৬০০ বছরের ঐতিহাসিক পাহাড়ি খাবার! মোমো কীভাবে ভারতে এল জানলে চমকে যাবেন...
History of Momo: নেপালে মোমোর জন্ম। মোমোর ইতিহাস খুঁড়তে গেলে যেতে হবে চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে।
এককালে সন্ধা হলে চপ-মুড়িই ছিল বাঙালির নির্ভরযোগ্য খাবার। কালে কালে সন্ধায় টিউশানি ফেরত বালক বালিকার (বালিকাই বেশি) ভরসা হলো ফুচকা, চাট। চপের দোকানের পাশাপাশি ফুচকার শালপাতারা ভিড় বাড়াল। তারপর কয়েক বছরে বাঙালির হঠাৎ প্রিয় হয়ে উঠল মোমো। ভাজাভুজির ঝামেলা নেই, খেতেও ভালো, স্বাস্থ্যকর। পাহাড়প্রেমী মানুষরা প্রবল গরম সমতলে বসে মোমো খেয়ে দার্জিলিং-দার্জিলিং সুখানুভূতি পেতে চাইলেন। পাহাড়ের এই খাবার কীভাবে নেমে এল সমতলে? কেনই বা আমজনতার সন্ধাকালীন পছন্দের খাবারে চপ মুড়িকে সাইড করে জাঁকিয়ে বসল মোমো? মোমোর সঙ্গে জুড়ে আছে ৬০০ বছরের ঐতিহ্য, ভালবাসা এবং আবেগ।
নেপালে মোমোর জন্ম। মোমোর ইতিহাস খুঁড়তে গেলে যেতে হবে চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে। একেবারে প্রথমে মোমো ছিল কাঠমান্ডু উপত্যকার খাবার। পরবর্তীতে তিব্বত, চিন, কোরিয়া এবং জাপান পর্যন্ত এই মোমো ছড়িয়ে পড়ে। তবে অনেকে বলেন, মোমোর শিকড় নেপাল, তিব্বত এবং ভুটানে। মোমো খাবারটি চিনাদের বাওজি এবং জিয়াওজের মতোই। দুই-ই ডাম্পলিং, মূলত শুয়োরের মাংস, গরুর মাংস, চিংড়ি, শাকসবজি বা তোফুর পুরভরা এই খাবার চিনা খাদ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। খাদ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, মোমো হচ্ছে তিব্বতি শব্দ 'মগ মগ'-এর কথ্য রূপ। হতেও পারে এই তিব্বতি শব্দটি চিনা শব্দ মোমো থেকেই আসলে ধার করা। উত্তর-পশ্চিম চিনা উপভাষায় গমের সেদ্ধ রুটিকে বলা হয় মোমো।
আরও পড়ুন- ঔরঙ্গজেবের প্রিয় পদ, কী ভাবে এত জনপ্রিয় হল তড়কা?
সে যাই হোক, নেপালকে মোমোর কৃতিত্ব দিতেও তেমন বাধা নেই। মোমোর এই দেশভ্রমণের নেপথ্যে ছিলেন এক নেপালি রাজকুমারী। পনেরো শতকের শেষ দিকে তিব্বতের একজন রাজার সঙ্গে বিবাহ হয় তাঁর। বিয়ের সূত্রেই তিব্বতে গেল এই পদ। অবশ্য নেপালি নেওয়ার ব্যবসায়ীরাও ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রচুর পরিমাণে তিব্বতে যেতেন। ভ্রমণকালে খাদ্য ও স্বাদের বিনিময় ঘটবে এও স্বাভাবিক। নেপালের প্রাচীনতম ভাষাগুলির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নেওয়ারি। এই ভাষাতে 'মোম' মানে বাষ্পে রান্না করা। মোমো মাউন্ট এভারেস্টের মতোই নেপালের অন্যতম প্রতীক। নেপালের সীমা ছাড়িয়ে মোমোর জনপ্রিয়তা এখন বিশ্বব্যাপী।
কীভাবে ভারতে এল মোমো?
মনে করা হয়, ভারতে মোমো এসেছে এই বছর ষাট আগে। ১৯৫৯ সালের তিব্বতি বিদ্রোহের পর বিপুল সংখ্যক তিব্বতি মানুষ ভারতে চলে আসেন। ১৯৬০-এর দশকে ভারতে এই বিপুল সংখ্যক তিব্বতির প্রবেশের সঙ্গেই আগমন ঘটে মোমো রেসিপির। লাদাখ, দার্জিলিং, ধর্মশালা, সিকিম এবং দিল্লি সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বসতি স্থাপন করেন এই তিব্বতিরা। উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে, এই দার্জিলিং, সিকিম, লাদাখই কিন্তু ভারতে মোমোর জনপ্রিয়তম আদি স্থান। আরেকটি তত্ত্ব বলছে, কাঠমান্ডুর নেওয়ার বণিকরাই রেশম পথে ভ্রমণের সময় তিব্বত থেকে ভারতে এই পদ নিয়ে আসেন।
আরও পড়ুন- রাবীন্দ্রিক ডায়েট || স্ত্রী ছাড়া কারও হাতের জিলিপি খেতেন না রবীন্দ্রনাথ
আদি মোমোর সঙ্গে ইদানীংকালের মোমোর ফারাক রয়েছে অবশ্য। এখন মোমো হচ্ছে এক ধরনের দক্ষিণ এশিয় ডাম্পলিং। মোমো মূলত সবজি বা মাংসের পুর ভরা ময়দার গোলা। সেদ্ধ বা বাষ্পে রান্না করা হলেও কালে কালে ফ্রায়েড মোমো জনপ্রিয় হয়েছে। মোমো স্টিমার মানে যে পাত্রে রেখে মোমোটি সেদ্ধ করা হয়, তাকে বলা হয় মুকটু। মুকটু হচ্ছে একধরনের ধাতব পাত্র যার তলায় অজস্র ছিদ্র থাকে। অনেক জায়গায় বাঁশের স্টিমারও ব্যবহার করা হয়। তবে সবজির পুর দেওয়া হল মূলত মোমো কিন্তু মাংস দিয়েই তৈরি হতো। আরও বিশেষভাবে বলতে গেলে মোষ এবং ইয়াকের মাংস, কারণ নেপাল ও তিব্বতের হিমালয় অঞ্চলে সবজির প্রচুর অভাব ছিল। কিন্তু যখন এই পদ নেপালের সীমা ছাড়িয়ে ভারতে এল, তখন নিরামিষের স্বাদ জুড়ল এই খাবারে। আসলে মোমো কিন্তু স্ট্রিট ফুড নয়। পাহাড়ে প্রায় প্রতি বাড়িতে তৈরি করা হয় মোমো। নেপাল, তিব্বত, ভুটান, সিকিম, অসম এবং উত্তরবঙ্গে মোমো এক ঐতিহ্যবাহী খাবার।