প্রকল্প তুমি কার! মমতার দাবি আর শুভেন্দুর নালিশের মাঝে কেমন আছে রাজ্যের উন্নয়ন?

Suvendu Adhikari: শুভেন্দু অধিকারী গত ৬ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লেখা চিঠিতে দাবি করেন, মোট ৭টি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদল করে রাজ্যের নামে চালাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

মীরজাফর! বিশ্বাসঘাতক! বেইমান! গদ্দার! ২০২০ সাল। রাজ্যে নজিরবিহীন বিধানসভা নির্বাচনের প্রাকমুহূর্তে বারবার হিল্লোল তুলেছে এই শব্দবন্ধ। একদা ‘বন্ধুর শত্রু’ হওয়ায় চাপে পড়েন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তখন অস্বস্তিতে তৃণমূল কংগ্রেস, ২০২১ আসতেই যা বাড়ে আরও। রাজ্যে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখা শুভেন্দু-মুকুলময় বিজেপির স্বপ্নপূরণ না হলেও মমতার বিপুল জয়ে কাঁটা হয়েছে তাঁর ‘মেজবোন’ নন্দীগ্রাম। হারতে হয়েছে পুরনো কাছের মানুষের কাছেই! শুভেন্দু-অস্ত্রে বধ হয়েছেন মমতা। কিন্তু ভোট আসে ভোট যায়, এই প্রবাদের মধ্যেও বঙ্গের রাজনীতি শান্ত হয়নি কোনও দিন। কিছু না কিছুতে অগ্নিসংযোগ হয়েছে বারবার। কোনও না কোনও ক্ষেত্রে চাপে পড়েছে শাসক। পাল্টা উত্তাল হয়েছে বিরোধী ঘর। আর বঙ্গের রাজনৈতিক আঙিনায় এর প্রভাব পড়েছে সর্বাধিক। একের পর ইস্যুতে উত্তাল হয়েছে বাংলার রাজনীতি, উন্নয়ন।

এবার সেই ইস্যুতেই যোগ দিয়েছে কেন্দ্রের প্রকল্প। ‘আমার না তোমার’, এই সূত্রেই বারবার উঠে এসেছে সবটা। মমতা বলেছেন, বঞ্চিত আমরা। বিজেপি বলেছে মিথ্যা বলছেন ওঁরা। তৃণমূল বলেছে, বিমাতৃসুলভ আচরণ, শুভেন্দু বলেছেন দুর্নীতি। নিয়োগের কারচুপি, আদালত, গরুপাচার, কয়লা-কাণ্ডের আবহে চাপ বাড়িয়েছে এই কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে একাধিক অভিযোগ।

ঠিক কী অভিযোগ উঠেছে?

রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী দাবি করেছেন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা বেআইনি এবং নিয়ম-বিরুদ্ধভাবে অন্যত্র সরানো হচ্ছে। তাঁর আরও দাবি, এই খবর তাঁকে রাজ্যের কিছু সৎ আধিকারিক জানিয়েছেন। এই অভিযোগে তিনি চিঠি লিখেছেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমণকে। এদিকে, একই বিষয়ে তথ্য জানতে চিঠি দিয়েছেন রাজ্যের অর্থ দফতরের অতিরিক্ত সচিবকে। শুভেন্দুর অভিযোগ, ‘স্টেট ইমারজেন্সি রিলিফ ফান্ড’ থাকলেও সম্প্রতি একটি বেসরকারি ব্যাংকে ‘পাবলিক ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে যা কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অর্থ বেআইনিভাবে সরানোর জন্যই করা হয়েছে বলে দাবি তাঁর।

কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা এবং কেন্দ্রের বঞ্চনার তৃণমূল অভিযোগের পাল্টা বারবার সরব হয়েছে বঙ্গের বিজেপি। দুর্নীতি এবং কেন্দ্রের টাকা নয়ছয় করার অভিযোগ তুলেছেন বিজেপি নেতারা। বারবার প্রধানমন্ত্রীকেও চিঠি লিখেছেন শুভেন্দু অধিকারী।

গত অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে দিল্লি যান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পার্থ চট্টোপাধ্যায় গ্রেফতারি ইস্যুতে অস্বস্তিতে তখন তৃণমূল। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে মমতা এবং মোদির বৈঠক হয়। এর পরেই নরেন্দ্র মোদিকে পাল্টা চিঠি লেখেন শুভেন্দু অধিকারী। তিনি দাবি করেন, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নয়ছয় করছে তৃণমূল সরকার। একাধিক প্রকল্পের নাম বদল করেছেন মমতা। আর সেই সূত্রেই টাকা নিয়েও বারবার দুর্নীতি হচ্ছে এই রাজ্যে!

এর আগেও প্রায় একই অভিযোগ করেন বিজেপি নেতা তথা তমলুকের প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ। গত ২১ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রীকে লেখা একটি চিঠিতে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা দাবি করেন, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, স্বচ্ছ ভারত মিশন, প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা; এই তিনটি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে বাংলা আবাস যোজনা, মিশন নির্মল বাংলা এবং বাংলা গ্রামীণ সড়ক যোজনা করেছেন উত্তর দিনাজপুরের (তৎকালীন) জেলাশাসক অরবিন্দ কুমার মিনা। প্রধানমন্ত্রীকে লেখা ওই চিঠিতে বিরোধী দলনেতা ২০ এপ্রিল অরবিন্দ মিনার জারি করা একটি নির্দেশনামার কথা উল্লেখ করে লেখেন, এই ভুল ইচ্ছাকৃত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এরপরেও কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নিয়ে যতবার অভিযোগে সরব হয়েছে তৃণমূল ঠিক ততবার পাল্টা টাকার অপব্যবহার নিয়ে সরব হয়েছেন শুভেন্দু অধিকারী।

আরও পড়ুন- নন্দীগ্রামে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’, কেন মমতার মুখে ঘুরেফিরে সেই একই কথা

কোন কোন কেন্দ্রীয় প্রকল্প নিয়ে অভিযোগ উঠেছিল রাজ্যের বিরুদ্ধে

শুভেন্দু অধিকারী গত ৬ অগাস্ট প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লেখা চিঠিতে দাবি করেন, মোট ৭টি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদল করে রাজ্যের নামে চালাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেআইনিভাবে এই কাজ করছে রাজ্য সরকার। তাঁর দাবি, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, কেন্দ্রীয় গ্রামন্নোয়ন মন্ত্রকের অধীনস্থ এই প্রকল্পের নাম বদল করে রাজ্যের তরফে করা হয়েছে ‘বাংলা আবাস যোজনা’ যা রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামন্নোয়ন দফতরের অধীন।

কেন্দ্রের পঞ্চায়েত মন্ত্রকের অধীনে থাকা প্রধানমন্ত্রী গ্রাম সড়ক যোজনা প্রকল্পের নাম বদলে ‘বাংলা গ্রাম সড়ক যোজনা’ করেছে রাজ্য।

কেন্দ্রীয় খাদ্য এবং খাদ্য সরবরাহ মন্ত্রকের প্রধানমন্ত্রী গরিব কল্যাণ যোজনা প্রকল্পের নাম বদল করে রাজ্যে এর নাম হয়েছে, ‘খাদ্যসাথী’।

প্রধানমন্ত্রী জল যোজনা মিশন, কেন্দ্রের জলশক্তি মন্ত্রকের অধীনস্থ এই প্রকল্পের নাম রাজ্যে হয়েছে ‘জলস্বপ্ন’।

স্বচ্ছ ভারত মিশন, কেন্দ্রের জলশক্তি মন্ত্রকের প্রকল্প বাংলায় হয়েছে ‘নির্মল বাংলা’।

কেন্দ্রের ওয়াটার সেড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামকে শুভেন্দুর দাবি অনুযায়ী, মমতার সরকার রাজ্যের অধীনে এনে নাম দিয়েছে ‘জল ধরো, জল ভরো’।

পঞ্চায়েত রাজ মন্ত্রকের জাতীয় গ্রামীণ লাইভহুড মিশনের নাম বদল করে এই রাজ্যে করা হয়েছে ‘আনন্দধারা’।

এই নামবদল এবং কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নিয়ে নয়ছয়ের অভিযোগ আগে থেকেই করে আসছেন শুভেন্দু। এবার সেই অভিযোগের মধ্যেই নতুন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করে টাকা সরানোর বিস্ফোরক অভিযোগ করেছেন তিনি। কিন্তু এই বঞ্চনার ক্ষেত্র নিয়ে আসলে কী বলে আসছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?

মমতার বঞ্চনা-অভিযোগ

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তৃণমূল কংগ্রেসের দাবি, কেন্দ্রের একাধিক প্রকল্পে অর্থের জোগান নিয়ে গড়িমসি করে কেন্দ্র। অর্থাৎ পাওনা বা প্রাপ্য টাকা দেওয়ার কথা থাকলেও দেয় না নরেন্দ্র মোদির সরকার। বারবার আবেদন করলেও সেই সাহায্য মেলে না। শুধু সরকারে আসার পরে নয়, খানিকটা ভিন্নভাবে হলেও বাম আমলে মমতার রেল সংক্রান্ত কাজের ক্ষেত্রে বঞ্চনার অভিযোগ তুলতেন মমতা যার কেন্দ্রে ছিল রাজ্যের বাম সরকার। সময় বদলেছে। এখন কেন্দ্র বদলে লক্ষ্য ঘুরেছে নিরন্তর। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা বকেয়া, বঞ্চনা নিয়ে ঠিক কী বলেন মুখ্যমন্ত্রী।

২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২০। রাজভবনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নরেন্দ্র মোদির সদ্য অনুষ্ঠিত বৈঠকের পরেই প্রধানমন্ত্রীকে ফের চিঠি লেখেন মমতা। দাবি করেন, একাধিক কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বকেয়া সময়ে পাচ্ছে না রাজ্য। অভিযোগ করেন, টাকা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে বিভিন্ন প্রকল্পের।

৭ মে, ২০২১। করোনাকালে ফের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন মমতা। যদিও এটি কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বকেয়া নিয়ে দাবির চিঠি না হলেও করোনা এবং অক্সিজেনের চাহিদার মধ্যেও কেন্দ্রের বঞ্চনার দিকেই ইঙ্গিত ছিল মমতার।

১৩ মে, ২০২১। কৃষকদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি লেখেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি দাবি করেন, দীর্ঘ টালবাহানার পরে কেন্দ্রীয় প্রকল্প কৃষক সম্মান নিধির জন্য বকেয়া টাকা দিতে চলেছে কেন্দ্র। যা তাঁর আবেদনের ফল। এর সঙ্গেই রাজ্যের তরফে করা কৃষক বন্ধু প্রকল্পের সুবিধাও তুলে ধরেন তিনি।

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২। ফারাক্কা বাঁধের কাজ সংক্রান্ত বকেয়া দিচ্ছে না কেন্দ্র, এই মর্মে চিঠি লিখলেন মমতা। বললেন, যাতে তাড়াতাড়ি টাকা মিটিয়ে দেয় কেন্দ্র সেই ব্যবস্থা করতে। যদিও এই বিষয়ে পাল্টা চিঠি লিখে কেন্দ্রের তরফে রাজ্যকে জানানো হয় যে, ওই কাজের বিষয়ে কেন্দ্রের হাতে কিছুই নেই।

১২ মে, ২০২২। কেন্দ্রের তরফে একশো দিনের কাজের প্রকল্প এবং প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বকেয়া টাকা দেওয়া হচ্ছে না। অভিযোগ তুলে সরব হন মমতা। এরপরেই প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি জানান, অবিলম্বে মিটিয়ে দেওয়া হোক এই বকেয়া।

৫ অগাস্ট, ২০২২। ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি বকেয়া দাবি করে নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লি গিয়ে বৈঠকে বসেন দু’জনে। দুর্নীতি আবহে এই বৈঠক নিয়ে একাধিক প্রশ্ন উঠলেও তৃণমূলের তরফে দাবি করা হয়, এটিও ছিল কেন্দ্রীয় প্রকল্পের বকেয়া নিয়েই। এছাড়া আম্ফান, ইয়াসের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য কেন্দ্রীয় অনুদান নিয়েও বারবার প্রশ্ন তোলেন মুখ্যমন্ত্রী। বরাবর দাবি করা হয় বঞ্চনা করছে কেন্দ্র।

আরও পড়ুন- প্রতিপক্ষ গোটা বিজেপি নয়, অভিযোগেই প্রমাণ লড়াইটা আসলে অভিষেক বনাম শুভেন্দুর

শুভেন্দুর অভিযোগ নিয়ে কী বলছেন রাজ্যের অর্থ দফতরের প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য। ইনস্ক্রিপ্টের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, “এসব তিনি (শুভেন্দু অধিকারী) করছেন রাজনৈতিকভাবে মিডিয়ায় বেঁচে থাকার জন্য। এসব আবার হয় নাকি! অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নিয়ে যাঁর কোনও জ্ঞান নেই তিনিই এসব বলে বেরাচ্ছেন। নির্মলা সীতারমণকে খুঁজতে বলেছেন, খুঁজুন তিনি!”

তৃণমূল নেতা তথা বরাহনগরের বিধায়ক তাপস রায় ইনস্ক্রিপ্টকে বলেন, “এসবে শুভেন্দু কেন, আমলারা বুঝবেন। বঞ্চনা তো আছেই। আগেও ছিল কেন্দ্রের বঞ্চনা। এখন বিজেপি সরকার এসব বাড়িয়েছে।”

উল্লেখ্য, পুজোর উদ্বোধনের মঞ্চ থেকে উৎকর্ষ বাংলার নজরুল মঞ্চ, এমনকী পুজো কমিটিকে ৬০ হাজার টাকা অনুদানের ঘোষণা। প্রায় সব ক্ষেত্রেই বারবার কেন্দ্রীয় বঞ্চনা নিয়ে সরব হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের প্রচার থেকে নবান্নের সাংবাদিক সম্মেলন, কোনও স্থানেই মমতার মুখে এই কেন্দ্রীয় বঞ্চনার অভিযোগ বাদ যায়নি এক মুহূর্তের জন্যেও। সেই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের টাকা নিয়ে শুভেন্দু অধিকারীর এই বিস্ফোরক অভিযোগ, ফের তৈরি করেছে বিতর্ক।

More Articles