মাথার দাম ৪০ লক্ষ! মাওবাদী কমান্ডার হিডমার নাগাল পেতে কেন মরিয়া নিরাপত্তাবাহিনী?

Sukma Maoist Commander Madvi Hidma: দক্ষিণ সুকমা জেলার পুর্ভাতি গ্রামের আদিবাসী সন্তান মাদভি হিডমা আঠারো-উনিশ বছর বয়সেই মাওবাদীদের সঙ্গে জুড়ে যান।

ছত্তিশগড়ের সুকমায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত ১২ জন নকশাল নিহত হয়েছে বলে জানা গেছে। কিছুদিন আগে বিজাপুর জেলাতেও একটি এনকাউন্টারে তিনজন নকশাল নিহত হন। বছরের গোড়াতেই বাস্তার জেলায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এনকাউন্টারে পাঁচজন নকশাল নিহত হন। এই ঘটনার পরেই বিজাপুর জেলায় নকশালরা ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) ব্যবহার করে নিরাপত্তারক্ষীদের গাড়ি উড়িয়ে দেয়। আটজন ডিস্ট্রিক্ট রিজার্ভ গার্ড (ডিআরজি) কর্মী এবং একজন চালক নিহত হন। ছত্তিশগড়কে মাওবাদীমুক্ত করতে এমন আক্রমণ ও পাল্টা হামলা নতুন নয়। পুলিশ বলছে, মাওবাদীদের দলে ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) লাগানোয় একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন। মহেশ কোরসা। মাওবাদীদের একাধিক হামলায় তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ। গত সপ্তাহে একটি এনকাউন্টারে তিনি মারা গেছেন বলে খবর। তাহলে কি মহেশ কোরসাকে হারিয়ে দুর্বল হলো ছত্তিশগড়ের মাওবাদী ব্যাটেলিয়ান? না। কারণ এই সমস্ত ভয়ানক হামলার মূল মাথা এখনও অধরাই।

সাল ২০২১। ছত্তিশগড়ে ভয়াবহ গেরিলা হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ২২জন সদস্য নিহত হন। এর আগে, এরপরে বাস্তার জুড়ে মাওবাদীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও বহুজনই। সরকারি নিরাপত্তাকর্মীদের কাছে বাস্তার এক আতঙ্কেরই নাম! এই অঞ্চল মাওবাদীদের গড়। বহু মাওবাদী নেতাকেই পুলিশ গ্রেফতার করেছে, নির্যাতন করেছে। তবু অধরা রয়ে গেছেন একজন। এই ভয়াবহ আক্রমণগুলির নীল নকশা আঁকেন তিনিই। মাওবাদী কমান্ডার হিডমা, মাদভি হিডমা। ২০১০ সালে দান্তেওয়াড়ায় যে হামলাতে ৭৬জন সিআরপিএফ সদস্য নিহত হন কিংবা ২০১৩ সালে ঝিরামঘাটিতে যে হামলায় ছত্তিশগড়ের প্রায় পুরো কংগ্রেস নেতৃত্বই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, সেই দুই হামলাতেও হিডমা নিজে আক্রমণে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। হিসেব বলছে, এখন তার বয়স ৫৫। আদিবাসী কমান্ডার হিডমা গত দু'দশকে এই অঞ্চলে প্রায় তিরিশের কাছাকাছি বড় হামলায় যুক্ত ছিলেন। তবু তাঁর নাগাল মেলে না।

আরও পড়ুন- জঙ্গলমহলে নতুন করে মাওবাদী সক্রিয়তা?

হিডমাকে ধরতে পারার জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঙ্কের পুরস্কার ঘোষণাও হয়েছে। কখনও হিডমার মাথার দাম ৭ লক্ষ, কখনও ৪০ লক্ষ! তবু, হিডমাকে পাওয়া যায়নি। পিপলস লিবারেশেন গেরিলা আর্মির এক নম্বর ব্যাটেলিয়নের কমান্ডার মাদভি হিডমা বা 'হিডমালু'-কে ধরতে যে সমস্ত ফাঁদ পাতা হয়েছে, দেখা গেছে তাতে আখেরে প্রাণ গিয়েছে ভারতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর কর্মীদেরই। ভুল তথ্য ছড়িয়ে একাধিকবার নিরাপত্তা বাহিনীকে বিভ্রান্ত করে পালিয়ে গেছেন হিডমালু। অনেকে এমনও মনে করেন যে, হিডমালু আসলে একটি 'মিথ'! এই নামে কেউ নেই, কেউ ছিলও না! তবে মাদভি হিডমাকে ঘিরে ছত্তিশগড়ে প্রচলিত এমন সব জনশ্রুতির সবটাই যে বিশ্বাসযোগ্য, তা নয়।

পুলিশ ও নিরাপত্তারক্ষীবাহিনীর কাছে হিডমা নিষ্ঠুরতার অন্য নাম। জানা যায়, ১৮০ থেকে ২৫০জন বিশ্বাসী ও অনুগত নকশাল গেরিলার সুরক্ষা বলয় হিডমাকে সব সময় ঘিরে থাকে। এই দলের মধ্যে বহু মহিলাও আছেন। বলা হয়, হিডমা সাধারণত সব বড় হামলাই চালান জানুয়ারি থেকে জুন মাসের মধ্যে। এই সময় গভীর জঙ্গলে গাছের পাতা ঝরে যায় এবং আড়াল থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর গতিবিধি নজর করা ও সেনাকর্মীদের নিশানা করা অনেক সহজ হয়।

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ সুকমা জেলার পুর্ভাতি গ্রামের আদিবাসী সন্তান মাদভি হিডমা আঠারো-উনিশ বছর বয়সেই মাওবাদীদের সঙ্গে জুড়ে যান। ২০০৪ চার সালে একটি বড় হামলায় নেতৃত্ব দিয়ে তিনি প্রথম নজরে আসেন। কেন হিডমাকে ধরা কঠিন? হিডমা দেখতে কেমন, জানেই না ভারতের রক্ষীবাহিনীর নেতৃত্ব! তাদের কাছে হিডমার কোনও সাম্প্রতিক ছবিও নেই। কেবল স্থানীয় বাসিন্দা এবং হিডমার সঙ্গে কাজ করা ব্যক্তিদের স্মৃতি থেকে আঁকা স্কেচ থেকে হিডমালুর উচ্চতা এবং আকার সম্পর্কে অনুমান রয়েছে। AK-47 হাতে হিডমার একটি ছবি এবং একটি ক্লোজ শট রয়েছে ঠিকই, তবে সেটি হিডমার ছোটবেলার।

আরও পড়ুন- বহু সরকারের ঘুম উড়িয়ে এখন নিজেই চিরঘুমে, কে এই মাওবাদী নেতা সন্দীপ

হিডমা ছিলেন রাভুলা শ্রীনিবাস ওরফে রামান্নার ঘনিষ্ঠ। এই শ্রীনিবাসের বিরুদ্ধে ১৯৮৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে বাস্তারে ১৫০ জনেরও বেশি নিরাপত্তা কর্মীকে হত্যার অভিযোগ ছিল। ২০১৯ সালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান। রামান্নার মৃত্যুর পর, হিডমাকে সিপিআই (মাওবাদী) সংগঠনের কার্যকলাপের, বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। দণ্ডকারণ্য স্পেশাল জোনাল কমিটির (ডিকেএসজেডসি) প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন হিডমা।

হিডমাকে গ্রেফতার করাকে আরও কঠিন করে তোলে তাঁর চারপাশে ৫ কিলোমিটার জুড়ে থাকা নিরাপত্তা বলয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে হিডমার নেটওয়ার্ক প্রবল শক্তিশালী। হিডমা এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা এবং জঙ্গল সম্পর্কে জানেন। উপরন্তু বহু-স্তরীয় নিরাপত্তা বলয় রয়েছে তাঁর যার কমান্ডোরা সকলেই খুব সুপ্রশিক্ষিত এবং আধুনিক অস্ত্র, গ্রেনেড মজুত আছে তাঁদের কাছে। সমস্ত গ্রামেই হিডমার বিশ্বস্ত মানুষ আছেন যারা নিরাপত্তা বাহিনীর গতিবিধি সম্পর্কে তাঁর সহযোগীদের কাছে তথ্য পৌঁছে দেন। হিডমা নিজে সাধারণত গ্রামে আসেন না। হিডমা জঙ্গল যুদ্ধে প্রশিক্ষিত। হিডমা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে তাঁর নাম সিপিআই (মাওবাদী) সাধারণ সম্পাদক বাসভরাজু এবং অন্যান্যদের মতো কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের থেকেও বেশিই শোনা যায়।

সুকমা, বিজাউর এবং দান্তেওয়াড়ার জঙ্গলের অনেক জায়গায় ফোন নেটওয়ার্কের অভাবকে হিডমা দুর্দান্তভাবে ব্যবহার করেন। পুলিশের দাবি, একবার তাঁরা হিডমার কাছাকাছি এসেছিলেন। ২০১৭ সালের জুন মাসে। ভেজ্জি এবং বুরকাপালে পরপর দু'টি বড় হামলায় ৩৮ জন জওয়ান নিহত হয়। নিরাপত্তা বাহিনী তখন অপারেশন প্রহার নামে একটি বিশাল যৌথ অভিযান শুরু করে। পুলিশ দাবি করেছে, তখন প্রায় ১৮জন মাওবাদী নিহত হন। হিডমা নাকি তখন গুরুতরভাবে আহত হয়েছিলেন। তখন এমনটাও রটে যায় যে হিডমা মারা গিয়েছেন। সুকমাতে চলমান অভিযানে হিডমাকে ধরার জন্য আবারও মরিয়া হয়ে পড়েছে নিরাপত্তাবাহিনী। সমস্ত বলয় দিয়েই হিডমাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা চলছে। এবারও কি ফাঁকি দেবেন হিডমালু? আপাতত নিরাপত্তাবাহিনীর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এটিই। 

More Articles