স্বাদের পাড়া ঘুরে স্মৃতির তর্পণ: শ্রীভোজনেষু রসেবশে রসনায়
Book Review: খাবারের স্বাদও একধরনের স্মৃতি। তাই একেকটা পদের সঙ্গে জড়িয়ে যায় একেকরকমের আবেগ, একেকটা বয়স, একেকটা হলুদমাখা হাতের গন্ধ। সেই নস্টালজিয়ার পাড়ায় হেঁটে আসা আসলে এক তর্পণ।
কথায় বলে 'রসেবশে বাঙালি'। আর সেই রসের প্রায় নব্বই শতাংশই যে জুড়ে রেখেছে বাঙালির ভোজনপ্রীতি, তা আলাদা করে বলার দরকার হয় না। উৎসব হোক বা পার্বণ, প্রায় সমস্ত ব্যাপারেই খাবারদাবারের একটা বিরাট মাহাত্ম্য রয়েছে। বারো মাসের তেরো কিংবা ছাব্বিশ পার্বণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রয়েছে সেই সব খাবারদাবার। আর এই খাবারদাবারের ব্যাপারে ভোজনরসিকের জিভে অন্তত কোনও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের জায়গা নেই। কারণ কথাতেই আছে, 'আপরুচি খানা'। আর জিভে প্রেম করে যেই জন, তাঁর কাছে যে সবার উপরে খাবার সত্য, তাতে ভুল নেই একবিন্দুও। ভারতবর্ষ নানা ভাষা নানা জাতির দেশ। অন্তত তেমন কথাই বলে এসেছে সংবিধান। তেমনটা ভেবে এসেছে এতদিন মানুষও। যদিও আজকের দিনে তীব্র ধর্মাধর্মের চর্চা যেভাবে আমাদের চর্জায় জোরজাবস্তি করে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, তাতে আগামী কয়েক বছরে বিরিয়ানি বা কাবাব দেখে যে কেউ ভ্রূকুঞ্চিত করবেন না তা নিশ্চিত ভাবে বলা শক্ত। কিন্তু 'দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে'-র নীতি মেনেই এতদিন ধরে বিভিন্ন ধরনের আঞ্চলিক খাবারদাবার আমাদের সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছে। তা নিয়ে কেউ মুখ ব্যাঁকায়নি। 'চেয়ার-টেবিল', 'কাপ-ডিশ' বা 'আলমারি'-র মতো বিদেশি শব্দের ন্যায় সেসবও ঢুকে পড়েছিল আমাদের তথাকথিত ভোকাবুল্যারিতে। তাই বিরিয়ানি-কাবাবের মতো মোগলাই খাবার যেমন আমাদের মজিয়েছে, তেমনই ভালোবাসতে বাধ্য করেছে চিনা-জাপানি-মাদ্রাজি কিংবা সুদূর তিব্বতের সব আঞ্চলিক ডিশ।
খাদ্যবিশ্বকে যদি একটি মানচিত্র হিসেবে ধরা যায়, তবে সেই ম্যাপবইয়ের উপর সদর্পে ম্যাপ পয়েন্টিং করতে করতে চলেছেন লেখক সুরবেক বিশ্বাস। পেশায় সাংবাদিক সুরবেকের জিভটি যেমন ধার, তেমনই ধারালো তাঁর স্মরণশক্তি। আর সেই ধারই প্রতি ছত্রে ছত্রে পাঠক টের পাবেন মান্দাস প্রকাশিত তাঁর 'শ্রীভোজনেষু রসেবশে রসনায়' বইতে। খাওয়াদাওয়া নিয়ে লেখা বলতে মানুষ প্রথমেই বোঝান বিভিন্ন ধরনের রেসিপি বইয়ের কথা। যেখানে এক কিলো মাংসে স্বাদমতো নুন নাকি চিনি আন্দাজমতো, তা খুঁজে বের করতেই বয়স ঘুরে যায় আম-পাঠকের। তাতে সদ্য়বিবাহিত বধূটি কিংবা চাকরিসূত্রে বিদেশে থাকা ছেলেটির জীবনধারণে এবং ক্ষুধাবৃত্তি নিবারণে কিঞ্চিৎ সুবিধা হয় বটে। তবে খাবার মানে তো আর শুধুমাত্র রেসিপি নয়। খাবার আসলে স্মৃতির মতো। যা মুহূর্তে নিয়ে যেতে পারে শৈশবের মনোভূমি কিংবা যৌবনের বৃন্দাবনে। খাবারের স্বাদ জুড়ে থেকে যায় কত কত বয়সের ছায়া, জায়গার মায়া। সেসবকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়াও একধরনের যাত্রা। যে পথকে কলকাতার মতোই হেঁটে দেখতে শিখতে হয়!
আরও পড়ুন: রক্ত-মাংস-কফ-শ্লেষ্মায় গড়া ফাঁপা সময়ের গল্প: যাহা বলিব সত্য বলিব
আর সেই পথেই হেঁটেছে 'শ্রীভোজনেষু রসেবশে রসনায়'। বইয়ের নাম এবং সূচনা এমনই একটি সম্বোধন দিয়ে। কারণ খেতে ভালোবাসলেই সকলে ভোজনপ্রিয় কিংবা শ্রীভোজনেষু হন না। কিন্তু লেখকের বিশ্বাস, এই বই যাঁরা পড়তে আসছেন বা আসবেন, তাঁরা সেই ভোজনবিলাসী মন নিয়েই আসবেন। কারণ এ বই নেহাৎ রেসিপি লেখা রান্নার বই নয় আদৌ। বরং এ বই জুড়ে অলিগলি শহরতলির খাদ্যভুবনের কথা ছড়িয়ে আছে প্রায় প্রতি পাতায়, প্রতি ছত্রে। তা কি শুধুই ভালো কথায় মোড়া? না, তা-ও নয়। বরং খাবারের সত্যিটাকেই এ বই জুড়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন লেখক। ভোজনপ্রেমিকদের হাতেগরম রেফারেন্স বই যদি চান, নির্দ্বিধায় ভরসা করতেই পারেন মান্দাস প্রকাশনীর এই বইটির উপরে।
কলকাতা কল্লোলিনী। আর তা যে শুধুমাত্র তাঁর ভৌগোলিকতা বা বাসিন্দাদের জোরে, তা কিন্তু নয়। এই শহর-কলকাতার হ্লাদিনী শক্তি তার খাবার। অনেকেই মনে করেন, কলকাতার মতো স্ট্রিটফুড সমৃদ্ধ শহর কমই আছে। হ্যাঁ, বলতেই পারেন মুম্বইয়ের বড়াপাও বা পাওভাজি, দিল্লির ছোলে-ভটুরের এই যে দ্বিগ্বিজয়ী মানমর্যাদা, তা কি মিথ্যে নাকি! একেবারেই নয়, তবে কলকাতার মতো এই বিপুল বৈচিত্র্য, অন্য কোনও শহরে পাওয়া কঠিন। ফুচকা থেকে হরেক রকমের তেলেভাজা, এগরোল থেকে চাউমিন, ধোসা থেকে পাপড়িচাটের যে বিরাট স্ট্রিটফুডের রেঞ্জ কলকাতায় মেলে, আর পৃথিবীর আর কোথাও মেলে কিনা সন্দেহ। এখন তো গলিতে গলিতে মোড়ে মোড়ে প্রতিদিন নতুন নতুন গজিয়ে ওঠা ক্যাফে, রেস্তোরাঁ। তাতে এত ধরনের কুইজিন, এত নানা স্বাদের খাবার! কিন্তু তাদের মধ্যে থেকে স্বাদে-মানে সেরা কোনগুলি? কে বলে দেবে? যুগের হাওয়া পালে নিয়ে আজও কারা নিজেদের মৌলিকতা বজায় রেখেছে, কারা হারিয়েছে কৌলিন্য? সেই সমস্ত সওয়ালের 'ছাত্রবন্ধু' এই 'শ্রীভোজনেষু রসেবশে রসনায়'।
খাবারের ক্ষেত্রে এক এবং একমাত্র বিচার্য তার স্বাদ। তেমনটাই বিশ্বাস করেন লেখক। তাই বাহুবলী রেস্তোরাঁ-চেনদের তাবেদারি নয়, বরং সত্যি কথাটা সত্যিভাবেই লিখতে পেরেছেন তিনি। আর সেটাই এই বইয়ের ইউএসপি। তার নেই খাবারবিশ্বের মানচিত্রে তাই ঘুরতে ঘুরতে ঢুকে পড়েছে পুরীর হোটেল, কখনও ঢুকে পড়েছে বাঁকুড়া-ঝিলিমিলির পাশের অখ্যাত, অস্থায়ী তেলেভাজার দোকান, কখনও বা ডুয়ার্সের সুস্বাদু বরেলি মাছের ঝোলের গল্প। খাবারের আবার সীমানা হয় নাকি! অন্তত কলকাতা যে সীমানা-সীমান্তের খেলা বহুকাল আগেই ভেঙে ফেলেছে অন্তত খাবারের ক্ষেত্রে, তা বলতে দ্বিধা হয় না। সে কারণেই ইদের আগে ভিড়ে ফেটে পড়ে জাকারিয়া স্ট্রিট। না, ধর্মীয় মতান্তর বা বিশ্বাস সেই সুস্বাদের পথে বাধা হয়নি কোনওদিন। হবেও না, তেমনই আশা। যে দেশ আখলাক কিংবা পেহেলু খানদের গণরোষ দেয়, গণবিচারে মৃত্যুদণ্ড দেয়, সে দেশে কলকাতা শহর যে খাবারে সেই মৌলিক সার্বভৌমত্ব বজায় রাখতে পেরেছে, তা আশার কথা বটে। সুরবেক ছোট থেকে ঘুরেছেন সেই কলকাতার রাস্তায়। যে কলকাতার ফুড-ম্যাপে ঢুকে পড়েছে সিকিমের স্বাদ, কার্শিয়াংয়ের মোমো, নেপালি থালির সুঘ্রাণ কিংবা জগন্নাথ ধামের সেই 'ইম্প্রোভাইজড আমেরিকান প্ল্যান' থালি, যে খাবারের পাতে উঠে এসেছে বিভিন্ন আঞ্চলিক খানা-খাজানা।
নামী বা বড়, এমনকী পাঁচ-সাত তারা হওয়ার সঙ্গে যে খাবারের মানের কোনও যোগাযোগ নেই, তা গোড়া থেকেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন লেখক। তাই পার্ক কিংবা পিটারক্যাটের মতো নামী রেস্তোরাঁ-র খাবারের ভুলত্রুটিখানি তুলে ধরতে ভোলেন না তিনি। যেমন ভোলেন না চাঁদনী চকের অখ্যাত বিনোদের আলুর চপের প্রশংসা করতে। সেই সব আলোচনা ঘোরে স্মৃতির পাড়া। যেখান থেকে রত্নের মতো উড়ে আসে একটি একটি করে রেস্তোরাঁ, খাবারের দোকান কিংবা মিষ্টির দোকানের নাম। এই যেমন ধরুন কলেজস্ট্রিটের কাছে বিখ্যাত চপের দোকান কালিকা। দেদার নাম, কিন্তু তার চপ কি সত্যি স্বাদে এবং আহ্লাদে স্টার মার্কস? কিংবা ধরুন এই যে বিখ্যাত পুঁটিরামের কচুরি, তার থেকে কিন্তু লেখক এগিয়ে রেখেছেন হেয়ার স্ট্রিটের ‘বিনোদবিহারী নাগ গণেশচন্দ্র দত্ত’ নামের অভিজাত মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কচুরিকে। যেখানে কিনা সঙ্গে মিলত অভিনব মুগের ডাল। তেমন স্বাদ ভূ-ভারতে মেলা শক্ত বলেই জানিয়েছেন লেখক।
তেমন ভাবেই বই জুড়ে উঠে এসেছে একের পর এক খ্যাত-অখ্যাত খাবারের দোকানের গল্প, তাদের মৌলিক স্বাদের গল্প। তাতে যেমন অভিজাত রেস্তোরাঁগুলি রয়েছে, তেমনই রয়েছে ফুটপাথের ছোট ডুম আলো জ্বলা দোকানে নামও। দর্শনধারী আড়ম্বরে হয়তো তারা মাত দিতে পারেনি আজকের যুগকে, তবে খাবারের মানের সঙ্গে সমঝোতা করেনি একচুলও। আসলে ব্যবসায়ীক সাফল্যের চাবিকাঠি যে মুনাফায় নেই, লুকিয়ে রয়েছে আসলে পণ্যের মানে, সে কথা খাবারের ক্ষেত্রেও ধ্রূব সত্য। তাই আজও সততার উপরেই যে জনপ্রিয়তার ভিত্তিপ্রস্তর দাঁড়িয়ে থাকে, তা মনে করিয়ে দিয়েছেন লেখক বারবার।
বাঙালি মানেই মেছো। আর সেই বাঙালির ভ্রমণপিপাসা-ভরা লেখায় মাছেদের জায়গা হবে না, তাই আবার হয় নাকি! তাই এ বইয়ে উঠে এসেছে ভেটকি থেকে বরেলি, পাবদা থেকে কইয়ের সাবেক রান্না এবং স্বাদের গল্প। লেখক যে শুধু ভোজনরসিকই নন, একাধারে খুন্তি-কড়াইতেও তাঁর হাতটি যে পাকা, তা বুঝতে পাঠকের দেরি হবে না। কারণ কখন যে খাবারের গল্প বলতে বলতে খাবারের রেসিপিটিও পাক্কা রাঁধুনীর মতো লিখে ফেলেছেন লেখক, তা নিজেও বোধহয় জানতে পারেননি। ফলে যে সমস্ত পাঠক শুধু খেতে নয়, রাঁধতে ও খাওয়াতে ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য বইয়ের কোন মোড়ে সেজেগুজে দাঁড়িয়ে থাকবে আস্ত এক-একটা রেসিপি, তা বলে দেওয়া কঠিন। আর তার জন্য বইটি পড়তে হবে। ঘুরে দেখতে হবে বইয়ের পাড়া-বেপাড়া। তবে ক্রমশ যে খাবারদাবার নিয়ে নিজস্বতা এবং আগের সেই কৌলিন্যটি হারাচ্ছেন বাঙালি, এ তাঁর বড় দুঃখের জায়গা। কারণ খাবারদাবার নিয়ে এককালে বাঙালির যে আবেগ এবং ঋজু শিরদাঁড়াখানি শরীরে অবস্থান করত, তা বাতে-পক্ষাঘাতে ক্রমশ শয্যাশায়ী। আজকের ভোজনরসিকেরা মুড়ি আর মিছড়িতে তফাৎ ভুলেছেন, বইয়ের প্রথম পর্বে সেই আক্ষেপ বারবার এসেছে লেখায়।
আরও পড়ুন: নয়ের দশকের স্মৃতি ও একটি সমকামী ভালবাসার পরিণতি
কিন্তু সত্যিই কি অপসৃয়মান বাঙালির সেই মৌলির খাদ্যরসিক মনটি? সত্যিই কি একে একে নিভিছে মন্দিরের সমস্ত দেউটি। তার উত্তর মিলবে সুরবেকের বইতেই। কেন স্মৃতি ঘেঁটে খাবারের কথা তুলে আনেন তিনি? কোন দায়ে? তার উত্তর দিয়েছেন লেখক এক দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। আগেই বলেছি, আসলে খাবারের স্বাদও একধরনের স্মৃতি। তাই একেকটা পদের সঙ্গে জড়িয়ে যায় একেকরকমের আবেগ, একেকটা বয়স, একেকটা হলুদমাখা হাতের গন্ধ। সেই নস্টালজিয়ার পাড়ায় হেঁটে আসা আসলে এক তর্পণ। স্মৃতির প্রতি, আঞ্চলিকতা, ধর্ম বা জাতির উর্ধ্বে উঠে গিয়ে যে খাবার শুধুই স্বাদের কথা বলে, তা দেশি না বিদেশি, তা সাবেক না অর্বাচিন, তার পরোয়া করে না, সেই সংস্কৃতির পাড়া বেড়ানোই উদ্দেশ্য এই বই। ব্যবসা নয়, রান্না আসলে শিল্প। আর সেই শিল্পের বড় কথা মুনাফা নয়, আজও সততা। আর সেই সত্যের এক অক্লান্ত দলিল 'শ্রীভোজনেষু রসেবশে রসনায়'।
বই: শ্রীভোজনেষু রসেবশে রসনায়
লেখক: সুরবেক বিশ্বাস
প্রকাশনা: মান্দাস
প্রচ্ছদ: সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
মূল্য: ৫৫০ টাকা