১২ অক্টোবর- আমেরিকায় পা রাখলেন কলম্বাস

আজ থেকে ঠিক ৫২৯ বছর আগে আজকের দিনেই ঘটেছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা যা পাল্টে দিয়েছিল পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। কী সেই ঘটনা? 

সালটা ১৪৫১, ইতালির জেনোয়া শহরে এক উল ব্যবসায়ীর কোলে জন্ম নিল এক ফুটফুটে সন্তান। বাবা-মা ভালোবেসে নাম রাখলেন ক্রিস্টোফার। পুরো নাম ক্রিস্টোফার কলম্বাস। ছোট থেকেই ছেলেটা আর পাঁচটা শিশুর থেকে আলাদা, তার ছোট্ট ছোট্ট চোখে সবসময় যেন লেগে আছে অপার বিস্ময়, অশেষ কৌতূহল। খেলাধুলায় বিশেষ মন লাগত না তার। তাই ছোট বয়সেই সে একটি বণিক জাহাজে কাজ করতে শুরু করল। বছরের পর বছর সমুদ্রে থাকত ওইটুকু ছেলেটা। সমুদ্র তার অভ্যাসে পরিণত হল, সমুদ্রই তার খিদে, সমুদ্রই তার নেশা হয়ে উঠল। সমুদ্রের অগাধ বিস্তৃতি তাকে মুগ্ধ করত, খুলে দিত তার মনের কোটরে লুকিয়ে থাকা বিস্ময়ের তালা। 'কোথায় এর শেষ, কোথায় আছে ডাঙা?', এই একই প্রশ্ন তার চিত্তে লেগে থাকত সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়ে, সন্ধ্যা থেকে রাত বেয়ে সকাল অবধি। 

১৪৭৬ সাল। বছর পঁচিশ বয়সের ক্রিস্টোফারের বণিক জাহাজটিতে জলদস্যুরা হামলা করে। জাহাজ তখন পর্তুগিজ উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভাসছিল। তাঁর জাহাজ ডুবে যায়, কিন্তু তিনি বেঁচে যান। একটা ছোট্ট কাঠের টুকরোর ওপর ভেসে তীরে এসে পৌঁছান তিনি। যেখানে এসে পৌঁছান সেই জায়গার নাম লিসবন। সেখান থেকেই তিনি পড়াশোনা করেন। এখানেই তিনি শেখেন গণিতবিদ্যা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, কারটোগ্রাফি এবং নেভিগেশন।

ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার জীবদ্দশায় আটলান্টিক মহাসাগরের বুকে মোট ৪টি অভিযান করেছিলেন। প্রথমটি ১৪৯২, দ্বিতীয়টি ১৪৯৩, তৃতীয়টি ১৪৯৮ এবং শেষ যাত্রাটি তিনি ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে করেন। তিনি বদ্ধপরিকর ছিলেন যে ইউরোপ থেকে এশিয়া অবধি কোনও না কোনও সরাসরি জলপথ তিনি আবিষ্কার করবেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের কথা হল তিনি পারেননি ইউরোপ থেকে এশিয়া অবধি কোনও সরাসরি জলপথ আবিষ্কার করতে। অথচ তিনি আবিষ্কার করে ফেলেন অন্য কিছু, যে আবিষ্কার গোটা পৃথিবী বদলে দেয়। কী সেই আবিষ্কার? উত্তরটা সকলেই জানে- আমেরিকা! 

ইউরোপ থেকে এশিয়া পৌঁছানোর স্থলপথ ছিল বহু লম্বা, দুর্গম এবং বিপদবহুল। রাস্তায় নদী, দুর্ভেদ্য পাহাড় এবং শত্রু লুটেরাদের সম্মুখীন হতে হতো আকছার। পর্তুগীজ অনুসন্ধানকারীরা এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে নামলেন সমুদ্রে। 

১৪৯২ সালের ৩রা আগস্ট, বহু অপেক্ষার পর কলম্বাস তার তিনটে বোট যথা নিনা, পিন্টা আর সানটা মারিয়াকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন স্পেন থেকে। দীর্ঘ ২মাসের বেশি সমুদ্রে থাকার পর কলম্বাসের তিনটি জাহাজ এসে পৌঁছায় বিশাল স্থলভুমির তীরে। সে দিনটাও আজকের মতোই ১২ই অক্টোবর, সাল ১৪৯২। কলম্বাস এশিয়ার খোঁজে বেরিয়েছিলেন বটে, কিন্তু বাহামিয়ান দ্বীপপুঞ্জে তিনি সেদিন যে স্থলভুমির সন্ধান খুঁজে পান তার বর্তমান নামই আমেরিকা। মাসের পর মাস তিনি সেখানে থাকেন, এক দ্বীপ থেকে আরেক দ্বীপে যান হিরে জহরতের খোঁজে। কিন্তু তিনি জানতেন না, মণি-মানিক্যের থেকে অনেকগুণ বেশি আবিষ্কার তিনি ইতিমধ্যেই করে ফেলেছেন; যার নাম  আমেরিকা।

কলম্বাস তার এই সুদীর্ঘ যাত্রার একটা পুঙ্খানুপুঙ্খ জার্নাল লিখতেন তার ডায়েরিতে। সেই ডায়েরিতে তিনি লিখতেন সমুদ্রের বিভিন্ন প্রাণীর দর্শনের ব্যাপারে, আবহাওয়ার ব্যাপারে, এমনকী নিজের জাহাজের সহকর্মীদের মেজাজের ছোট্ট ছোট্ট মোড়গুলোও তিনি লিখে রাখতেন। পরবর্তীকালে তিনি তার এই অমূল্য ডায়েরি উপহার দেন ইসাবেলাকে, যিনি তার অর্ধাঙ্গিনীও ছিলেন। 

১২ই অক্টোবর ১৪৯২ সালে কলম্বাস যে আমেরিকায় পৌঁছান, এমন নয় যে সেখানে কোনও জনবসতি ছিল না। লক্ষ লক্ষ লোকের বসবাস ইতিমধ্যেই ছিল সেখানে। কলম্বাসের আমেরিকায় আবির্ভাব সেই অর্থে আমেরিকার আবিষ্কার ছিল না। আমেরিকা আবিষ্কার হয়েছিল ১১০০ শতাব্দীতে, লিফ এরিকসন নামের এক অনুসন্ধানকারী প্রথম পা রাখেন সেখানে। কিন্তু কলম্বাসের আমেরিকায় আবির্ভাব বহির্জগতের কাছে আমেরিকার দুয়ার খুলে দিল। একে একে বিভিন্ন দেশ থেকে মানুষ এসে উপনিবেশ স্থাপন করতে শুরু করলো আমেরিকায়। নতুন বিশ্ব স্থাপন হল। বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের আমদানি রপ্তানির সঙ্গে এলো এবং গেল সংস্কৃতি, রোগ, সভ্যতাও। বিবর্তন ঘটলো। গাঁথা হলো নতুন সভ্যতা। প্রথম বিশ্ব সভ্যতা। 

ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে এই পৃথিবী মনে রেখেছে এক দুঃসাহসিক অনুসন্ধানকারী হিসাবে। অন্যদের থেকে একদম আলাদা ভাবে ভাবতেন তিনি, সাবেকি চিন্তার বাইরে বেরিয়ে নিজস্ব দাবার ছক তৈরি করতেন তিনি। জীবদ্দশায় তিনি আরও যে তিনটি অভিযান করেন, তাতে হাত খালি অবস্থাতেই ফিরে আসেন। নতুন কোনও আবিষ্কারের শিরোমনি আর তার কপালে জোটে না। কিন্তু তিনি যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিনে অভিযানে যাওয়ার জন্য ছটফট করেছেন। 

১৪৯৮ সালে আমেরিকার তাইনো প্রজাতির লোকেদের ওপর চরম অত্যাচারের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় কলম্বাসকে। যে তাইনো প্রজাতিরা সংখ্যায় প্রায় আড়াই লাখ ছিল ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা পৌঁছানোর আগে, সেই তাইনোরাই সংখ্যায় মাত্র ৬০ হয়ে গেছিলো কিছু বছরের মধ্যেই। স্বাভাবিক ভাবে আন্দাজ করাই যায় বাইরে থেকে আসা মানুষেরা তাদের ওপর যথেচ্ছ অত্যাচার চালিয়েছিল। যার মধ্যে কলম্বাস অন্যতম। ১৫০২ খ্রিস্টাব্দে কলম্বাসকে সমস্ত অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। বয়স্ক কলম্বাস, জেল থেকে বেরিয়ে স্পেনের সরকারের কাছে আটলান্টিকের বুকে একটা শেষ অনুসন্ধানের প্রার্থনা করলেন। সে'বারে কলম্বাস গিয়ে পৌঁছান পানামায়। এবং খালি হাতেই ফেরত আসেন। ১৫০৬ সালে এই যুগান্তকারী অনুসন্ধানকারী মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর ৫০০ বছর পর, তার আবিষ্কার আমেরিকা এখন লক্ষ তারার মাঝেও ধ্রুবতারা হয়ে জ্বলজ্বল করে নক্ষত্রখচিত আকাশে। কলম্বাস হয়তো কোনও তারার মতই দূর থেকে সবটা দেখেন, আর মিটিমিটি হাসেন। 

More Articles