বাংলায় ব‍্যান্ড সংস্কৃতির অপমৃত্যু? ফসিলস-ভক্তদের নিয়ে নয়া বিতর্ক যে প্রশ্ন উসকে দিচ্ছে

Fossils vs Arnob: কোক স্টুডিওর অনুষ্ঠানে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা প্রমাণ করে দেয় অনুরাগীদের মধ্যে বিদ্বেষ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে!

পুজোর আগে শহরে ছিল জমজমাট গানের কনসার্ট। ২৪ ও ২৫ সেপ্টেম্বর কোক স্টুডিও কলকাতায় তাদের শো অরগানাইজ করে। সেই শোয়ের লাইন আপে ছিলেন শ্রেয়া ঘোষাল, অনুপম রায়, শংকর-এহসান-লয়, ফসিলস এবং অর্ণব। সপ্তাহান্তে ইকো পার্কের এই অনুষ্ঠান ঘিরে উৎসাহ ছিল তুঙ্গে। রীতিমতো চাঁদের হাট ইকো পার্কে! তবে সেই অনুষ্ঠানই এখন বিতর্কের শিরোনামে। ফসিলস ফোর্স বনাম কোক স্টুডিও বাংলা ফ্যান- তর্কাতর্কিতে ছয়লাপ সোশ্যাল মিডিয়া। অভিযোগ, অর্ণবের পারফরম্যান্স চলাকালীন বিশৃঙ্খলা তৈরি করেন ফসিলস তথা রূপম ইসলামের অনুরাগীরা। যা নিয়ে নেটিজেনদের কটাক্ষের মুখে পড়েন রূপম এবং তাঁর স্ত্রী রূপসা।

২৫ সেপ্টেম্বর, রবিবার ইকো পার্কে আয়োজিত কনসার্টে বাংলাদেশি শিল্পী অর্ণব এবং কোক স্টুডিও বাংলা-র পারফরম্যান্সের পরই ছিল ফসিলসের অনুষ্ঠান। পারফরম্যান্সের একেবারে শেষভাগে কিছুটা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়। সেই থেকেই দুই পক্ষের অনুরাগীদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ক্রমেই যা ব্যক্তিগত আক্রমণে পৌঁছে গিয়েছে। এদিন ফসিলসের প্রোগ্রামের পর মঞ্চে পারফর্ম করতে ওঠেন অর্ণব। স্বনামধন্য গায়ক হওয়ার পাশাপাশি অর্ণব রুপমের খুব ভালো বন্ধুও। যথারীতি বন্ধুর পারফরম্যান্স একটু কাছ থেকে দেখার জন্য স্টেজে উঠে এসেছিলেন রুপম ইসলাম। রূপম ইসলামকে দেখে দর্শকদের মধ্যে কয়েকজন তখন রূপম ও ফসিলসের নাম করে চিৎকার শুরু করেন। রূপম তা বুঝতে পেরেই তৎক্ষণাৎ সেখান থেকে সরে যান।

কিন্তু বিষয়টা নিয়ে জল অনেক দূর গড়ায়। সোশ্যাল মিডিয়ায় অর্ণব এবং রুপম ইসলাম দু'জনেই জানিয়েছেন ঘটনাটি নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করা হচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঝামেলা থামার কোনও লক্ষণ নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনদের একাংশ ব্যক্তিগত স্তরে গিয়ে আক্রমণ করছে রুপম ইসলাম এবং অর্ণব উভয়কেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনদের একাংশ ফসিলসের অনুরাগীদের গাঁজাখোর তকমা দিচ্ছেন। অপর পক্ষে এক দলের দাবি, টিকিট বিক্রি হয়েছে ফসিলসের নাম দিয়েই! তাই সেই ব‍্যান্ডের ভক্তদের অত‍্যাচার সইতেই হবে। কাদা ছোড়াছুড়ি হচ্ছে দুই পক্ষেই। কিন্তু আসলে যা হচ্ছে, তা নির্ভেজাল নিখাদ অসভ‍্যতা। বাংলা ব‍্যান্ড সংস্কৃতির ইতিহাসের অধঃপতন বলেই কি ধরে নিতে হবে একে?

আরও পড়ুন: খবরের কাগজ বলেছিল বাঁদরের নৃত্য, গান নয়, ইতিহাস হয়ে থেকে গেল মনিদার কাজ

আপনি যে কোনও ব্যান্ডের অনুরাগী হতেই পারেন, কিন্তু তাই বলে অন্য কোনও ব্যান্ডকে ছোট করা কি কাম‍্য? কোক স্টুডিওর অনুষ্ঠানে যে ঘটনাটি ঘটেছে, তা প্রমাণ করে দেয় অনুরাগীদের মধ্যে বিদ্বেষ কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে! সোশ‍্যাল মিডিয়াজুড়ে যে 'টক্সিক ফ‍্যান' শব্দটি ঘুরে বেড়াচ্ছে, ব‍্যান্ড-সংস্কৃতির নিম্নগামী অভিমুখ সেখান থেকেই পরিষ্কার হয়। মাথায় রাখতে হবে, এটি কিন্তু কেবলমাত্র ব্যান্ড-সংগীতের মধ্যেই আবদ্ধ নয়, বিশ্বের যে কোনও প্রান্তে, যে কোনও ক্ষেত্রে এখন প্রতিদ্বন্দ্বী নির্মাণ ও বাইনারি নির্মাণের খেলা। আমরা তো প্রায় সময়ই দেখেছি, মেসির অনুরাগীরা রোনাল্ডোকে গালাগাল দিচ্ছেন, রোনাল্ডোর অনুরাগীরা মেসিকে গালাগাল দিচ্ছেন। মানুষ ভুলে যান, মেসি এবং রোনাল্ডো কিন্তু পরস্পরকে যথেষ্ট সম্মান করেন। আমাদের মাথায় রাখা উচিত, ভালবাসা কেবল ভালবাসা দিয়েই দেখানো যায়, ঘৃণা দিয়ে নয়।

আর 'ব্যান্ড' শব্দের অর্থ কী? 'ব্যান্ড' শব্দটা আমাদের কানে আসলে প্রথমেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে আধুনিক ভাবধারার বিভিন্ন সংগীতজ্ঞদের দলের কথা। এই ‘দল’ শব্দটা মাথায় রাখবেন। একাধিক মিউজিশিয়ান একসঙ্গে এসে গান গাওয়াই তো ব্যান্ডের উদ্দেশ্য? তাই নয় কি? বাংলায় ব্যান্ড কালচারের প্রাণপুরুষ ছিলেন গৌতম চট্টোপাধ্যায়। গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের হাত ধরে সাতের দশকে ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ যে লড়াই শুরু করেছিল, নয়ের দশকে একগুচ্ছ গায়ক এবং ব্যান্ডের হাত ধরে বাংলা গান সেই পূর্ণতা পায়। একদল তরুণকে নিয়ে গৌতম চট্টোপাধ্যায়ই প্রথম শুরু করেন 'মহীনের ঘোড়াগুলি'। কয়েক বছরের মধ্যেই আরেকটি প্রবাদপ্রতিম ব্যান্ড গড়ে ওঠে বাংলায়, ‘নগর ফিলোমেল’। সাতের দশকের শেষভাগ থেকে আটের দশক পর্যন্ত সারা বাংলা দাপিয়ে বেড়িয়েছে এই দু'টি ব্যান্ড। সমাজের তথাকথিত উচ্চশ্রেণির মানুষ তখন এদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও পরবর্তী সময়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এদের গান শুনেই বড় হয়েছে। এমন অনেক সময় দেখা গেছে, যখন ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ এবং ‘নগর ফিলোমেল’ একসঙ্গে একই মঞ্চে পারফর্ম করেছে এবং শ্রোতারা সানন্দে সেটিকে গ্রহণ করেছেন। 'চন্দ্রবিন্দু'-র মতো নতুন ব‍্যান্ডও মঞ্চসঙ্গী হয়েছে 'মহীনের ঘোড়াগুলি'-র। পরবর্তী সময়ে চন্দ্রবিন্দু, ভূমি, দোহার, ক্যাকটাস, ফসিলস-ও বহু অনুষ্ঠানে একসঙ্গে পারফর্ম করেছে এবং শ্রোতাদের উপহার দিয়েছে অবিস্মরণীয় কিছু মুহূর্ত।

শুধু বাংলা বা ভারত নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মিউজিশিয়ানরা একসঙ্গে আসেন এবং পারফর্ম করেন। এবং শেষ পর্যন্ত যা তৈরি হয়, তা অনন্য অভিজ্ঞতা শ্রোতাদের কাছে! কিন্তু এই সবকিছুই মাটি হয়ে যেতে পারে যদি শ্রোতাদের মধ্যে ঘৃণার চাষ হয়। মানুষ ক্রমশ একমুখী হয়ে যাচ্ছে এবং নতুন কিছুকে গ্রহণ করতে চাইছে না। যে কোনও শিল্পকেই বুঝতে গেলে সবার আগে উদারমনস্ক হতে হয়। তাহলেই শিল্পের আসল রস আস্বাদন করা যায়। সেই মনন একসময় বাঙালির ছিল, তার কি মৃত্যু ঘটল তবে?

More Articles