মস্কোয় মোদি! হিংসাদীর্ণ মণিপুরে বিধ্বস্তদের পাশে সেই রাহুলই

Rahul Gandhi at Manipur: ইতিমধ্যেই মণিপুরের জিরিবামে পৌঁছেছেন রাহুল। সেখানকার একটি ত্রাণ শিবিরেও যান তিনি। হিংসা ছড়ানোর পর থেকে যেখানে রয়েছেন অসংখ্য বাস্তুচ্যুত মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ।

জাতিহিংসায় উত্তাল মণিপুরে ফের পৌঁছে গেলেন বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধি। বছর ঘুরলেও পায়ের ধুলো পড়েনি প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদির। ভোট ঘুরে নতুন সরকার গঠন হয়েছে। লোকসভা ভোটে মণিপুরে আশানুরূপ ফল তো দূরের, কার্যত উত্তর-পূর্বের ছোট্ট রাজ্যটি প্রত্যাখ্য়ান করেছে বিজেপি সরকারকে। তার পরেও টনক নড়েনি মোদি সরকারের। লোকসভা অধিবেশনে একের পর এক বিরোধী সাংসদদের সমালোচনার মুখে পড়েছেন, মণিপুরের কংগ্রেস সাংসদ ক্ষোভে ফেটেছেন, তবে তাতেও কিছু আসে যায়নি গেরুয়া শিবিরের। মোদি তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে একের পর এক বিদেশ সফর সেরে চলেছেন। কখনও ইটালি, তো কখনও রাশিয়া। কিন্তু নিজের দেশের ছোট্ট রাজ্য মণিপুরের জন্য কোনও উদ্বেগ নেই প্রধানমন্ত্রী। সেখানে যাওয়ার সময় এখনও পর্যন্ত করে উঠতে পারেননি তিনি। সেই নিয়েই বিরোধীদের বারবার তোপের মুখে পড়তে হয়েছে নরেন্দ্র মোদিকে।

প্রায় এক দশক পরে বিরোধী দলনেতা পেয়েছে সংসদ। সেখানে মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্রধানমন্ত্রীকেই দুষেছেন রাহুল গান্ধি। কংগ্রেস নেতার দাবি, মণিপুর বিজেপির নীতি এবং রাজনীতির জন্যই ছাড়খার হয়ে গিয়েছে। অথচ বিজেপি এমন ভাব করছে, যেন মণিপুরে কিছুই নেই। বারবার তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেন, যাতে তিনি মণিপুরে একটি বার যান। মোদি যাননি। তবে গিয়েছেন রাহুল। চলতি বছরের গোড়ায় মণিপুর থেকেই ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা শুরু করেছিলেন রাহুল। সেখানকার মানুষের অবস্থা নিজের চোখে দেখেছিলেন, শুনেছিলেন নিজের কানে তাঁদের কথা। ফের একবার মণিপুরে রাহুল। বিরোধী দলনেতা নির্বাচিত হওয়ার পর এটাই তাঁর প্রথম মণিপুর সফর।

আরও পড়ুন: মণিপুর নিয়ে লাগাতার প্রশ্ন রাহুল-মহুয়াদের! বাধ্য হয়েই দায়সারা উত্তর মোদির?

গত বছর মে মাসে হিংসায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল মণিপুর। মেইতেই আর কুকিদের সংঘর্ষে প্রাণ গিয়েছে অন্তত আড়াইশো জনের। জখম ১৫ হাজারেরও বেশি। অসংখ্য মেয়ের সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়। ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য় হন অসংখ্য মানুষ। এখনও মণিপুরে গৃহহীন প্রায় ৬০ হাজার মানুষ। লোকসভা অধিবেশনে মণিপুরের কংগ্রেস সাংসদ অঙ্গোমচা বিমল অকোইজম তাঁর ভাষণে উল্লেখ করেছেন সেই তথ্য। বিরোধীদের একের পর এক অভিযোগ সত্ত্বেও মোদির মুখ থেকে শোনা গিয়েছে মণিপুর সম্পর্কে মাত্র দু-একটি কথা। ভোটের আগেও তিনি দাবি করেছিলেন, মণিপুরে শান্তি ফিরেছে। তার কৃতিত্বও তিনি দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও বিজেপি শাসিত মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংকে। রাজ্যসভায় ভাষণ দিতে উঠে তিনি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে এ-ও বলেন,মণিপুর নিয়ে যাঁরা ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন, মণিপুর একদিন নাকি তাঁদের প্রত্যাখ্যান করবে। এ-ও দাবি করেন, বিজেপি নাকি মণিপুরে শান্তি ফেরাতে ক্রমাগত কাজ করে চলেছে।

প্রধানমন্ত্রীর এ সমস্ত মিথ্যাভাষণের মধ্যেই ফের মণিপুরে রাহুল গান্ধি। ২০২৩ সালে হিংসা উস্কে ওঠার পরেও তিনি পৌঁছেছিলেন মণিপুরে। তার পরে ভারত জোড়ো যাত্রার সময় মণিপুরে পৌঁছয় তার কনভয়। এবং বিরোধী দলনেতা হয়ে আরও একবার। সেই হিসেবে এই নিয়ে তিন বার মণিপুর সফরে গেলেন রাহুল। ইতিমধ্যেই মণিপুরের জিরিবামে পৌঁছেছেন রাহুল। সেখানকার একটি ত্রাণ শিবিরেও যান তিনি। হিংসা ছড়ানোর পর থেকে যেখানে রয়েছেন অসংখ্য বাস্তুচ্যুত মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ। তাদের সঙ্গে দেখা করে কথা বলেন রাহুল। তাঁদের দাবিদাওয়া থেকে শুরু করে সুবিধা-অসুবিধা জানার চেষ্টা করেন। মণিপুরে যাওয়ার আগে অসমে গিয়েছিলেন বিরোধী দলনেতা। সেখানে বাস্তুচ্যুত কুকিদের শরণার্থী শিবিরটি ঘুরে দেখেন। অসমে বন্যা পরিস্থিতির জন্য বহু বিপর্যস্তই ওই ত্রাণ শিবিরটিতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এরই মধ্যে সোমবার ভোরে জিরিবামের গুলরথাল এলাকায় অজ্ঞাত পরিচয় বন্দুকবাজদের সঙ্গে গুলিবিনিময় হয় নিরাপত্তা বাহিনীর। তবে সেই অশান্তির পরোয়া না করেই সোমবার রাহুল পৌঁছন মণিপুরে। নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেন রাজ্যের পরিস্থিতি।

অসমের কাছাড় জেলার কুম্ভিগ্রাম বিমানবন্দর থেকে সড়কপথে মণিপুরের জন্য রওনা হন তিনি। মণিপুর যাওয়ার পথে লখিপুরের বন্যাত্রাণ শিবিরও যান তিনি। এদিন বেলায় রাহুল পৌঁছবেন চুরাচাঁদপুর ও বিষ্ণুপুরের মইরাংয়ের ত্রাণশিবিরগুলোয়। তেমনটাই কথা রয়েছে। অশান্তির সময় হিংসার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিল ওই জায়গাগুলি। এদিন সন্ধে বেলার দিকে মণিপুরে নির্বাচিত সংসদদের সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে রাহুলের। মণিপুর সংকট নিয়ে নিয়ে সে রাজ্যের রাজ্যপাল অনুসুইয়া উইকেইয়ের সঙ্গেও আলোচনায় বসার কথা রয়েছে কংগ্রেস নেতার।

 

মণিপুর প্রসঙ্গে উত্তাল হয়ে উঠেছিল সাম্প্রতিক এই লোকসভা অধিবেশন। প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা দিতে উঠলে বিরোধীদের 'মণিপুর' 'মণিপুর' স্লোগানে কেঁপে উঠেছিল সংসদ। তার পরেও মণিপুরের জন্য অতিরিক্ত একটাও শব্দ খরচ করতে চাননি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। বিরোধীদের চাপে গা বাঁচানোর মতো দু-একটা কথা বলেই মুখে কুলুপ এঁটেছেন তিনি। এই মুহূর্তে রাশিয়া গিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানে গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের কথা রয়েছে তাঁর। দু-দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ছাড়াও যে ইউক্রেন যুদ্ধের কথা উঠে আসতে চলেছে তাঁদের আলোচনায়, তাতে সংশয় নেই। অথচ নিজের দেশের ক্ষুদ্র একটি রাজ্যের অশান্তি নিয়ে মাথাব্যথা নেই বিজেপির। এদিন মণিপুর সফরে গিয়ে সেই বিষয় নিয়েই ফের তোপ দাগেন বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধি। ভোটের আগে নিজের অযোনীজাত এবং ভগবানের সৃষ্টি বলে দাবি করে বেশ হইচই ফেলে দিয়েছিলেন মোদি। সেই বিষয়টি নিয়ে বারবার কটাক্ষ করতে দেখা গিয়েছে বিরোধীদের। এবারের লোকসভা অধিবেশনেও প্রধানমন্ত্রীকে বারবার 'নন-বায়োলজিক্যাল' বলে কটাক্ষ করেছেন রাহুল। এদিন কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ নিজের এক্স হ্যান্ডলে দাবি করেছেন, "দেশের 'নন-বায়োলজিক্যাল' প্রধানমন্ত্রী যখন মস্কো যান, তখন বিরোধী দলনেতা যান অসম এবং মণিপুরের দিকে।" লোকসভা ভোটের আগে বিজেপি বেশ কিছু প্রচারমূলক বিজ্ঞাপনে দাবি করেছিল, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নাকি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ থামিয়ে দিয়েছেন। সেই বিজ্ঞাপন নিয়েও বহু দিন ধরে কটাক্ষ করে আসছে কংগ্রেস। এদিন কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ ফের সেই বিজ্ঞাপনের কথা তুলে ধরে বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দাগেন।

আরও পড়ুন:মণিপুরে চুপ থাকা মানে মেরি-রতন থিয়ামদের অপমান করা! মোদির উদ্দেশ্যে মণিপুরের সাংসদ

পাল্টা সোশ্যাল মিডিয়ায় তোপ দেগেছে বিজেপিও। রাহুল গান্ধির এই অসম ও মণিপুর সফরকে 'সিক ট্র্যাজেডি টুরিজম' বলেও কটাক্ষ করেন তারা। কংগ্রেস আমলে মণিপুরের অশান্তির কথা উল্লেখ করে তারা বিরোধী দলকে চাপে ফেলারও চেষ্টা করেছে সর্বৈব ভাবে। এবার লোকসভা অধিবেশনে রাহুল গান্ধিকে 'বালক-বুদ্ধি' বলে খোঁচা দিয়েছেন মোদি। সেই শব্দবন্ধ ব্যবহার করেই বিজেপি নেতারা পাল্টা তোপ ফিরিয়ে দিয়েছেন রাহুলকে। গত কয়েক দিন ধরে দিল্লির বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে শ্রমিকদের সঙ্গে দেখা করেছেন রাহুল। তাঁদের কাজে হাত লাগিয়েছেন। বোঝার চেষ্টা করেছেন তাঁদের আর্থিক ও সামাজিক সমস্যাগুলিকে। একেবারে তৃণমূল স্তরে নেমে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা এবং কায়িক শ্রমের মাধ্যমে উপার্জন করা মানুষকে বোঝার চেষ্টা করছেন রাহুল। তার পরেই তাঁর এই মণিপুর সফর।

More Articles