চামড়া কুঁচকে গেলেও পচে না! মমতাকে হাসিনার দেওয়া হাঁড়িভাঙা আমের ইতিহাস অবাক করবে
Bangladesh Haribhanga Mango: ২০২১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২,৬০০ কেজি আম উপহার পাঠান।
এক দেশ অন্য দেশকে কী দেয়? সীমান্তে প্রহরা, নদীর জলের ভাগ বাঁটোয়ারা, আকাশসীমায় সতর্কতা, পর্যটন অথবা গুলিগোলা। তবে মাঝেসাঝে উপহারও আসে। পড়শি দেশ হলে, সৌহার্দ্য রক্ষায় ফল আসে। যেমন তেমন নয়, ফলের রাজা আসে সীমান্ত পেরিয়ে। একদেশের সঙ্গে অন্যদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আদানপ্রদান হবে এমনটাই স্বাভাবিক। আর যে দেশের সংস্কৃতির অন্যতম অঙ্গই খাওয়াদাওয়া সেখানে খাদ্য ও পানীয়ই যে যোগ্যতম উপহার বলাই বাহুল্য। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সম্প্রতি ৬০০ কেজি আম উপহার পাঠিয়েছেন। উপহার হিসেবে আম পাঠানোর ঘটনা তো এই প্রথম নয়। গত বছরও হাসিনা আম পাঠান, হাসিনা প্রায় প্রতিবারই আম পাঠান। কখনও মোদিকে, কখনও মমতাকে। ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা আর অসমের মুখ্যমন্ত্রীদের আম উপহার দেন শেখ হাসিনা। এছাড়াও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সব মুখ্যমন্ত্রীর কাছেই আম পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। পঞ্চায়েত নির্বাচনের আঁচ আর গ্রীষ্মকালীন তাপ- দুই দিকেই ফুটছে পশ্চিমবাংলা। এরই মাঝে এসেছে পড়শি দেশের মিঠে আম উপহার!
আসলে আম ঐতিহাসিকভাবেই এই দেশ ও অঞ্চলগুলির মধ্যে উত্তেজনাপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ককে মিষ্টিমুখ করার পথ দেখিয়েছে। রাজনৈতিক নেতারা হামেশাই আমকে উপহার হিসেবে ব্যবহার করেছেন কূটনৈতিক সদিচ্ছা এবং রাজনৈতিক হৃদ্যতা বাড়াতে। জওহরলাল নেহেরুও মাও সে তুংকে আম উপহার দিয়েছিলেন। সেই পথ ধরেই শেখ হাসিনা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উপহার হিসেবে আম পাঠিয়েছিলেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর শেখ হাসিনার সুসম্পর্ক রাজনীতির ময়দানে সকলেরই জানা। আম কেন, এই মাসখানেক পরে ইলিশের উপহারও আসবে। ইদ আর পুজোর সময় শাড়িও পাঠান মমতা।
আরও পড়ুন- শেখ হাসিনার ‘হাঁড়িভাঙা আম’ উপহার, কূটনীতি আমোদে দিল্লি-ঢাকা মাতোয়ারা
পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে ইতিমধ্যেই রাজনৈতিক হাওয়া গরম এই রাজ্যে। রাজনৈতিক বিতর্কের মুখ মিষ্টি করাতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হিমসাগর আম উপহার দিয়েছেন তাঁর রাজনৈতিক সখা এবং বিরোধীদের। আম বিনিময়ের এই ঐতিহ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে নতুন নয়। গত এক দশক ধরে এই ধরনের উপহার তিনি পাঠিয়েই থাকেন। গতবারই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং কংগ্রেস নেত্রী সনিয়া গান্ধির কাছে আম উপহার পাঠিয়েছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও দুর্গাপুজোর সময় মিষ্টি ও পাজামা পাঞ্জাবী উপহার দিয়েছেন মমতা।
দিন কয়েক আগে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্য থেকে উৎকৃষ্ট জাতের আম বড় বড় পাত্রে প্যাক করিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহ বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উপহার হিসাবে পাঠান। ফজলি, হিমসাগর, ল্যাংড়ারা বাক্সে বাক্সে ভর্তি হয়ে পৌঁছে গিয়েছে 'ভিভিআইপি'-দের কাছে।
২০২১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ২,৬০০ কেজি আম উপহার পাঠান। বাংলাদেশি ট্রাক ভরে ভরে সীমান্ত ডিঙিয়ে এসেছিল ২৬০ বাক্স ভর্তি বিখ্যাত 'হাঁড়িভাঙা' আম। খেলা হিসেবে হাঁড়িভাঙা জনপ্রিয় তো বটেই। কিন্তু আমের এমন নাম কেন? আমের বিচিত্রতর নামের নেপথ্যে এক একখানা পিলেচমকানিয়া ইতিহাস রয়েছে। ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায় যেমন হিমসাগর, ল্যাংড়া বা ফজলির রমরমা, বাংলাদেশে তেমন ফলের বাজার আলো করে থাকে হাঁড়িভাঙা। বিশ্ববিখ্যাত এই হাঁড়িভাঙা আমের জন্ম রংপুর জেলায়। সেই জেলার মিঠাপুকুর উপজেলায় হাঁড়িভাঙার ব্যাপক উৎপাদন।
আরও পড়ুন- আমও হতে পারে প্রাণঘাতী! সর্বোচ্চ আম খাওয়ার যে পরিমাণ বেঁধে দিলেন চিকিৎসকরা
আমটির নাম অবশ্য শুরুতেই হাঁড়িভাঙা ছিল না। প্রথম প্রথম মানুষ এই আম চিনত মালদিয়া নামে।শোনা যায়, নফল উদ্দিন পাইকার নামের এক ব্যক্তি নাকি মাটির হাঁড়ি দিয়ে ফিল্টার বানিয়ে এই আমের গাছে জল দিতেন। একদিন রাতে কেউ ওই মাটির হাঁড়িটি ভেঙে ফেলে। ওই গাছটিতে বিপুল পরিমাণ আম ধরত, স্বাদেও ব্যাপক সুস্বাদু। ওই আম বিক্রির জন্য বাজারে নিয়ে গেলে নফল উদ্দিন দেখেন লোকজন ওই আম সম্পর্কে জানতে চাইছেন, কিনছেন। নফল উদ্দিন বোঝেন যে গাছের হাঁড়িটি ভেঙেছে সেই গাছেরই আম এটি। সেই থেকে হাঁড়িভাঙা আম নামেই পরিচিতি পায় এই আম। মাত্র একটি গাছ থেকে শয়ে শয়ে কলমের চারা তৈরি করা হয়। রংপুরের সেই মূল গাছটি এখন বৃদ্ধ, বয়স ৬০ পেরিয়েছে বহুকাল হলো।
হাঁড়িভাঙা আম স্বাদে গন্ধে অতুলনীয়। চারা রোপনের পরের বছরেই মুকুল ধরে যায়, ফলে ব্যবসায়ীদের কাছেও এই আম চাষ লাভজনক। আকারের তুলনায় হাঁড়িভাঙা আম ওজনে বেশি, গড়ে ৩টি আমে ১ কেজি হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে এক একটি আমের ওজন ৫০০/৭০০ গ্রামও হয়ে থাকে। এই আমে জেনেটিক পরিবর্তন করার কারণে আমের চামড়া কুঁচকে গেলেও আম পচে না।
রংপুরে এই আম প্রতি হেক্টর জমিতে পাওয়া যায় ১৬ মেট্রিক টনের মতো। ব্যাপকভাবে যার অধিকাংশই রপ্তানি হয়ে যায় অন্য দেশে। হাঁড়িভাঙা আম রপ্তানি হয় ভারত, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়াতে। যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইতালি, সৌদি আরব, কুয়েত, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এবং ওমানেও যায় বাংলাদেশের হাঁড়িভাঙা।