কংগ্রেসকে আর কোনও দিন ফেরাতে পারবেন 'রাজনৈতিক সন্ন্যাসী' রাহুল গান্ধি?

Rahul Gandhi: রাহুল গান্ধির লড়াইটা কঠিন। বিগত বছরে তাঁর সংবিধানের সংকল্প, ভারত জোড়ো যাত্রা তাঁকে গান্ধি পরিবারের সুরক্ষিত আসন ছেড়ে মানুষের মাঝখানে জায়গা করে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়েছে কি?

"Last night my mother came to my room and she sat with me and she cried. Why did she cry? She cried because she understands that the power so many seek is actually a poison. She can see it because of what it does to the people around her and the people they love. But most importantly she can see it because she is not attached to it.”

উক্তিটি কোনও দার্শনিকের নয়, বর্তমান সংসদীয় বিরোধী দলনেতা ও সে দিনের কংগ্রেস ভাইস প্রেসিডেন্ট রাহুল গান্ধির। আজ থেকে প্রায় বারো বছর আগে অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির অনুষ্ঠানে যখন এই কথা রাহুল বলেন, তাঁর দল তখন ক্ষমতায়। তাঁরও সদ্য অভিষেক হয়েছে দলের ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে। দেশজুড়ে কংগ্রেস তখন 'ভিলেন'। জনগণের নতুন খুঁজে পাওয়া 'হার্টথ্রব' নরেন্দ্র মোদি একের পর এক ভাষণে ছিঁড়ে খাচ্ছেন কংগ্রেসকে। মিডিয়ার ক্রমাগত অগ্নিবাণে বিধ্বস্ত পার্টি ও তার জোটসঙ্গীরা। এমতাবস্থায়, দায়িত্ব নেওয়া খুব সহজ ছিল না, বিশেষত এমন এক রাজনীতিবিদের পক্ষে, যিনি প্রশাসনের অংশ হতে চাননি কখনও। মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব থেকে দূরে থেকেছেন। শক্তি লিখেছেন ‘সংসারে সন্ন্যাসী লোকটা’, রাহুল গান্ধি একরকম ছিলেন রাজনৈতিক সন্ন্যাসী। সংসারে থেকে, তার সুযোগসুবিধার কিয়দাংশ ভোগ করেও ঔদাসীন্য ছুঁয়ে বেঁচে থাকার মতো, তিনিও অজস্র জটিল সমীকরণ প্রাথমিকভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন।

তার ফল কি এখন ভোগ করতে হচ্ছে না? রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র এবং পরবর্তীতে রাজনীতি পড়েছি যাঁরা ভালোবেসে, তাঁরা জানি, সংসদীয় রাজনীতিতে ক্ষমতাই শেষ কথা। বিশেষ করে, যখন প্রতিপক্ষের দু'জন স্ট্রাইকারের নাম নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহ। তাঁদের জেতার খিদে ঠিক কতটা? সাংবাদিক প্রশান্ত ঝা, তাঁর বই ‘How The BJP Wins’ বইতে ২০১৭ সালের উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের একটি ঘটনার কথা লিখেছেন। নির্বাচনের শেষ পর্যায়ে মোদির লোকসভা কেন্দ্র বারাণসীতে ভোটগ্রহণ হবে। প্রচার করতে আসবেন ‘প্রধানমন্ত্রী’ এবং সাংসদ নিজে। এদিকে, স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব কিছুটা অস্বস্তিতে। বিধানসভা নির্বাচনেও দেশের প্রধানমন্ত্রী সক্রিয় হয়ে উঠলে পার্টির স্থানীয় নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। বিষয়টা মোদিকে জানাতে তিনি বলেন, নির্বাচন যুদ্ধের মতো, আর যে কোনও যুদ্ধই আসলে জেতার জন্য হয়ে থাকে। অর্থাৎ, দেশের প্রধানমন্ত্রী হলেও, নরেন্দ্র মোদির প্রাথমিক লক্ষ্য অবিচল। প্রতিটি নির্বাচনে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল।

আরও পড়ুন- রাহুল গান্ধিরাই রাষ্ট্রের নতুন ‘শহুরে নকশাল’? কেন নয়া তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান মোদি-শাহরা?

সম্ভবত, এই জয়ের খিদেই কংগ্রেস এবং বিজেপির মধ্যে তফাৎ করে দেয়। ক্ষমতা দখলের প্রশ্ন সামনে রেখেই বিজেপি সাংগঠনিক প্রশ্নে কেন্দ্রীয় তত্ত্বাবধানে অনেক বেশি সুনিয়ন্ত্রিত। নিন্দুকে বলেন, এটা মোদি-শাহের একনায়কতন্ত্র। কিন্তু, সেই একনায়কতন্ত্র যদি একের পর এক নির্বাচনে বৈতরণী পার করাতে পারে, তবে তার বিকল্প খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। সদ্যসমাপ্ত মহারাষ্ট্র নির্বাচনই দেখা যাক। নীতিন গডকরী, পঙ্কজা মুণ্ডে, পুনম মহাজনদের মতো নেতাদের পিছনের সারিতে রেখে মোদি-শাহের ট্রাম্পকার্ড ছিলেন দেবেন্দ্র ফড়নবীশ। লোকসভা নির্বাচনে চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরে, ফড়নবীশের নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন ছিল। বিজেপির নিজেদের শিবিরেই ‘আদি বনাম নব্যের’ দ্বন্দ্ব ছিল। নির্বাচন চলাকালীনও মহায়ুতির (বিজেপি, শিবসেনা, এবং এনসিপি জোট) নিজেদের মধ্যে একাধিক সমস্যা সামনে এসেছিল। কিন্তু, ফলাফলে তার ছিঁটেফোঁটা দেখা যায়নি। তার কারণ, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সুদক্ষ কূটনীতি, লোকসভা ভোটে ব্যর্থতার পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সহযোগিতায় দলীয় কর্মীদের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা এবং ভোটারদের বুথে পৌঁছে দেওয়ার মতো ইলেক্টোরাল মেশিনারি– এই তিন অস্ত্রেই মহারাষ্ট্রে খেলা ঘুরিয়ে দিল বিজেপির নেতৃত্বাধীন মহায়ুতি জোট। আর হরিয়ানাতে ঠিক এর উলটো পথে হাঁটল কংগ্রেস। দশ বছরের অ্যান্টি ইনকাম্বেন্সি, জাতপাতের তীব্র অসহিষ্ণুতা, বেকারত্বের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে যাওয়া একটা রাজ্যে কংগ্রেসের কাছে সুযোগ ছিল দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার। লোকসভা ভোটে রাহুল গান্ধিকে সামনে রেখে জাট, মুসলমান এবং দলিত ভোট নিজের ঝুলিতে নিয়ে এসে প্রায় অসাধ্য সাধন করেছিল কংগ্রেস। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইতে রাজ বব্বর গুরুগ্রামে না হারলে হরিয়ানা ৬-৪ ব্যবধানে ছিনিয়ে নিত কংগ্রেস। কাজেই, বিধানসভায় কংগ্রেসের সাফল্য নিয়ে একরকম নিশ্চিতই ছিল রাজনৈতিক মহল। অথচ ফল হল উলটো। টানা তৃতীয়বারের জন্য ক্ষমতা দখল করল বিজেপি। কারণ? কংগ্রেসের তুমুল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। ভোটের আগে থেকেই ভূপিন্দর হুডা বনাম কুমারী শেলজা লড়াই কার্যত স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল হরিয়ানায়। লড়াই এত প্রকট হয়ে উঠেছিল যে হুডা এবং শেলজা শিবির আলাদা আলাদা নির্বাচনী প্রচারের উদ্যোগ নেয়। ভূপিন্দর হুডা শিবির ‘ঘর ঘর কংগ্রেস’ ক্যাম্পেইন শুরু করে ভোটারদের প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে শেলজা, রণদীপ সুরজেওলা এবং কিরণ চৌধুরীর শিবির– যা প্রাথমিকভাবে হুডা বিরোধী বলে পরিচিত– তারা শুরু করে ‘কংগ্রেস সন্দেশ যাত্রা’ ক্যাম্পেইন।

ঠিক এখানেই হাইকম্যান্ডের হস্তক্ষেপের দরকার ছিল। কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব কী করল? সম্পূর্ণ নির্বাচন ছেড়ে দিল ভূপিন্দর হুডার হাতে। ৯০ আসনের মধ্যে ৭০টি আসনে প্রার্থী নির্বাচন করলেন ভূপিন্দর হুডা। শেলজা পেলেন মাত্র নয়টি। কানাঘুষো শোনা যায়, যেখানে ভূপিন্দর হুডার প্রার্থী ছিল না, সেখানেও ‘ইন্ডিপেনডেন্ট’ দাঁড় করিয়েছিলেন হুডা। জাঠ সমীকরণ শক্তিশালী করতে গিয়ে অ-জাঠ ওবিসি এবং দলিত ভোট হারাল কংগ্রেস। অবস্থা এমন পর্যায়ে, যে এখনও পর্যন্ত হরিয়ানা বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা নির্বাচন করতে পারেনি কংগ্রেস।

সমস্যা ঠিক এখানেই। ভারতীয় রাজনীতিতে ব্যক্তি দলকে জেতান না। দল ব্যক্তিকে জেতান। ইন্দিরা গান্ধি বা নরেন্দ্র মোদি যতই প্রভাবশালী হয়ে উঠুন না কেন, তাঁরা একক কৃতিত্বে কোনও একটি রাজ্যে ভোট বৈতরণী পার করেছেন, এমন দাবি কেউ করতে পারবেন না। ভোট রাজনীতির নানা স্তর থাকে, পেঁয়াজের খোসার মতো সেই স্তরবিন্যাসে ঢুকতে হয় একটা রাজনৈতিক দলকে। নরেন্দ্র মোদির হয়ে সেই কাজটা করেন অমিত শাহ। প্রতিটি রাজ্যে একজন করে এমন নেতা তৈরি করেন, যাঁর হাতে পুরো রাজ্যের রাশ থাকবে। মহারাষ্ট্রে দেবেন্দে ফড়নবীশ। অসমে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। হরিয়ানায় প্রথমে মনোহরলাল খট্টর এবং পরে নয়াব সিং সাইনি। রাহুল গান্ধির হয়ে সেই কাজটা করার লোক কোথায়? একসময় তাঁর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া, মিলিন্দ দেওরা এবং জিতিন প্রসাদ এখন অন্য দলে। সিন্ধিয়া দল ছেড়েছিলেন দিগ্বিজয় সিং এবং কমলনাথের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের কারণে। অপরদিকে, সচিন পাইলট টিকে গেলেও, রাজস্থানে তাঁর সঙ্গে অশোক গেহলতের সমীকরণ কারও অজানা নয়। গৌরব গগৈ অসমে ব্যর্থ। বিহার এবং উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের কোনও মুখ নেই। সংকর্ষণ ঠাকুর তাঁর বইতে লিখেছেন, বিহারে কংগ্রেসের নির্বাচনী ভাগ্য লালুপ্রসাদ যাদবের হাতে। উত্তরপ্রদেশে ২০২৪ নির্বাচনে যে সাফল্য কংগ্রেস পেয়েছে তাঁর কৃতিত্ব মূলত অখিলেশ যাদবের।

আরও পড়ুন- ১০ বছর পর প্রথম! কেন রাহুল গান্ধিকে সংসদে বিরোধী দলনেতা করল কংগ্রেস?

আসলে সমস্যাটা কংগ্রেসের রাজনৈতিক ঘরানায়। শেষবার, নিজেদের কৃতিত্বে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল আজ থেকে চার দশক আগে। নব্বই পরবর্তী ভারতীয় রাজনীতি জাতিবাদ বা আরও নির্দিষ্টভাবে ওবিসিকরণের উপর নির্ভরশীল। তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে ভোট ব্যাংক হিসাবে নিজেদের শক্তিশালী করেছে দলিতেরা। বিজেপির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান ভোট চলে গিয়েছে আঞ্চলিক দলগুলোর দিকে (সব থেকে বড় উদাহরণ হলো বিহার, ভাগলপুর দাঙ্গার পরে মুসলমানদের মসিহা হয়ে ওঠেন লালুপ্রসাদ যাদব), অপরদিকে উচ্চবর্ণের মধ্যে ব্রাহ্মণ ভোট সরে যায় বিজেপির শিবিরে। ফলত, কংগ্রেসের ট্র‍্যাডিশনাল ব্রাহ্মণ+দলিত+মুসলমান ঐক্যে ফাটল ধরে। পাশাপাশি, ওবিসি রাজনীতির সঙ্গে কংগ্রেসের ঐতিহাসিকভাবেই তেমন সংযুক্তি নেই। ভারতে ওবিসি রাজনৈতিক নেতাদের বড় অংশই (লালুপ্রসাদ যাদব, মুলায়ম সিং, শরদ যাদব, দ্রষ্টব্য) অ-কংগ্রেসি রাজনীতির ফসল। বিজেপির ২০১৪ এবং তৎপরবর্তী সাফল্যও মূলত ওবিসি ও মধ্যবর্ণের ভোট এককাট্টা করেই।

ফলত, রাহুল গান্ধির লড়াইটা কঠিন। বিগত বছরে তাঁর সংবিধানের সংকল্প, ভারত জোড়ো যাত্রা তাঁকে গান্ধি পরিবারের সুরক্ষিত আসন ছেড়ে মানুষের মাঝখানে জায়গা করে দিয়েছিল। কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়েছে কি? পরিসংখ্যান বলছে, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল, উত্তরাখণ্ড এবং ছত্তিশগড়ে সরাসরি কংগ্রেস বনাম বিজেপি লড়াইতে ল্যাজেগোবরে হয়েছে কংগ্রেস। এর মধ্যে, হিমাচল বাদে আর কোথাওই কংগ্রেসের এমন কোনও নেতা নেই যিনি নিজের দক্ষতায় একটি গোটা রাজ্যে তাঁর দলকে জিতিয়ে আনতে পারেন। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো শুরু হয়েছে ইন্ডিয়া জোটে ক্ষমতার লড়াই। এ কথা সত্য, তিনি তাঁর পরিবারের একমাত্র নেতা যিনি এতটা কাঠিন্যের মুখোমুখি। তাঁর বাবা রাজনীতি করেছেন সোনার চামচ মুখে নিয়ে। তাঁর ঠাকুমার কাজটাও এতটা কঠিন ছিল না। কাজেই সমস্ত অপারগতার উত্তর তাঁকেই খুঁজে বের করতে হবে।

আগামী পাঁচ বছরে তা কি সম্ভব?

More Articles