বিদেশি পদ দিয়েই শুরু হয় সাবেকি বাঙালি থালি! শুক্তোর যে ইতিহাস চমকে দেবে আপনাকেও!

Famous bengali food Shukto : অবিশ্বাস্য লাগবে শুনলে, জন্মসূত্রে আদৌ বাঙালি নয় শুক্তো, জানুন ইতিহাস...

বাঙালি মানেই খাদ্যরসিক। খাবারের সঙ্গে অলিখিত একটা সম্পর্ক যেন সেই কবে থেকেই তৈরি হয়ে গিয়েছে এই জাতির। নিমন্ত্রণ বাড়ি সাজানো মেনু অথবা রেস্তোরাঁর নামজাদা পদ তো আছেই, সেই সঙ্গে রয়েছে বাঙালির নিজস্ব হেঁশেলের নানান সব স্বাদের বাহারি রান্নাও। মাছে ভাতে বাঙালির শেষ পাতে যেমন মিষ্টি মুখ না হলে চলে না তেমনি শুরু সময় অল্প একটু তিক্ত স্বাদের সঙ্গেও বেশ জোরালো সম্পর্ক রয়েছে। ভাত, ডাল, তরকারি, মাছ, মাংস, চাটনি, দই, মিষ্টি ইত্যাদি খাবারে সাজানো লম্বা থালির শুরুটা হয় যে পদ দিয়ে তার নাম হল শুক্তো।

ছাদে হালকা তেতো হলেও অসাধারণ সুস্বাদু পদ হল শুক্তো। বাজারের বিভিন্ন সবজি যেমন আলু, বেগুন, শিম, বরবটি, ডাটা, পেঁপে, সবই পরে এই রান্নায় আর তার সঙ্গে পরে উচ্ছে অথবা করলা, গ্রাম বাংলার দিকে আজও শিউলি পাতার শুক্তো খাওয়ার জল রয়েছে। আসুন বিষয় হল খানিকটা তেতো স্বাদ থাকতেই হবে এই পদে। কিন্তু বাঙালি তথা ভারতীয়দের সঙ্গে জোরালো সম্পর্ক থাকলেও জানেন কি এই পদ আসলে মোটেই এদেশীয় নয়। আসুন জেনে নেওয়া যাক সাবেকি শুক্তোর ইতিহাস।

আরও পড়ুন - অবৈধই ছিল প্রথমে, অথচ দামও আকাশছোঁয়া! কীভাবে বাঙালির হেঁশেলে জাঁকিয়ে বসলো ‘পোস্ত’?

পদ্মপুরাণে বেহুলার বিয়ের নিরামিষ খাবারের মধ্যে উল্লেখ পাওয়া যায় শুক্তোর। ভারতচন্দ্রের লেখা অন্নদামঙ্গল কাব্য ২২ রকমের নিরামিষ পদের মধ্যে পাওয়া গিয়েছিল সর্বাগ্রে। শুধু তাই নয় মঙ্গলকাব্য এবং বৈষ্ণব সাহিত্যেও এই রান্নাটির বহু জায়গায় উল্লেখ মেলে কিন্তু আজকের দিনে সুপ্ত বলতে যেমন উচ্ছে, করলা, পলতা, নিম, শিউলি পাতা ইত্যাদি কোন একটার ব্যবহারে তিক্ত ব্যঞ্জন তৈরি করা হয়, প্রাচীনকালে তা ছিল না। সে সময় এই পদকে বলা হত তিতো। বেগুন, কুমড়ো, কাঁচকলা, মোচা ইত্যাদি বিভিন্ন সবজি গুঁড়ো অথবা বাটা মশলায় মাখিয়ে বেসনে চুবিয়ে ভেজে এই রান্না করা হতো। পরে হিং, জিরা অথবা মেথি দিয়ে ভালো করে সাতলিয়ে নামানো হতো। কিন্তু চৈতন্যচরিতামৃতে শুকুতা বা শুকতা বলতে এক ধরনের শুকনো পাতাকে বোঝানো হতো, এটি ছিল অম্ল নাশক এক ধরনের পদ। সম্ভবত শুকনো তেতো পাট পাতাকে বোঝানো হতো। শুধু তাই নয়, পুরাণ মতে, রাঘব পন্ডিত মহাপ্রভুর জন্য নীলাচলে যেসব জিনিস নিয়ে গিয়েছিলেন তার মধ্যেও এই পদটি ছিল উল্লেখযোগ্য।

প্রাচীন ভারতীয় রান্নার ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, কেরালাবাসীর হাত ধরে শুক্তো ছড়িয়ে পরে ভারতে। কিন্তু ভারতে রান্নার প্রচলন হওয়ার অনেক আগেই পর্তুগিজদের মধ্যে চল ছিল এই পদের। প্রাচীন কালে পর্তুগিজদের একচেটিয়া খাবার ছিল সুক্তো। শুক্তো যে যে সব উপকরন দিয়ে তৈরী হয় সেগুলি স্বাস্থ্যের পক্ষ্যে উপকারী। তিক্ত রসে রুচী বাড়ে। পলতা, নালতে, উচ্ছে, করলা, কচি নিম পাতা ইত্যাদি শুক্তোর তিক্ত রসের জন্যে ব্যবহার করা হয়। পর্তুগিজরা বাংলায় আলুর ব্যবহার চালু করবার পর থেকে এটি শুক্তোর একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে অবশ্য এই রান্নাতেও লাগে বেশ কিছু আধুনিক ঘরানার প্রভাব। সেই সঙ্গে বদলে যায় সাবেকি রান্নার ধরনও। আজকাল শুক্তো রান্নাতে দুধ এবং পোস্ত ব্যবহার করেন অনেকেই। এতে অবশ্য স্বাদও বেড়ে যায় অনেকটা। তাই যতই বাঙালির হেঁশেলে আজ আধুনিকতার ছোঁয়া লাগুক, যতোই পিজ্জা পাস্তা অথবা বাহারি রান্না এসে খাবা বসা তবুও সাবেকি শুক্তোর স্বাদ আজও রয়ে গেছে অটুট।

More Articles