অখিল-শুভেন্দুর আস্ফালনে আসলে অপমানিত আদিবাসীরাই! যে জ্বলন্ত প্রশ্ন উঠে আসছে
Racism: অখিল গিরি ও শুভেন্দু অধিকারীদের এই মন্তব্যেই কি ফের মাথাচাড়া দিল জাতপাতের সেই কালো ঘা!
কালো মেয়ের আলোর নাচনে কৃষ্ণকলির দেখা এই বিশ্ব পেয়েছে বারবার। নারী-পুরুষের বিভেদ ঘুচিয়ে কালো রঙের জাদুতে বিশ্বজয় করেছেন একাধিক। রাজকীয় আর দাসপ্রথার মায়াজালেও রুখে দাঁড়িয়েছেন অ্যাঙ্গোলার কৃষ্ণাঙ্গ রানি। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন ফ্লোরেন্সের 'কালো রাজা' মেডিসি। আব্রাম গেনিবেল থেকে ব্রুস। একের পর এক কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবাদী-সম্রাটের আলোকে এই বিশ্ব বুঝেছে, রং নয় এগিয়ে যেতে মস্তিষ্ক প্রয়োজন সবার আগে। যেখানে আদিম যুগের কালো বর্ণের মুসা হয়েছেন ধনীদের সর্বোচ্চ।
এ তো গেল পুরাণকথা। কয়েক'শো বছর আগের ইতিহাস। 'কালো'দের এগিয়ে যাওয়ার দিননামচা। কিন্তু আজ? এই সময়ে দাঁড়িয়েও বিশ্বজুড়ে গুণের বশে কালো-ফর্সার রূপভেদের একাধিক নিদর্শন সৃষ্টি হলেও বারবার সেখানেই থেকে গিয়েছে গলদ। একের পর এক রূপ-কাঁটায় বিদ্ধ হয়েছেন কেউ কেউ। প্রতি মুহূর্তে রাষ্ট্রের সর্বময় শাসককেই বিদ্ধ হতে হয়েছে জাতিগত-বর্ণগত বৈষম্যের!
রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এই উদাহরণ থেকে বাদ যায়নি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতও।
আরও পড়ুন: প্রণামের ছলে আরডিএক্স বিস্ফোরণ! রাজীব হত্যায় ফাঁসির সাজা পেয়েও কেন মুক্ত নলিনী শ্রীহরণ?
তবে অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে এবার ফের নজির গড়েছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল অথবা জীবনানন্দের বাংলা। নতুন করে পথ দেখিয়েছে বর্ণবৈষম্য এবং রূপের বিচার-কটাক্ষের বিতর্কে! আর সেখানেই নজিরবিহীনভাবে আক্রান্ত হয়েছেন দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি (President of India) দ্রৌপদী মুর্মু (Draupadi Murmu) । কারণ তাঁর গায়ের রং, তাঁর রূপ!
কিন্তু এর নেপথ্যে কে? কার আক্রমণের শিকার হলেন স্বয়ং সাংবিধানিক প্রধান? সম্প্রতি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বিধানসভা ক্ষেত্র নন্দীগ্রামে উত্তেজনা ছড়ায় আচমকা। একটি অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সমস্যার সূত্রপাত হয়। তৃণমূলের অভিযোগ, তাদের অনুষ্ঠান-মঞ্চে আগুন লাগিয়েছে বিজেপি! পাল্টা সরব হয় বিজেপি-ও। যদিও এই ঘটনার প্রতিবাদে অবরোধ শুরু করেন তৃণমূল কর্মী-সমর্থকরা। ঘটনাস্থলে পৌঁছন শাসক দলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ, মন্ত্রী শশী পাঁজা। সেখানেই এসে হাজির হন রাজ্যের আর এক মন্ত্রী অখিল গিরি। যিনি পূর্ব মেদিনীপুরের রামনগরের বিধায়ক। সেখানে অখিল রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, "আমাকে ও (শুভেন্দু অধিকারী) বলে হাফপ্যান্ট মন্ত্রী। আমার দফতরে তো আর কেউ নেই, কিন্তু ওর বাবা কে? সে তাহলে কী মন্ত্রী ছিল!'' এখানেই থামেননি রাজ্যের কারামন্ত্রী অখিল গিরি। তিনি বলেন, "আমাকে নাকি দেখতে খারাপ! তা বলি, দেশের রাষ্ট্রপতির চেয়ারকে আমরা সম্মান করি, কিন্তু তাঁকে কেমন দেখতে?'' এই মন্তব্যের পর তৃণমূলের অন্যান্য নেতা এমনকী, মন্ত্রীদের তরফেও কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। হাততালির রোলের মধ্যেই নিজের বক্তব্য চালিয়ে যান অখিল।
এই ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। শুভেন্দু অধিকারী তফশিলি জাতি-উপজাতি আইনে মামলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি বলেন, ''আমি মামলা করব। ওঁর নামে। তফশিলি আইনে অভিযোগ করব।''
আসলে অখিল গিরি কী করলেন! দেশের সাংবিধানিক প্রধানকে আক্রমণ করতে গিয়ে তিনি কি 'বডি শেমিং' আর বর্ণবৈষম্য বাড়িয়ে দিলেন ফের! শুধু তাই নয়, অখিলের এই মন্তব্যেই কি ফের মাথাচাড়া দিল জাতপাতের সেই কালো ঘা!
এই আলোচনায় আসার আগে আমরা দেখব কালো মানুষের বিশ্বজোড়া কাণ্ডকারখানা। যাঁরা একের পর এক ক্ষমতায় দেখে রীতিমতো নাচিয়েছেন বাকিদের। ক্ষমতার বলে, ক্ষমতার বশে, নিজেদের গুণ দিয়েই নর্দমা বানিয়েছেন বৈষম্যকে। তবুও কেউ পেরেছেন, কেউ পারেননি! যার উদাহরণ আমরা দেখেছি কয়েকদিন আগেও। মার্কিন মুলুকে এক ভারতীয় মহিলা অপমানিত হয়েছেন শুধু গায়ের রঙের জন্য। এই কালো হিরেদের বিশ্বজোড়া খ্যাতির শিখরে থাকা কয়েকজন হলেন।
ভিনসেন্ট গুয়েরেরও
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে বিভেদের বিশ্বে তাক লাগিয়েছিলেন ভিনসেন্ট (Vincent Guerrero) । সমস্ত বিভেদকে উড়িয়ে মেক্সিকোর প্রথম কালো রাষ্ট্রপতি হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ১৮১০ সাল নাগাদ মেক্সিকান সেনাবাহিনীর প্রধান ভিনসেন্ট দায়িত্বভার নেন মেক্সিকোর। একের পর ক্ষেত্রে শুরু করেন সংস্কার। বিতর্ক এবং একনায়কতন্ত্রের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে, তিনিই হয়ে উঠেছিলেন দেশের সর্নেসর্বা। তথাকথিত ফরসা-রাজত্বে এই ভিনসেন্ট ছিলেন সেরা।
ফ্রেডরিক ডগলাস
তিনি রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি ঠিকই। কিন্তু আমেরিকায় প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন রিপাবলিক দলের হয়ে। পাশ্চাত্যের দাসপ্রথার বিনাশে বিরাট ভূমিকা ছিল এই মানুষটির। এক নজির স্থাপন করেছিলেন ফ্রেডরিক ডগলাস।
নেলসন ম্যান্ডেলা
১৯৯৪-১৯৯৯। বিশ শতকের বিশ্ব-ইতিহাস বদলে দিলেন ম্যান্ডেলা! জগতের আলো হয়ে আফ্রিকার আকাশে উঠল নতুন চাঁদ। যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ৯০ এর দশকের আগে থেকেই, তা পরিপূর্ণ হল কয়েক বছর পরে এসে। একাধিক অত্যাচার, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে বিশ্বের হৃদয় জিতলেন ম্যান্ডেলা (Nelson Mandela)। ১৯৯১ থেকে আফ্রিকান জাতীয় কংগ্রেসের প্রধান দেখিয়ে দিলেন শাসন কাকে বলে! খর্ব করলেন বর্ণবিদ্বেষ। যে অত্যাচার একদা রাস্তায় নামিয়েছিল ম্যান্ডেলাকে। যা বারবার শ্বেতাঙ্গ মানুষের কাছে আনন্দের হয়ে উঠেছিল, সেই বিভেদ-বিচ্ছেদ আর অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন এই 'কালো ছেলে'ই। হয়ে উঠেছিলেন এক বৃহত্তর দেশের, গণতান্ত্রিক প্রধান।
বারাক ওবামা
ইতিহাস থেমে গিয়েছিল ম্যান্ডেলার বিদায়ের পর। আর বিশ্ব দেখেনি কৃষাঙ্গ কোনও শাসককে। যিনি ছড়ি ঘোরাবেন আইন আর শাসনের উপরে ভিত্তি করে। ২০০৮ সাল। জল্পনা আর একাধিক কথকতা সত্যি করে উঠে এলেন বারাক হুসেইন ওবামা। মার্কিন মুলুকের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, ২০০৯ সালে বিশ্বের অন্যতম প্রধান শক্তির প্রধান নির্বাচিত হলেন বারাক ওবামা (Barack Obama) । কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট পেল আমেরিকা (United States Of America) । ফের ইতিহাস গড়লেন কৃষ্ণাঙ্গরা।
কমলা হ্যারিস
ওবামার পর কমলা হ্যারিস (Kamala Harris)। ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন মহিলার কৃষ্ণাঙ্গ দিক কাটিয়ে উঠে এল এক নজিরবিহীন ইতিহাস। ফের হোয়াইট হাউসের অন্যতম সদস্য হলেন কমলা। আমেরিকার উপরাষ্ট্রপতির পদে বসলেন তিনি।
দ্রৌপদী মুর্মু
বিশ্বের তাবড় তাবড় গণতন্ত্রের অন্যতম স্তম্ভ ভারত গড়ল নয়া ইতিহাস। মোদী রাজত্বে সমস্ত কৌশল, নির্বাচনী রাজনীতি ছাড়িয়ে ১৩০ কোটির দেশে সাংবিধানিক প্রধান নির্বাচিত হলেন দ্রৌপদী মুর্মু (President Of India Draupadi Murmu) । আদিবাসী পরিবারের সন্তান এই কৃষ্ণকলির মাথায় উঠল এই সম্মান। পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ-দলিত শ্রেণীর তকমা ছাড়িয়ে ওড়িশার দ্রৌপদী রচনা করলেন নয়া ইতিহাস।
যিনি উচ্চশিক্ষিত। বহুকাল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। একাধিকবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। হয়েছেন ঝাড়খণ্ডের রাজ্যপাল। প্রশাসনিক-রাজনৈতিক-শিক্ষাগত-সামাজিক; সমস্ত ক্ষেত্রেই সমান পারদর্শী এই দ্রৌপদীকে নির্বাচনের মূল উদ্দেশ্য রাজনীতি - তা নিয়েও বিতর্কের সূত্রপাত হলেও ভারতে প্রথম আদিবাসী পরিবারের কেউ সর্বোচ্চ পদে বসছেন, এই ঘটনা শোরগোল ফেলে। বিশ্বের দরবারে ভারত পরিচিত হয়, দেশের সাংবিধানিক পদের মালিক হতে পারেন দলিত জনের কেউ! এই সাহসী পরিচয়েও। দ্রৌপদী নিজস্ব লড়াইয়ে সেখানেই হয়ে ওঠেন মৌলিক, অনন্য, অনবদ্য।
কিন্তু আক্রমণ...
মুসার সময়-সংকট থেকে একালের দ্রৌপদী। বারবার বর্ণের অপরাধে মৌখিক অত্যাচারীর কবলে পড়তে হয়েছে তাঁদের। ঘোর বর্ণের মেয়ে বা ছেলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে গিয়ে উঠে এসেছে রূপের বর্ণনা। যেখানে রূপ নয়, গুণের ভারসাম্য ফুৎকারে উড়িয়ে কেউ কেউ সভ্যতার সমস্ত ক্ষেত্রত্যাগে হয়ে উঠেছেন আক্রমণের পূজারী।
অনেকেই বলছেন, অখিল গিরি একটি নামমাত্র। যিনি নিজেও সম্ভবত অনগ্রসর শ্রেণির জনপ্রতিনিধি হয়েও আসলে সমাজের প্রচলিত ধারণাই ব্যক্ত করেছেন ফের। যা আজও একটা বড় অংশের মধ্যেই বিবর্তিত। যেখানে সমস্ত গুণ পায়ের তলায় চাপা পড়ে থাকে শুধুমাত্র রূপের ছটায়! জাতের ছটায়! এখানেই উঠে এসেছে অনগ্রসর শ্রেণি, সংরক্ষণের ভাবনার কথা। কেন সংরক্ষণ, কারা পাচ্ছেন, কেন পাবেন? এই বিতর্ক ওঠার মধ্যেও অখিলের দ্রৌপদী-চয়নে উঠে এসেছে অন্য প্রসঙ্গও। আর সেখানেই শুভেন্দুর তফশিলি আইনে মামলার হুঁশিয়ারি জল্পনা বাড়িয়েছে ভিন্ন।
কিন্তু কী এই আইন? কী কী করলে হবে অপরাধ? সাজা কী?
তপশিলি জাতি-উপজাতি আইন, ১৯৮৯
অনগ্রসর। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া। নানাভাবে দুর্বল জনজাতির উপর শোষণ, অত্যাচার, বিড়ম্বনা রোধে, ভারতীয় সংবিধানের আলোকে, মানুষের বিশেষত এই শ্রেণীর মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষায় ভারত সরকার পরিপূর্ণভাবে একটি আইন আনে। যা তপশিলি জাতি-উপজাতি আইন হিসেবেও পরিচিত।
১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯ -এ সংসদীয় কার্যকলাপ পরিপূর্ণ হলেও এই আইন ৩১ মার্চ, ১৯৯৫ থেকে বলবৎ হয়। যদিও ৩০ জানুয়ারি, ১৯৯০ থেকেই এটি কার্যকরি হয়।
২০১৩, ২০১৪, ২০১৬, ২০১৯- পরবর্তীকালে এই আইনের উপরে নানা সংশোধনী আনে কেন্দ্র। একাধিক পরিবর্তন করা হয় এই আইনে।
মূলত, জাতিভেদ প্রথা এবং সেই প্রথার ওপর ভিত্তি করে যাবতীয় বেআইনি কার্যকলাপ রোধ। সমাজে সকলের অধিকার এবং অচ্ছুৎ ধারণার বিপক্ষে দাঁড়িয়েও এই আইনের প্রয়োজন পড়ে। যদিও এক্ষেত্রেও বাদ যায়নি বিতর্ক। এতদসত্ত্বেও পাশ হয় এই আইনটি।
একটি সম্প্রদায় বা জাতির ভেতরের বা বাইরের কেউ কাউকে জাতিগত অছিলায় বঞ্চিত করতে পারবে না। এমনকী, জাতির ওপর ভিত্তি করে কিছু থেকে তাঁকে অবহেলা করা যাবে না। কোনওভাবেই অনগ্রসর শ্রেণি বলে তাঁর বিরুদ্ধে কুমন্তব্য, আক্রমণ, বিনা কারণে বিপর্যস্ত করার ক্ষেত্রেও কড়া সংস্থান রয়েছে এই আইনে।
সংবিধানের মৌলিক অধিকার রক্ষায় যা যা বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে, সবটা এই আইনের বলে ভোগ করতে পারে এই শ্রেণীর মানুষ।
এমনকী, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের বঞ্চনা, তাদের দিয়ে অযথা কাজ করানো। দাসবৃত্তি। সমস্ত ক্ষেত্রেই অপরাধের সংস্থান রেখেছে এই আইন। যেখানে যৌনশোষণ থেকে শুরু করে, শিক্ষা বা কর্মে শুধু জাতের উপর ভিত্তি করে বঞ্চিত করলেও রয়েছে শাস্তির বিধান। যেমনভাবে এই শ্রেণির মানুষের দ্বারা করা অপরাধেও দেশের অন্যান্য আইন যেমন প্রযোজ্য।
এই ক্ষেত্রে রয়েছে গায়ের রং, জাতিগত অছিলায় কাউকে কটাক্ষ করলে, তাঁকে মানসিক বিড়ম্বনায় ফেললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থার কথা।
দেশের শীর্ষ আদালতে ওঠা একাধিক মামলার পর্যবেক্ষণেও বারবার উঠে এসেছে এই আইনের প্রসঙ্গ। যে সওয়াল জবাবে আবর্তিত হয়েছে, অনগ্রসর শ্রেণীর অত্যাচারিতদের কথা। যাঁদের অপরাধ হিসেবে উঠে এসেছে গায়ের রঙ বা তাঁর জাতি!
এই আইনের বলে, একজন অনগ্রসর শ্রেণির ব্যক্তি, তাঁর মানসিক বা শারীরিক বিড়ম্বনায় জাতিগত কারণ থাকলে শুধু আদালতে মামলা নয়, অভিযোগ করতে পারেন রাজ্যের বা কেন্দ্রের এই সংক্রান্ত কমিটির কাছে। যাঁরা অনগ্রসর শ্রেণীর মানুষের অধিকার রক্ষায় তৎপর। এমনকি একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন রয়েছে এই ক্ষেত্রে।
এই আইনের বলে বিশেষ সুবিধা দেওয়া নিয়েও রয়েছে বিতর্ক। রয়েছে সমালোচনাও।
কিন্তু সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বর্ণের বৈষম্য, নিচুজাতের তকমা যে এখনও ভয়ানক হতে পারে, তার নিদর্শন হিসেবে উঠে এসেছে মন্ত্রী অখিলের এই মন্তব্য। যা প্রশ্ন তুলেছে ফের, গুণের বাইরে রূপ এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি বলেই কি এই আক্রমণে অখিল টেনে এনেছেন দেশের সাংবিধানিক প্রধানকে!
এই আপত্তিকর মন্তব্য নিয়ে জলঘোলা হতে পারে আদালতে। যেকোনও মানুষকে বর্ণের ভিত্তিতে বা জাতপাতের ভিত্তিতে আক্রমণের অন্যায়ের শাস্তিতে দোসর হতে পারে এই আইন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এরফলে জরিমানা অথবা কারাবাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যদি প্রমাণ হয়। আবার বিপরীত দিক থেকে হলফনামা দিয়ে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ যদি প্রকাশ্যে উঠে আসে এবং কাজে দেয়, সেক্ষেত্রেও অবাকের কিছু নেই!
প্রসঙ্গত, বেশ কয়েকবছর আগেই জাতিগত বৈষম্য এবং গায়ের রঙ নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের শিকার হন এক মহিলা অধ্যাপক। যিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের। যিনি অভিযোগ করেছিলেন, অনলাইন ক্লাসে তাঁকে জাতিগত গঞ্জনার শিকার হতে হয়েছে। রোহিত ভেমুলার আত্মহত্যায় উঠে এসেছিল এই একই প্রশ্ন। আবার এক দলিত-ছোঁয়ায় জল অশুদ্ধ হয়েছে, এই দাবিতে প্রধান শিক্ষকের নির্মম অত্যাচারের শিকার হয়েছিল এক পড়ুয়া
আবার এ-রাজ্যও দেখেছে কালো মেয়ের আলোর নাচন! সিনেমার পর্দা থেকে এসে তিনিও নামেন রাজনীতিতে। বীরবাঁহা হাঁসদা। আদিবাসী সম্প্রদায় থেকে উঠে এসে জনমানসে, বিশেষত আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন তিনি। বাম আমলের আদিবাসী নেতাদের মতোই নিজের এলাকা শুধু নয়, একাধিক ক্ষেত্রে বারবার উঠে এসেছেন তিনি। হয়েছেন রাজ্যের মন্ত্রীও। জোৎস্না মান্ডি। আদিবাসী সমাজে তাঁর বিস্তারও কম নয়!
মনোজ টিগ্গা। সাধারণ আদিবাসী ঘর থেকে উঠে এসেও তিনিও হয়ে উঠেছেন আদিবাসী সমাজের প্রভাবশালী নেতা।
শুধু তাঁরাই নন, এ রাজ্যে বাম থেকে কংগ্রেসের নেপাল মাহাত। একের পর এক আদিবাসী, অনগ্রসর শ্রেণির মুখ হয়ে উঠেছেন একাধিক। ক্রমশ মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছেন তাঁরা। রূপের বিড়ম্বনায় পড়েননি কেউ-ই! কিন্তু...
ভোট-রাজনীতিতে আদিবাসী
একাধিক বিতর্ক আর জল্পনার মধ্যেই ভোট রাজনীতির বোড়ে হয়েছেন আদিবাসীরা। একের পর এক ইস্যুতে শুধুই ভোট পাওয়ার উপজীব্য হয়ে উঠেছেন তাঁরা! বিরসা মুন্ডার সাহসী লড়াই মুহূর্তেই অধিকার পাওয়ার আশায় জিইয়ে রাখলেও আজও সেই আদিবাসীরাই বিবর্তিত হচ্ছেন নানা ভাবে। সেখানে যিনি বিতর্ক বাড়িয়ে চাপে পড়েছেন তিনিও, আবার যাঁরা বিরোধিতায় সরব হয়েছেন তাঁরাও। আসলে আদিবাসীরা অন্য অনেকের মতোই ভোটকেই বড় বালাই করে তুলেছেন!
জাতের বিড়ম্বনায় কুয়োর জল থেকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ। একাধিক ক্ষেত্রেই উঠেছে প্রশ্ন। আবার সংরক্ষণ আর চাকরির দাবানলে সংরক্ষণ তুলতে সরব হয়েছে একটা বিরাট অংশ। প্রশ্ন উঠেছে, সকলের প্রয়োজন না হলেও এর প্রভাবে নিমেষেই বঞ্চিত হচ্ছে মেধা! এই দাবি যে যুক্তিহীন, একথা বলছেন না অনেকেই। যোগ্যদের সংরক্ষিত করার কথা নিয়ে সরব হয়েছেন অনেকে। কিন্তু ভেদাভেদ আর বাইরের প্রকাশকে এই কটাক্ষের প্রবণতা, ছোঁয়ার দ্বন্দ্ব আর অমানবিক অত্যাচারের ছবি যদি একেবারেই বন্ধ হয়ে যেত, তাহলে কি সংরক্ষণ বলে আর কিছু থাকত?