ভারত ভাগই পাল্টে দিয়েছিল মিষ্টির পরিচয়! ক্ষীরভোগ কীভাবে হয়ে উঠল বিখ্যাত রসমালাই?

Rasamalai of Comilla: পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালিরা ক্ষীরভোগের রসে মজলেন। ঘন মালাইদার এই মিষ্টির নাম তাদের মুখে হলো রসমালাই।

S

ছোট্ট শহরের ব্যস্ত রাস্তায় দীর্ঘ এক লাইন। ঘেমে নেয়ে অপেক্ষার পর মামুলি একটা মিষ্টির দোকান থেকে পাওয়া গেল একটা প্লেটে খানকয়েক ছানার গুলি যারা সাঁতার কাটছে ঘন রঙের দুধ-ক্ষীরের পুকুরে। এতক্ষণ দাঁড়ানোর পর পা টনটন, মাথা বনবন করলেও বসার কোনও জায়গা নেই মানে জায়গা রাখা সম্ভবই না। যেমন সম্ভব হয়নি দোকান শুরুর সময়ের লুচি, ডাল, শিঙাড়ার মতো জলখাবারের ব্যবস্থা রাখা। দোকানের নাম মাতৃভাণ্ডার, সাকিন মনোহরপুর, কান্দিরপার, কুমিল্লা। দীর্ঘ অপেক্ষার লক্ষ্য রসমালাই।

ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল। আজগুবি ঠেকলেও ব্যাপারটা সত্যি। ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ, হয়ে গেল পাকিস্তান। ছিল ক্ষীরভোগ, দেশভাগের পরে হয়ে গেল রসমালাই। বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূবের জেলা কুমিল্লার কিংবদন্তি তুল্য মিষ্টি রসমালাইয়ের ঠিকুজিকুষ্ঠি ঘাঁটতে গিয়ে এমন তথ্যই মেলে। ১৯৩০ সাল থেকে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার ফণী সেন ও মণি সেন দুই ভাই গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে ঘন করে তাতে শুধু চিনি মিশিয়ে যে পাতলা ক্ষীর তৈরি করতেন, তার মধ্যে ছোট ছোট শুকনো ডিম্বাকৃতি চিনির রসে সেদ্ধ করা ছানার গোল্লা ডুবিয়ে এক মিষ্টান্ন তৈরি করেন। তারা নতুন এই পদটির নাম দিলেন ক্ষীরভোগ। ব্রিটিশ শাসনামলে এই মিষ্টি ক্রমে জনপ্রিয় হতে শুরু করে। খাঁটি দুধ ঢিমে আঁচে ঘন করে তৈরি করা অনন্য স্বাদের এই মিষ্টির বিশেষত্ব হলো তার স্বাদের পরিমিতি। অল্প মিষ্টি ছানার গোল্লা হাল্কা ঘিয়ে-গোলাপি রঙা ক্ষীরের দ্রবণে ডুবে থাকা এই দেবভোগ্য মিষ্টি স্বাদকোরকের তন্ত্রীতে স্পর্শ করলে আবেশে চোখ বুজে আসে, আবেগে -আস্বাদে জিভ জড়িয়ে যায়। সততা ও ব্যবসায়িক বুদ্ধির যথোপযুক্ত প্রয়োগে এই দুই ভাই সেই সময়ের রাজা-গজা, সাহেব-সুবো, নবাব-নায়েব, সেপাই-সান্ত্রী, মন্ত্রী-যন্ত্রী সবার মন জয় করে নিলেন। অবশেষে ওয়াপদার সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে ফণীন্দ্র সেন ব্যবসায় নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেন। ১৯৩০ সালে মিষ্টির পসরা নিয়ে কুমিল্লা শহরের কান্দিরপার অঞ্চলে মনোহরপুরে তারা উঠে আসেন। শহরের বিখ্যাত রাজ-রাজেশ্বরী কালীমন্দিরের বিপরীতে ছোট একটি দোকান খোলেন। শহরের মানচিত্রে যুক্ত হয় নতুন নাম 'মাতৃভাণ্ডার'। শুধু মাতৃভাণ্ডার নয় ক্রমে এর আশেপাশে যোগ হয় ভগবতী প্যারা ভাণ্ডার, শীতল ভাণ্ডার যারা কিংবদন্তি তুল্য না হলেও রসমালাইয়ের ঐতিহ্যের অংশীদার।

আরও পড়ুন- ভুল থেকেই জন্ম জনপ্রিয় মিষ্টির! যে রহস্য লুকিয়ে আছে গুলাব জামুনের নেপথ্যে

ত্রিপুরা রাজ্যের একদা প্রধান শহর কুমিল্লা মধ্যযুগ থেকেই পর্যটকদের আনাগোনা, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-সংস্কৃতির পীঠস্থান। চিনা পরিব্রাজক ওয়াং চুয়াংয়ের মতে, কুমিল্লার আদি নাম কিয়া-মল-ঙ্কিয়া যা ক্রমান্বয়ে পরিবর্তিত হয়ে কমলাঙ্ক এবং আঞ্চলিক অপভ্রংশ রূপে কুমিল্লা যার অর্থ পদ্মফুলের দিঘি। প্রাচীন সমতট অঞ্চলের অধীনে এই শহর একসময় 'City of banks and tanks ' নামে প্রচলিত ছিল। ট্যাঙ্কে ফোটা পদ্মফুল থেকে কমলাঙ্ক দিঘি এল কিন্তু ব্যাঙ্ক কেন? বা এর সঙ্গে রসমালাইয়ের কী সম্পর্ক তা বুঝতে হলে একটু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকাতে হবে।

১৯০৫ এর বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব ১৯০৬-তে লাগু হয়ে যাওয়ার ফলে কুমিল্লা শহর ব্যবসা বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিনিয়োগের প্রয়োজনে মূলধন জোগান দিতে প্রথম ১৯১৪ সালে নরেশচন্দ্র দত্ত 'দি কুমিল্লা ব্যাঙ্কিং কর্পোরেশন' নামে ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। দিল্লি, কানপুর, কলকাতা, মুম্বইসহ সুদূর লন্ডনেও এর শাখা বিস্তৃত হয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর আরও তিনটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে যুক্ত হয়ে এই ব্যাঙ্কটি ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ায় রূপান্তরিত হয়। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই ব্যাঙ্ক থেকে কয়েক পা দূরেই মনোহরপুরে গড়ে ওঠা মিষ্টির দোকানের জনপ্রিয়তা তথা ব্যবসার প্রসার ব্যাঙ্কে আসা গ্রাহক, কর্মচারিদের সূত্রে ছড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গেই ত্রিপুরার রাজবংশের প্রতিষ্ঠিত রাজরাজেশ্বরী মন্দিরে পুজো দিতে আসা পুণ্যার্থীদের কাছেও মিষ্টি প্রায় অপরিহার্য হয়ে ওঠে।

ফণীন্দ্রনাথ সেন ও মণীন্দ্রনাথ সেনের আদি বাড়ি ছিল ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায় খড়িয়ালা গ্রামে। ছানা আর চিনির কম্বিনেশনের নানা রকম শুকনো আর রসের মিষ্টি তৈরিতে তাঁরা ছিলেন কৃতবিদ্য। ঢিমে আঁচে জ্বাল দেয়া দুধের হাল্কা বাদামি হয়ে আসা ক্ষীরে ছানা দিয়ে তৈরি খুদে রসগোল্লা বা 'ভোগ' যোগ করে তারা পরীক্ষামূলক ক্ষীরভোগ তৈরি করলেন। স্বাদে, গন্ধে মনমাতানো এই মিষ্টির যথার্থ সমঝদার পেতে তাঁরা কুমিল্লা শহরে এসে কালীবাড়ির উল্টোদিকে চা, জলখাবার, মিষ্টির দোকান দিলেন। ততদিনে কুমিল্লার গুরুত্ব বেড়েছে অনেকটাই। শহরে পা রেখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, কাজী নজরুল ইসলাম। ১৯২০ সালে গান্ধীজির কুটিরশিল্পকে কেন্দ্র করে গ্রামভিত্তিক অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতার আদর্শে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে অভয় আশ্রম। ১৯১৪ সালে দানবীর মহেশ ভট্টাচার্য স্থাপন করেছেন রামমালা গ্রন্থাগার, ঈশ্বর পাঠশালা। শচীন দেব বর্মন, হিমাংশু দত্তের শহর কুমিল্লায় ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নাট্যমঞ্চ 'টাউন হল'। এছাড়া ছিল ভিক্টোরিয়া কলেজ, ১৭৭৩ সালের নবাব ফয়জুন্নেছা বালিকা বিদ্যালয়। সব মিলে জমজমাট আয়োজন।

প্রায় শতাব্দী অতিক্রান্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান মাতৃভাণ্ডারের জনপ্রিয়তা বোঝার জন্য ঢাকা থেকে কুমিল্লা যাওয়ার সড়কপথটিই যথেষ্ট। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চান্দিনা থেকে কুমিল্লা পেরিয়ে দাউদকান্দি পর্যন্ত ৬০কিমি পথের ধারের খাবারের দোকানের সঙ্গে জুড়ে আছে এক ফালি করে মাতৃভাণ্ডার।তাদের সংখ্যা সত্তরের বেশি, নামের আগে আদি, খাঁটি নিউ, মেসার্স, অরিজিনাল ইত্যাদির ছড়াছড়ি। কুমিল্লা শহরের সীমানা জুড়ে মূল রাস্তার ধারে এসব দোকানের সঙ্গে মূল দোকানের যে কোনও সংযোগ নেই তা এসব দোকানের ব্যবসায়ীরা অস্বীকার করেন না। মাতৃভাণ্ডারের বর্তমান কর্ণধার অনির্বাণ সেনগুপ্ত একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন এদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ থাকলেও কারও রুটিরুজি বন্ধ করতে তিনি চান না বলেই তা নেবেন না।

আরও পড়ুন- গাড়ি থামিয়ে মিষ্টি কিনতেন উত্তম কুমার, কী ভাবে বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠল জনাইয়ের মনোহরা?

টিনের চালের সাবেকি দোকানঘর। কাকভোরে এসেছে ১৪-১৫ মণ গরুর দুধ। লাগোয়া কারখানায় কাঠের জ্বালে ঢাউস লোহার কড়াইতে দুধ জ্বাল চলছে।মেঝেতে বসে ছানা থেকে গুলি কেটে বারকোশে রাখছেন কয়েকজন। পাতলা চিনির রসে 'ভোগ' বা ওই ছানার গুলি দাঁড়িয়ে থেকে দায়িত্ব নিয়ে ফুটোচ্ছেন কয়েকজন। এমন ছবি দেখতে হলে বা রসমালাই কিনতে হলে ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়াতে হবে। মাথাপিছু সর্বাধিক ৩ কেজি রসমালাই বিক্রি হয়। ভোর সাতটায় বন্ধ দোকানের সামনেও লাইনের ছবি বর্তমান কুমিল্লাবাসীর খুব চেনা। এক মণ দুধ জ্বাল দিয়ে ১৪কেজি রসমালাই তৈরি হবে। এই আন্দাজের সঙ্গে মেশে শুধুমাত্র চিনি। সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয় ছানার 'ভোগ'। এই একই ঘরানার রসমালাই পাওয়া যায় কুমিল্লা শহরের জলযোগ, ভগবতী প্যাঁড়া ভাণ্ডার, শীতল ভাণ্ডার সহ আরও কিছু দোকানে।

ফণী সেন ও মণি সেনের ক্ষীরভোগ কীভাবে রসমালাই হলো তা বলেছিলেন তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম, বর্তমান কর্ণধারের বাবা প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা শঙ্কর সেন।১৯৪০ সালে ফণীন্দ্র সেনের মৃত্যুর পর তিনিই ব্যবসার হাল ধরেন। ১৯৪৭ এর দেশভাগের পর রাতারাতি পাকিস্তান হয়ে যাওয়া দেশে সামরিক, ব্যবসায়িক ও সরকারি দপ্তরের কাজে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি অবাঙালিদের আনাগোনা শুরু হলো। তারা ক্ষীরভোগের রসে মজলেন। ঘন মালাইদার এই মিষ্টির নাম তাদের মুখে হলো রসমালাই। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ এর ইতিহাসের যাত্রাপথে অনেক কিছুর পালাবদল হলেও রসমালাইয়ের গুণমান অটুট রইল। আজও তাদের ব্যবসার মূলনীতি গুণমানে আপোস না করার কারণে গ্রাহক সন্তুষ্টি। রসমালাই বিদেশে পৌঁছে গেছে অনেকদিন আগে। বাংলাদেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতেরা রসমালাইয়ের গুণগ্রাহী। রসের মিষ্টির বিপণনে সংরক্ষণের সমস্যা গুরুত্বপূর্ণ। তাই কলকাতায় বসে আসল জিনিসের স্বাদ পাওয়া একটু মুশকিল। সারাদিন খদ্দেরদের চাহিদা সামলাতে হিমশিম খান দোকানের ম্যানেজার ও কর্মচারিরা। তাই ব্যবসার সম্প্রসারণের কোনও পরিকল্পনা আপাতত তাদের নেই। সাধারণভাবে ৩০ঘণ্টা এই মিষ্টি ফ্রিজ ছাড়াও ভালো থাকে। কুমিল্লা জেলার বাটিক, খাদির দেশজোড়া খ্যাতির পাশে স্বমহিমায় বিরাজমান এই রসমালাই। গুগল ঘেঁটে রসমালাইয়ের প্রস্তুতকারী হিসেবে কলকাতার কৃষ্ণচন্দ্র দাসের নাম পাওয়া যায়। বলাবাহুল্য কলকাতায় তৈরি রসমালাইয়ের সঙ্গে কুমিল্লার ঘরানার বিস্তর ফারাক। আর কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গেও ফণী সেন ও মণি সেনের সম্ভবত কোনও যোগসূত্র নেই।

 

More Articles