রামনবমী ঘিরে দাঙ্গা পরিস্থিতি, ভারতের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সংঘাত ফিরে ফিরে এসেছে
ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনার প্রসঙ্গ বিগত আট বছরের অনেক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বারবার ফিরে এসেছে। ৪২ তম সংশোধনীতে 'ধর্মনিরপেক্ষ' শব্দটি যোগ হয়, কিন্তু জাতির জনকরা তার বীজ বপন করে দিয়েছিলেন সংবিধান প্রণয়নের সময়েই। দেশভাগ ধর্মের নিরিখে হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ক্ষমতার ভাগবাঁটোয়ারার পরেও হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান, শিখ, বৌদ্ধ, ইহুদি, পার্সি- সব ধর্মের মানুষ মিলিয়েই তৈরি হয় ভারত। কিন্তু দেশ তার আগে জাতিবিদ্বেষ, ধর্মীয় দাঙ্গা দেখেছে, তাই সব ধর্মকে সুরক্ষা দিতে, সব ধর্মাবলম্বীদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করতে জন্ম হয় ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের।
দেশে একই সঙ্গে নবরাত্রি ও ইদ পালিত হয়েছে, সেই সঙ্গে আনন্দে মেতেছে বড়দিনেও। ঠিক সেইভাবেই বাংলার ঘরে চৈত্র মাসে পালন হয়েছে অন্নপূর্ণা পুজো, রমজানের পর ইফতার। দেশের অন্য প্রান্তে উদযাপন হয়েছে রামনবমী ও সারাদিন উপবাস করার পর ইফতার এবং নামাজ পড়া। কিন্তু সাম্প্রদায়িক সংঘাতও থেমে থাকেনি। বিগত আট বছরে তা যেন ক্রমে পরিণত হয়েছে এক প্রবণতায়। উত্তরপ্রদেশে রামনবমীর মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঘিরে দাঙ্গা পরিস্থিতি তৈরি হওয়া যেন সেই প্রবণতাকেই সিলমোহর দেয়।
গত দুই তিন বছর ধরেই দেখা গেছে, পুজোর চেয়ে শোভাযাত্রায় ও মিছিলে আড়ম্বর বেশি। মিছিলে অস্ত্রের ছড়াছড়ি, সঙ্গে উত্তেজক স্লোগান, গান। বেশিরভাগ জায়গাতেই সংখ্যাগুরুর মিছিল এগিয়েছে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা দিয়ে। দেশজুড়ে এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে এবং সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়েছে। রাজধানীর কথাই ধরা যাক। অভিযোগ, দক্ষিণ, পূর্ব এবং উত্তর দিল্লির পৌর এলাকায় জারি হয় নির্দেশিকা, যার বক্তব্য হল, এই উৎসবের সময় কোনওভাবেই মাংসের দোকান খোলা রাখা যাবে না। যতদিন না উৎসব শেষ হচ্ছে, দোকান বন্ধ রাখতে হবে। বলাই বাহুল্য, বেশিরভাগ দোকানেরই মালিক মুসলমান।
আরও পড়ুন: গোরখনাথ মন্দিরে হামলা কি নতুন অশান্তির সলতে পাকাবে উত্তরপ্রদেশে?
শুধু এই কারণেই নয়, দিল্লি শিরোনামে এসেছে আরও একটি কারণে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে রামনবমীকে কেন্দ্র করে এবিভিপি এবং বাকি ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। অভিযোগ, হোস্টেলে কেন আমিষ খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে প্রশ্ন তুলে হামলা চালায় এবিভিপি। সেই সঙ্গে তারা ক্যাম্পাসের মধ্যেই মিছিল বার করে এবং বামপন্থীদের বিরুদ্ধে কটূক্তি এবং হুমকি দেয়, মারধর করে। এবিভিপির পাল্টা অভিযোগ, ক্যাম্পাসে তাদের রামনবমীর পুজো ভেস্তে দেয় বামপন্থীরা, সেই কারণেই অশান্তি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিসেই স্পষ্ট যে, অশান্তি হয়েছে খাবার নিয়েই।
এ তো গেল রাজধানীর কথা। গুজরাত থেকে ঝাড়খণ্ড, পশ্চিমবঙ্গ থেকে মধ্যপ্রদেশ সব জায়গাতেই এই ধরনের সাম্প্রদায়িক হিংসা দেখা গেছে এবং সর্বত্রই উসকানি দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সঙ্ঘ ও বিজেপির বিরুদ্ধে।
সামনে এসেছে অনেক ভিডিও, যেখানে দেখা যাচ্ছে, মসজিদের সামনে অস্ত্র উঁচিয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কোথাও দেখা যাচ্ছে, প্রকাশ্যে বিজেপির এক বিধায়ক হুমকি দিচ্ছেন, রামনাম না গাইলে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে।
আরও পড়ুন: জগন্নাথ মন্দিরে ৪০টিরও বেশি চুলা ভেঙে ফেলা হল, অপরাধী কি মন্দিরের ভেতরেই?
হিংসার খবর এসেছে পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া থেকেও। ঠিক একই কায়দায় উসকানিমূলক মন্তব্য, সেই থেকে অশান্তি এবং হিংসার সূত্রপাত। এমন একটি জায়গায় এই হিংসার ঘটনা ঘটেছে যেখানে স্থানীয়রাও মনে করতে পারছেন না যে, আগে কবে এই রকম ঘটনা ঘটেছিল।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যে গোটা দেশে একই ধরনের ঘটনা থেকে হিংসার সূত্রপাত কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো হতে পারে না। এর পিছনে কি রয়েছে গভীর চক্রান্ত? নাহলে কেন নয়টি রাজ্যে হিন্দু ধর্মের উৎসবে মসজিদের সামনে দিয়ে মিছিল যাবে? কেনই বা প্রকাশ্যে ওই ধরনের গান গাওয়া হবে? কেন অন্য সম্প্রদায়ের মানুষকে উস্কানি দিয়ে হিংসার পথে আনতে বাধ্য করা হচ্ছে? এবং হিংসা শুরু হলেই তাদের ওপর ঘটনার সমস্ত দায় চাপিয়ে দাঙ্গাকে যৌক্তিকতা দেওয়া হচ্ছে?
উত্তর খুঁজতে আমাদের নিতে হবে ইতিহাসের আশ্রয়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই আরএসএস ধর্মীয় উৎসবকে হাতিয়ার করেছে, পরিণত করেছে হিংসার বাতাবরণে। ধর্মীয় উন্মাদনার জিগির তুলে তারা আক্রমণ শানিয়েছে দেশের ধর্মনিরপেক্ষতার কাঠামোতে। যখনই দেশে রামনবমীর মতো উৎসব পালিত হয়েছে, সঙ্ঘ পরিবার তখনই চেষ্টা করেছে মিছিলের মাধ্যমে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করার। মিছিল মসজিদের সামনে দিয়ে নিয়ে গিয়ে, সাম্প্রদায়িক উসকানি দিয়ে দাঙ্গার আগুন লাগাতে চেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই পাল্টা জবাব এসেছে, মুসলমানরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে।
এই ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ধর্ম ও রাজনীতির যে রেখা, তাকে সুপরিকল্পিতভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বাবরি মসজিদ ভাঙা ও রামরথযাত্রার সময় থেকে ধর্মীয় আন্দোলনকে ভোটের রাজনীতিতে ফায়দা তোলার মাধ্যম করার চেষ্টা তীব্র হয়েছে, এবং বলাই বাহুল্য যে, এই কাজে তারা চূড়ান্ত সফল।
স্বাধীনতার পর কিছু বছর যদিও সঙ্ঘের এই কার্যকলাপ বিশেষ মাত্রায় চোখে পড়েনি কারণ গান্ধী হত্যার স্মৃতি জনমানসে ফিকে হয়ে যাওয়া তাদের জন্য খুব প্রয়োজন ছিল। ছয়ের দশকের শেষ থেকে তাদের এই কার্যপ্রণালী গতি পেতে শুরু করে। ১৯৭০ সালে স্বাধীন ভারত প্রথম ধর্মীয় মিছিলকে দাঙ্গার আগুনে পরিনত হতে দেখে। স্থান- মহারাষ্ট্রের ভিয়ান্ডি। যেভাবে এখন দেখা যাচ্ছে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় মিছিল এবং সেই থেকে হিংসা, সেই পরিকল্পনার প্রয়োগ করা হয়েছিল ভিয়ান্ডিতে। ১৬৪ জনের মৃত্যু হয় গোটা ঘটনায়, যার মধ্যে ১৪২ জনই ছিলেন মুসলমান।
২২ অক্টোবর, ১৯৭৭। বারানসিতে দুর্গাপুজোর শোভাযাত্রার দিক পাল্টে নিয়ে যাওয়া হল মুসলিম এলাকা দিয়ে, যা আগে কখনও হয়নি। মুসলমানরা আপত্তি জানান, সেই দিন কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু পরেরদিন অর্থাৎ ২৩ তারিখ আরও বড় একটি শোভাযাত্রা ওই এলাকায় ঢোকার চেষ্টা করে এবং শুরু হয় দাঙ্গা। ভাগ্যক্রমে হতাহতের সংখ্যা দশ ছাড়ায়নি।
১৯৭৮, জামশেদপুর। আরএসএস রামনবমীর মিছিল আদিবাসী এলাকা দিমনা বস্তি থেকে শুরু করে এবং মুসলমানদের এলাকা দিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু সেই বারে প্রশাসনিক তৎপরতায় কোনো সমস্যা হয়নি। ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে বালাসাহেব দেওরাস নামের একজন সঙ্ঘ নেতা উসকানিমূলক ভাষণ দেন, এবং আবারও ওই এলাকা দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার কথা হয়। চাপের মুখে পড়ে প্রশাসন বাধ্য হয় সেই মিছিলের অনুমতি দিতে। প্রায় পনেরো হাজার মানুষের মিছিল ঢুকে পড়ে ওই এলাকায়, দাঁড়ায় মসজিদের সামনে, এবং জামশেদপুর সাক্ষী হয় এক ভয়াবহ হিংসাত্মক দিনের। ১০৮ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ৭৯ জন মুসলমান।
১৯৮৩ সালের হায়দ্রাবাদ, ১৯৮৯ সালে হাজারিবাগ, কোটা, ভাগলপুর, তাতারপুর, ১৯৯০ সালে বরোদা, আনন্দ, সুরাট, কলোনেলগঞ্জ, কোলার, ১৯৯১ সালে সাহারানপুর, ১৯৯২ সালে সিতামার্হি, তালিকা বেশ লম্বা। বলাই বাহুল্য যে, এই তালিকায় অনেক নাম নেই কারণ সেগুলো ঠিকভাবে নথিভুক্ত নয়। প্রত্যেকটির কারণ এক, ঘটনাপ্রবাহের অসম্ভব মিল।
একবিংশ শতাব্দীতে এই ধরনের ঘটনা থামার জায়গায় গতি পেয়েছে, যাঁরা হিংসায় মদত দেওয়ার কাজ সামনে থেকে করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন উত্তরপ্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী। এই শতাব্দীর প্রথম দশকে উত্তরপ্রদেশে যোগী প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দু যুবা বাহিনী। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর কাজ সুপরিকল্পিতভাবে করতে থাকে যোগীর বাহিনী এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের লক্ষ ছিল ধর্মীয় উৎসব। ২০০৭ সালে যোগী দাঙ্গায় প্ররোচনা দেওয়ার জন্য জেলেও যান। আজ তিনি উত্তরপ্রদেশের দ্বিতীয়বার নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী পদের একজন দাবিদার।
এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, এই মেরুকরণের রাজনীতিই সঙ্ঘ পরিচালিত বিজেপির বিগত কিছু বছরে অভাবনীয় সাফল্যের কারণ। কিন্তু গত কয়েক মাসে কি মেরুকরণের তীব্রতা আরও বাড়িয়ে ফেলল তারা? হিজাব নিয়ে বিতর্কই হোক বা মাংসের দোকান জোর করে বন্ধ করানো হোক, মৌলবাদের ফাঁসে আমরা আরো বেশি করে জড়িয়ে যাচ্ছি, এবং তার প্রমাণ গত মাসে হওয়া পাঁচটি রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলাফল। পাঁচটির মধ্যে চারটিতেই জয়ী হয়েছে বিজেপি এবং তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে উত্তরপ্রদেশে।
আরএসএস এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সবথেকে বড় লক্ষ্য ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানো, এবং এই কাজে তাদের সবথেকে বড় ভরসা নরেন্দ্র মোদি নন, বরং যোগী আদিত্যনাথ। তিনি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় চলে আসায় কি আরও উৎসাহিত সঙ্ঘ পরিবার? তাই কি মেরুকরণের তীব্রতা আরও বেড়ে গেল?
সবচেয়ে মজার বিষয় হল, এই মানুষগুলো নিজেদের রাজনীতির কারণেই হোক বা ইসলামবিদ্বেষের কারণেই হোক, কথায় কথায় পাকিস্তানকে টেনে আনে, তাদের আক্রমণ করে, কিন্তু এরাই নিজেদের দেশকে পাকিস্তানের মতো মৌলবাদী দেশ বানাতে চান এবং সেই কথা প্রকাশ্যেই বলেন। অনেকের মতে, যারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লড়াইতে সামিল না হয়ে ইংরেজদের পক্ষ নেন, তাদের থেকে এটাই প্রত্যাশিত।