ইদের মরশুমে শহর ম ম করছে হালিমের গন্ধে, বাড়িতে বানানো সম্ভব এই বিশেষ রেসিপি?

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠে। তাই তো দুর্গাপুজোর একডালিয়া থেকে বড়দিনের পার্ক স্ট্রিট হয়ে রমজানে জাকারিয়া- সর্বত্র ভিড় জমায় বাঙালি। আর উৎসবের মেজাজ দ্বিগুণ করে সুস্বাদু খাবার।


এ-বছরের মতো রমজান প্রায় শেষ হতে চলল। আর কিছুদিন পরেই ইদ। কিন্তু ইফতারের হালিম ছাড়া তো রমজান অসম্পূর্ণ। তাই সন্ধে নামতেই জাকারিয়ার অলিতে-গলিতে হালিমের টানে দেখা মেলে ভোজনরসিক বাঙালির। কিন্তু হালিম কী? কোথা থেকে এল সুস্বাদু পদ? জেনে নেওয়া যাক সেকথা।

হালিম কী?
খুব সহজ কথায় বললে, বিভিন্ন রকমের ডাল, গম, মাংস এবং গরম মশলা একসঙ্গে ভালোভাবে মিশিয়ে জল সহযোগে সেদ্ধ করা হয়। জল শুকিয়ে এলে যে ঘন থকথকে মিশ্রণটি পড়ে থাকে, তাই হালিম। তবে হালিম যে শুধু রমজানের সময়ই খাওয়া যাবে, এমন কোনও কথা নেই।

আরও পড়ুন: চিনে খাবারের স্বর্গরাজ্য, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে কলকাতার এই এলাকা

হালিমের ভারত আগমন
হালিমের ভারত-প্রবেশের কথা জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে কয়েকশো বছর। হালিমের নাম আদতে হারিস। ষষ্ঠ শতকে এই হারিস তৈরি হত পারস্য সম্রাট খুসরোর হেঁশেলে। এরপর প্রায় এক শতক পরে দামাকাসের খলিফা ইয়েমেন থেকে আগত এক প্রতিনিধি দলের জন্য পরিবেশন করেছিলেন এই পদটি। সেই থেকেই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই পদ। সৈন্যবাহিনী যুদ্ধ থেকে পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরেও পুষ্টিকর এই পদটি খেতেন। চতুর্দশ শতকের বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবন বতুতার লেখাতেও হারিস পদটির উল্লেখ রয়েছে। হুমায়ূন যখন শের শাহ-র কাছে পরাজিত হয়ে পারস্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখন মোঘল রন্ধনশালাতেও স্থানীয় রাঁধুনি দিয়ে তৈরি হত এই পদ। তবে হারিস থেকে হালিম নাম হওয়ার পিছনে রয়েছে হায়দ্রাবাদের নিজামের ভূমিকা।


উনিশ শতকে নিজামের দেহরক্ষী হিসেবে ভারতে আসে একদল ইয়েমেনের যোদ্ধা। তাদের একটি গ্রাম দেওয়া হয় বসবাসের জন্য। এই যোদ্ধারা নিজেদের সনাতনী খাবার ও স্থানীয় মালমশলা মিশিয়ে তৈরি করলেন হারিসের নতুন রূপ হালিম। তখন হালিম তৈরি হত শুধু গোরুর মাংস দিয়ে। নোনতা এবং মিষ্টি দু'রকম হালিমই রান্না করতেন তাঁরা।


এ-ব্যাপারে উল্লেখ্য, মটন এবং বিফ হালিমই হল প্রকৃত হালিম। বাকি এখন যে ডায়েট হালিম, চিকেন হালিম, ভেজ হালিম বিভিন্ন দোকানে পাওয়া যায়, তা বাজারে টিকে থাকতে পরবর্তীকালে তৈরি করা হয়েছে।

কোথায় পাবেন হালিম?
কলকাতার বিভিন্ন বিখ্যাত রেস্তোরাঁয় এই সময় হালিম পেয়ে যাবেন অনায়েসেই। জাকারিয়া স্ট্রিট ছাড়াও কলকাতার যে জায়গাগুলিতে হালিম চেখে দেখতে পারেন, সেগুলি হল ইন্ডিয়া রেস্তোরাঁ, আমিনিয়া, আরসালান, জিশান, সিরাজ গোল্ডেন রেস্তোরাঁ।

কীভাবে বাড়িতে রান্না করবেন হায়দ্রাবাদী হালিম?
এই পদের রেসিপি রীতিমতো আগলে রাখেন হায়দ্রাবাদের বিভিন্ন রেস্তোরাঁর রাঁধুনিরা। তবে বাড়িতেই বানিয়ে খেতে পারেন হালিম। রইল হালিম তৈরির রেসিপি।

উপকরণ:
মটন (১ কেজি, ছোট করে টুকরো করা), ২০০ গ্রাম ডালিয়া, ১০০ গ্রাম ছোলার ডাল, ১০০ গ্রাম অড়হর ডাল, ১০০ গ্রাম মুগ ডাল, ১০০ গ্রাম কলাইয়ের ডাল, ৫০০ গ্রাম পেঁয়াজ (কুচি করে কাটা), ১ চামচ হলুদ গুঁড়ো, ১ চা চামচ শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো, ১ টেবিল চামচ আদা-রসুন বাটা, ধনেপাতা ১ আঁটি (কুচানো) ও পুদিনা পাতা ১/২ চামচ ( কুচি করে কাটা), ১ টেবিল চামচ কাঁচালঙ্কা বাটা, ১ চা চামচ গরম মশলা, তেল ও ঘি সমপরিমাণে (কমপক্ষে ১৫০ গ্রাম করে), এক কাপ টক দই, ১ চা চামচ জিরা ও গোটা গোলমরিচ, গোটা কাজু, পেস্তা, কিসমিস, আমন্ড, (একমুঠো সাজিয়ে দেওয়ার জন্য) নুন পরিমাণমতো।

প্রণালী:
সব রকমের ডাল ও ডালিয়া ভাল করে ধুয়ে সারারাত ধরে শুকিয়ে নিন। এরপর রান্নার সময় ডালিয়া ও ডাল একসঙ্গে হালকা করে ভেজে ভালোভাবে সিদ্ধ করে নিন মিশ্রণটি। একটি পাত্রে মটন, দই ও নুন দিয়ে অন্তত ঘণ্টাদুয়েক ম্যারিনেট করে রাখুন। সারা রাত ধরে মাংস মেখে রাখতে পারলে আরও ভালো, কারণ এতে মাংস ভালো করে নরম হবে। কড়াইতে তেল-ঘি মিশ্রণে পেঁয়াজ ভেজে তুলে নিন। তারপর তাতে সিদ্ধ ডালিয়া ও ডালগুলি দিয়ে কিছুক্ষণ রান্না করুন। এবার ম্যারিনেট করে রাখা মটনটা অন্য একটি পাত্রে দিয়ে ভালোভাবে নাড়তে থাকুন। মটন রং পরিবর্তন করলে তাতে একে একে জিরা, গোলমরিচ, কাঁচালঙ্কাবাটা, আদা-রসুনবাটা, লঙ্কাগুঁড়ো, পেঁয়াজভাজা (অর্ধেক পরিমাণে) দিয়ে অল্প আঁচে মিনিট পনেরো কষিয়ে নিন। আগে থেকে গরম করে রাখা পরিমাণমতো জল ঢেলে, ঢাকা দিয়ে এই মটন অন্তত ঘণ্টাখানেক কষাতে হবে। মাংস সিদ্ধ হয়ে গেলে তাতে ডালের মিশ্রণটি যোগ করুন। তেল বেরনো অবধি অপেক্ষা করুন। যে তেল বেরবে, তা ফেলে দিন। তৈরি আপনার হালিম। এবার তাতে ধনে পাতা কুচি, পুদিনা পাতা এবং ভাজা পেঁয়াজ ছড়িয়ে পরিবেশন করুন গরম গরম।

More Articles