার প্রথম গোল পেনাল্টিতে দেবার পর, দ্বিতীয় গোলের মুভে দুটো আশ্চর্য টাচ খেলেছিলেন আর অতিরিক্ত সময়ে দিয়েছিলেন দলের তৃতীয় গোলটা। নিজের দ্বিতীয় বিশ্বকাপ সোনালি বল জিতে নিয়ে মেসি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন যে, ট্যাকটিক্সের কচকচির বাড়াবাড়ির দুনিয়ায় যখন ফুটবল খেলাটাকে প্রচণ্ড মাইক্রোম্যানেজ করে যাবতীয় আনপ্রেডিক্টেবিলিটির মজা শুষে নেওয়া হচ্ছে, তখনও ফুটবল খেলার প্রাণ লুকিয়ে আসলে মুহূর্তের ম্যাজিকে। আর মুহূর্তের ম্যাজিক গড়ে তুলতে লাগে অভিজ্ঞতাজনিত যে গভীর বোধ, সে বোধ অমন ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা আর নিরলস পরিশ্রম সত্ত্বেও মেসির করায়ত্ত হয়নি বয়স বাড়ার আগে।
আরও পড়ুন- মধ্যরাতে ফুটবল ম্যাজিক, মেসির ৮০০তম গোল, বিশ্বজয়ের মুহূর্তই যেন ফিরে এল আর্জেন্টিনায়
এই বিশ্বকাপেও মেসির অধিনায়কত্বে অভিজ্ঞতার প্রলেপ তাঁকে সাহায্য করেছে। যে মেসি ঝামেলা লাগলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে এড়িয়ে যেতেন, সেই মেসিই পঁয়ত্রিশে পৌঁছে হঠাৎ হয়ে গেলেন দস্তুরমতো কনফ্রন্টেশনাল। আবেগের ঘাতপ্রতিঘাতে টালমাটাল নেদারল্যান্ডস ম্যাচে তাঁর আগ্রাসী শরীরী ভাষা দলের আত্মপ্রত্যয়কে আরও শাণিত করে তুলেছিল। মেসিকে যে 'প্যাশন' কোনওদিন চোখে আঙুল দিয়ে বোঝাতে হয়নি, দেশের হয়ে বিশ্বকাপ জেতার সময়ে তাঁর সেই 'প্যাশন'-কে তিনি প্রকট করে তুললেন। এই প্যাশন যে দেশকে, দলকে, ভক্তদের, একজোট করে দলের রোখ আরও বাড়িয়ে তুলবে, এটা বুঝতে ফুটবলের থেকেও বেশি লাগে জীবনবোধ। বয়স না হলে, তা হবেই বা কেমন করে?
মেসি যত বুড়িয়েছেন, তত তিনি নিজের মাপ বুঝেছেন। তিনি যে আর পাঁচজন ফুটবল প্লেয়ার নন, সেই সত্যটাকে ব্যবহার করেছেন নানাভাবে। সেটা বার্সেলোনার ওই অদ্ভুত অবক্ষয়ের সময়ে নিজের কমফোর্ট জোন বজায় রেখে পারফরমেন্সের মান রক্ষার মাধ্যমেই হোক আর জাতীয় দলের হয়ে একেবারে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করাই হোক। মেসির বয়স বেড়েছে। মেসির খেলা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে। মেসি আরও গভীরে নিজেকে বুঝেছেন। যেকোনও জাতশিল্পীর মতোই, নিজেকে চেনা সম্পন্ন করার পর, সেই পরিচয়ের উষ্ণতা আর বোধের আলোকে নিজেকে রাঙিয়ে নিয়ে, তবেই মেসি উঠতে পেরেছেন তাঁর চূড়ান্ত শিখরে। মেসি বুড়ো না হলে, মেসির সবচেয়ে বড় ক্লাইম্যাক্স অধরাই থেকে যেত।