গাড়ি থামিয়ে মিষ্টি কিনতেন উত্তম কুমার, কী ভাবে বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠল জনাইয়ের মনোহরা?

Bengals Famous Monohora at Janai : বাংলার মিষ্টি হিসেবে আজও ঐতিহ্যবাহী জনাইয়ের মনোহরা, বিশেষ কারণেই তৈরি হয়েছিল এই মিষ্টি

মনোহরা, নামের মধ্যেই কেমন যেন একটা লুকানো মন হরণের অভিসন্ধি! অবশ্য এ মিষ্টি চেখে দেখলেই অবশ্য বোঝা যায় এই নামকরণের আসল রহস্যটা লুকিয়ে ওই স্বাদেই। সেকালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক মোহিতলাল মজুমদার প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বলতেন, “তোরা মিষ্টির নাম রাখিস প্রাণহরা, আর আমরা নাম রাখি মনোহরা।” ঢাকার মিষ্টি প্রাণ হরণ করলে, বাংলার মিষ্টি মন হরণ করবে নাই বা কেন! সত্যিই তাই, ঢাকার প্রাণহরা চাইতে কোনও অংশে কম যায় না বাংলার মনোহরা। আজকাল অবশ্য বাংলার প্রায় প্রতিটি জেলার ছোট বড় মিষ্টির দোকানেই মিলে গোলাকার এই সুস্বাদু মিষ্টি তবে এ মিষ্টির শুরুটা হয়েছিল হুগলির জনাইয়ে। আজও জনাইয়ের মনোহরা এই নামটুকুই কাফি। স্বাদ এবং ঐতিহ্য এতগুলো বিচির পের7টে এসেও রিয়ে গিয়েছে অটুট।

মিষ্টির সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক সেই আদ্যিকালের। আজ অবশ্য ব্লাড সুগারের ভ্রুকুটি তাতে খানিক বাঁধ সাধে, তবে বাঙালির মিষ্টির প্রতি ভালোবাসা টলে না একরত্তি। বাঙালির এই মিষ্টি প্রেমের ইতিহাসটা অনেক লম্বা, ঘরে তৈরি নারকেল নাড়ু কিংবা গুড় চাকতি থেকে শুরু করে আজকের দিনের নানা রকম বাহারি মিষ্টি, সবকিছুতেই রয়েছে এক রসনা তৃপ্তি এবং মননের সন্তুষ্টির ইতিহাস। কথায় বলে ‘মাছে ভাতে বাঙালি’, কিন্তু শেষ পাতে একটু মিষ্টিমুখ না হলে বাঙালির পেট পুজো ঠিক জমে না। মিষ্টি নাকি শুভ তাই, শুরুর আপ্যায়নে মিষ্টিমুখই ভরসা জোগায়।

আরও পড়ুন - ভুল থেকেই জন্ম জনপ্রিয় মিষ্টির! যে রহস্য লুকিয়ে আছে গুলাব জামুনের নেপথ্যে

আজকের আধুনিক মিষ্টির যুগে মূল উপকরণ হল ছানা। কিন্তু প্রথম দিকে ছানা ও ছানার তৈরি মিষ্টি একরকম পরিত্যাজ্যই ছিল ধর্মীয় কারণে। পরবর্তীকালে ষোড়শ শতকে পর্তুগিজদের হাত ধরে বাঙালির পাতে পাকাপাকিভাবে আসন গ্রহণ করে ছানা। শোনা যায়, পশ্চিমবঙ্গের ব্যান্ডেল অঞ্চলে পর্তুগিজরা তাদের খাঁটি গড়ে তোলার পর শুরু হয় ছানার যাত্রা। ফলে সঙ্গত কারণেই নীহাররঞ্জন রায় তার ‘বাঙালির ইতিহাস’ বইয়ে বাঙালির মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের যে বিবরণ দিয়েছেন তাতে ছানার উল্লেখ নেই, কিন্তু বাঙালির মিষ্টির ইতিহাসের সেই ছক ভাঙছে প্রখ্যাত সাহিত্যিক নারায়ণ সান্যাল -এর ‘রূপমঞ্জুরী’ উপন্যাসে ছানার মিষ্টির প্রচলন এর উল্লেখে।

এন্টনি ফিরিঙ্গির সেই বিখ্যাত ভোলা ময়রা থেকে শুরু করে একালের পরিচিত নবীনচন্দ্র দাস, যুগে যুগে এঁদের হাতের জাদুতেই বাঙালির আবেগের অপর নাম হয়ে উঠেছে মিষ্টি। ঘরোয়া কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানের ক্লাইম্যাক্স যে মিষ্টি, তার লম্বা জার্নিতে বাংলার নানা জেলা নিজেদের মতো করে রসদ জুগিয়ে এসেছে। হুগলির জনাইও তাই ব্যতিক্রম কিছু নয়।

জনাইয়ের এই বিখ্যাত মনোহরার ইতিহাস আজকের নয়, আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে প্রথম তৈরি হয়েছিল এই মিষ্টি। শোনা যায়, কলকাতার বিখ্যাত ময়রা ভীম চন্দ্র নাগ নাকি একসময় জনাই এর ময়রা পাড়ায় বসবাস করতেন পরবর্তীকালে তার বংশধরদের হাত ধরেই হুগলির মাটিতে বিখ্যাত এই মিষ্টি তৈরীর চল শুরু হয় বলে দাবি স্থানীয়দের অনেকেরই। তবে এত বছরের পুরনো একটা মিষ্টিকে ঘিরে যে কেবল একটা গল্পই যে চিরায়িত থাকবে তাই নয়, সময়ের স্রোতে তার সঙ্গে আরও অনেক কথোকতা এসে জুড়েছে। যদিও এই উৎপত্তির ইতিহাসের তফাৎ স্বাদে বিশেষ দখলদারি ফলাতে পারে না। আজও জনাইয়ের মনোহারা খাবার জন্য বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে যান অনেকেই এমনকী ওখানকার ময়রা পরিবারের অনেকেই মনোহরা তৈরি করে কলকাতার সহ পার্শ্ববর্তী অনেক জেলায় বিক্রি করতে আসেন। শুধু তাই নয়, বর্তমানে বিদেশেও রপ্তানি করা হয় জানাই-এর বিখ্যাত মনোহরা।

আরও পড়ুন - ঘুমের বড়ি নয়, মিষ্টি খেয়েই ঘুমাতে যান কালীঘাটের কালী, জানেন কী নাম এই মিষ্টির?

শোনা যায়, এমন একটা সময় ছিল, যখন ছবি বিশ্বাস, উত্তমকুমারকিংবা ছায়াদেবীর মতো বাংলা চলচ্চিত্রের তাবড় তাবড় নায়ক-নায়িকারা আউটডোর শুট করে কলকাতা ফেরার পথে প্রায়ই গাড়ি থামাতেন জনাইয়ের দোকানে। মনোহরা কিনে নিয়ে তবেই ফিরতেন বাড়ি। শুনলে অবাক হবেন , জানেন স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ও নাকি খুব ভালোবাসতেন এখনকার মনোহরা খেতে! মনোহরার প্রেমে তিনি বারবার ছুটে এসেছেন জনাইতে।

বাংলার অন্যান্য প্রান্তের মিষ্টির দোকানের মনোহরা সঙ্গে জনায়ের মনোহরার একটি বিশেষ পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। এক্ষেত্রে ছানার তৈরি নরম পাকের সন্দেশের ওপর শক্ত চিনি অথবা গুড়ের খোলস পরানো হয়। শীতকালে নলেন গুড়ের সময় এই গুড়ের খোলসে মোরা মনোহারা স্বাদ বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এই মিষ্টির বিশেষত্বই হল ওই চারিধারের পুরু আস্তরণটাই। ফ্রিজের বাইরে তিন-চারদিন রেখে দিলেও নষ্ট হয়ে যাওয়ার কোনও ভয় নেই। সারা বছরই এই মিষ্টির চাহিদা এখানে তুঙ্গে। চোখে দেখতে চাইলে আপনিও চলে যেতে পারেন হাওড়া বর্ধমান কর্ড লাইনের বিখ্যাত ষ্টেশন জানাই-এ। লোকাল ট্রেনে হাওড়া থেকে খুব কম সময় পৌঁছাতে পারবেন জনাই স্টেশন। স্টেশনে নেমে একটু খোঁজ করলেই একের পর এক মিষ্টির দোকান মিলবে এখানে। মিলবে ময়রা পাড়ার সন্ধানও। সেখানে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কম বেশি মনোহরা তৈরি করার চল রয়েছে আজও। যা কিনা স্বাদ এবং ইতিহাসে সমৃদ্ধ। বলাই বাহুল্য, আজ বাংলার মিষ্টির মানচিত্রে পাকাপাকি জায়গা করে নিয়েছে জনাইয়ের এই বিখ্যাত মনোহরা।

More Articles