রাজ‍্যের সঙ্গে বন্ধুত্বের পথে নতুন রাজ‍্যপাল? ধনখড়ের থেকে কতটা আলাদা সিভি আনন্দ বোস

CV Ananda Bose: প্রথম থেকেই সহিষ্ণু ছবি তৈরি করতে চাইছেন সিভি আনন্দ বোস, এমনও বলছেন কেউ কেউ।

এই তো সেদিন! বাংলার একাধিক উত্তাপের মধ্যেই যজ্ঞ চলত রাজভবনেও। বঙ্গের সাংবিধানিক প্রধানের বাসভবনে লেগে থাকত সংবাদমাধ্যমের আনাগোনা। আর টুইট-বোমার বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকতেন প্রায় সকলেই। যদি একটু 'খবর' পাওয়া যায়! ব্রেকিং নিউজ! অথবা গরম-গরম কিছু।

সেসব এখন অতীত। তিনি এখন দিল্লিতে। 'প্রোমোশন' নিয়ে রাজ্যপাল থেকে হয়ে গিয়েছেন দেশের দ্বিতীয় নাগরিক। জগদীপ ধনখড় হয়েছেন দেশের উপরাষ্ট্রপতি। তারপর? বঙ্গ তিনি ছেড়েছেন ঠিকই, কিন্তু বঙ্গ কি তাঁকে ছেড়েছে? বিশেষত, এই রাজ্যের রাজনৈতিক উত্তাপের মধ্যেও তিনিই রয়েছেন প্রাসঙ্গিক হয়ে। উত্তরসূরির আনাগোনা আর চলমানতার মধ্যেই আলোচনায় উঠে এসেছেন তিনিই। রাজ্যের বর্তমান রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোসের (C V Ananda Bose) নয়া কর্মপথেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন জগদীপ ধনখড় (Jagdeep Dhankhar)।

লা গণেশন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) চেন্নাই-যাত্রা এবং প্রশংসা ছাড়িয়ে ফের সিভি আনন্দ বোসকে কেন্দ্র করেও উঠেছে; কে ভাল, কে কেমন- এই বিতর্ক! কী ছিল আর কী হলো, এই প্রশ্নের আবহেই ব্যতিব্যস্ত হয়েছে বঙ্গের রাজ্যপাল-রাজনীতির আঙিনাও।

আরও পড়ুন: জেলবন্দি, অসহায় পার্থর ভাগ‍্যের চাকা ঘুরছে কোনদিকে

আর এখানেই সাড়া জাগাচ্ছে ধনখড় এবং সিভি আনন্দের তুলনা। কে কার থেকে ঠিক কতটা আলাদা, এই প্রশ্নের বিশ্লেষণই কাঁপাচ্ছে বঙ্গের রাজনীতিও। কেন?

'মমতা স্তুতি'-তে সিভি আনন্দ
১ ডিসেম্বর কলকাতার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, অর্থাৎ এনআরএস প্রতিষ্ঠার ১৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের বর্তমান রাজ্যপাল। শপথের পর এটাই তাঁর প্রথম কোনও প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি বলেন, "বাংলা দেশকে নেতৃত্ব দেবে। আর ভারত গোটা বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে।'' এর সঙ্গেই বাংলার ভূয়সী প্রশংসা করেন সিভি আনন্দ বোস। প্রাক্তন আইএএস আধিকারিক আরও বলেন, "ভারতকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের। বাংলা দৈত্যের মতো গর্জন করছে।'' এই রাজ্য দেশকে আর ভারত বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে বলেও মন্তব্য করেন বোস। রাজ্যপাল যখন এই বক্তব্য রাখছেন, ঠিক তাঁর সঙ্গে একই মঞ্চে উপস্থিত রয়েছেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ শান্তনু সেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি এই মন্তব্যের সমর্থন করেন।

যদিও কয়েকদিন আগেই রাজভবনে রাজ্যপালের শপথ অনুষ্ঠান ঘিরেও তৈরি হয়েছিল চরম বিতর্ক। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রথম সারিতে আসন পাননি, এই অভিযোগে রাজভবনে সেদিন যাননি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়নি, বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারেরও। এরপর থেকেই ক্রমশ বাড়তে থাকে জল্পনা। তাহলে কি নয়া কোনও কৌশল অথবা পথেই এগোতে চাইছেন সিভি আনন্দ বোস? সঙ্গে পাল্টা চাপ বাড়বে বিজেপি-র তরফেও?

আনন্দ-অসন্তোষ
অস্থায়ী রাজ্যপাল হিসেবে লা গণেশনের পরে সিভি আনন্দ বোসের নিযুক্তির পর থেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করে বিজেপি। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জগদীপ ধনখড়ের প্রসঙ্গ টেনে এনে বারবার নিজেদের মতামত ব্যক্ত করেছেন বঙ্গের বিজেপি নেতারা। অমিত শাহের মন্ত্রকের সিদ্ধান্তে রাজ্যপাল হলেও সিভি এখনও আনন্দ দিতে পারেননি বঙ্গের বিজেপি নেতাদের। ঠিক এর মধ্যেও এই মন্তব্যে আরও বিতর্ক বেড়েছে।

কয়েকদিন আগেও বিজেপি সাংসদ সৌমিত্র খাঁ মন্তব্য করেন, রাজ্যপাল হিসেবে 'জগদীপ ধনখড়কে মিস করছেন' তিনি। আবার সিভি আনন্দ বোস যে আগের পথেই চলবেন এই বিষয়ে একাধিকবার আশাপ্রকাশ করেন সুকান্ত-শুভেন্দু- দিলীপরা। কিন্তু?

আনন্দের জগদীপ-ক্ষত
৩০ জুলাই, ২০১৯ থেকে ১৮ জুলাই, ২০২২। প্রায় তিন বছর বঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে ছিলেন জগদীপ ধনখড়। কিন্তু গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী বা কেশরীনাথ ত্রিপাঠি ছাড়িয়ে জগদীপ ধনখড় ছিলেন ভিন্ন। কার্যকালের প্রথম দিন থেকেই চালিয়ে খেলতে শুরু করেন প্রাক্তন এই বিজেপি নেতা। আইনজীবি সত্তার গরমে বারবার বিতর্কে জড়ান। কার এক্তিয়ার ঠিক কতটা, রাজ্যপাল কী কী করতে পারেন, সমস্ত ক্ষেত্রেই প্রশ্ন তুলে দেন তিনি।

যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তেজনা। তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী, বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয়কে উদ্ধারে যান তিনি। সেখান থেকেই শুরু হয় বিতর্ক। জগদীপ প্রশ্নে উত্তেজিত হয় রাজনীতিও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারের সঙ্গে সাপে নেউলে অবস্থার শুরু তখন থেকেই।

২০২০ থেকে ২০২১। রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগের সন্ত্রাসের অভিযোগ। বারবার বিরোধী রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের দরবার এবং তৎক্ষণাৎ কোনও না কোনও পদক্ষেপ গ্রহণে এই উত্তেজনা চাপতে দেননি জগদীপ ধনখড়। বাংলার রাজভবন ইতিহাসে তৈরি করেছেন দামামা। শুভেন্দু থেকে সুকান্ত, রাজ্যপালের একের পর কাণ্ডে খুশি হয়েছেন বিরোধীরা। এর সঙ্গেই চলেছে টুইট তির। কখনও রাজ্যপাল টুইটে লিখেছেন, 'আমি সংলাপ মেনে চলি না, সংবিধান মেনে চলি।' আবার রাজ্যের পুলিশের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন সরাসরি।

এমনকি ভোট পরবর্তী হিংসার অভিযোগে সরব হয়েছেন রাজ্যপাল। বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন পরিদর্শনে। এর সঙ্গেই একের পর এক ঘটনায় সরাসরি মমতার সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়েছেন রাজ্যপাল। একে অপরের কাজে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সরাসরি। এমনকি মানুষের দোহাই দিয়ে টুইট বিতণ্ডা হয়েছে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গেও।

প্রায় প্রতিদিনই কোনও না কোনও বিষয়ে রাজ্য সরকারের অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছেন রাজ্যপাল। তলব করেছেন একাধিক আধিকারিককে। বিজেপি নেতাদের একের পর এক অভিযোগের ঝড় উঠেছে রাজভবনে।

বিরোধী অভিযোগ মঞ্চের অন্যতম বাহক হয়ে উঠেছিলেন জগদীপ ধনখড়। বঙ্গের অন্যতম বিতর্কিত রাজ্যপাল হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

মমতা-জগদীপ বিবাদ
একের পর এক টুইট এবং ভার্চুয়াল যুদ্ধের মধ্যেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের প্রাক্তন রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের হয়েছে চিঠি চালাচালি। প্রত্যেক মুহূর্তে দুই পক্ষের মধ্যে তৈরি হয়েছে উত্তেজনা। সাংবিধানিক প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে রাজ্যের শাসকদল। মমতার মুখে অস্বস্তির কথার মধ্যেই জগদীপ ধনখড় এবং বিজেপির সম্পর্ক নিয়েও সরব হয়েছে তৃণমূল। অভিযোগে, মোদীর রাজ্যপাল হয়ে উঠেছেন জগদীপ ধনখড়। বেড়েছে সমস্যা। রাজ্য সরকার এবং রাজ্যপালের সম্পর্কে ছেদ পড়েছে অচিরেই। যদিও একাধিকবার মমতা এবং রাজ্যপালের সাক্ষাৎ হয়েছে। কথা হয়েছে। কিন্তু মেটেনি সমস্যা। অভিযোগ উঠেছে, বিজেপি নেতাদের বলা কথায় চলছেন জগদীপ ধনখড়। আজ রাজ্য থেকে অতীত হয়েছেন তিনি। তবুও রয়েছে প্রশ্ন। উঠেছে সেই প্রসঙ্গও।

ধনখড় বনাম বোস
কেরলের বাসিন্দা। দেশের শীর্ষ পদে কর্মরত আমলা সিভি আনন্দ বোসের সঙ্গে কেন আইনজীবি জগদীপ ধনখড়ের পার্থক্য খুঁজে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

দাবি, শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠি নয় দেশের বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যের বর্তমান রাজ্যপালের কাজের ফারাক রয়েছে। তাঁদের বয়সে খুব একটা পার্থক্য না থাকলেও দুজনের কাজ করার ব্যাপ্তির পার্থক্য রয়েছে বিস্তর। যেখানে দাঁড়িয়ে বলা হচ্ছে, সিভি আনন্দ বোস বহুদিন বিভিন্ন জেলায় জেলার কাজ করেছে শীর্ষ আমলা হিসেবে। দায়িত্ব পালন করেছেন কেন্দ্রের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দফতরের সচিব, সহসচিব হিসেবে। সেই অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে তিনি খানিকটা বেশি জানেন প্রশাসনিক কাজের পরিধি এবং রাজ্যপাল হিসেবে তাঁর ভূমিকার কথা। যেখানে রাজনীতির তুলনায় প্রশাসনিক দায়িত্ব বেশি। এই অবস্থায় দাঁড়িয়েই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ভক্ত সিভি আনন্দ বোস প্রথম থেকেই সমঝোতার রাস্তায় হাঁটতে চাইছেন। যেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তো বটেই রাজ্য সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা প্রয়োজন। যা রাজ্যের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য জরুরি। অর্থাৎ রাজ্যপাল অভাব, অভিযোগ শোনা বা নিরসনের চেষ্টার সঙ্গেই এই উন্নয়নের দিকটি ভাবতেও বদ্ধপরিকর। যেখানে রাজ্যের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখা প্রয়োজন। যাতে বিরোধীদের কোনও অভিযোগের নিষ্পত্তি করতেও সুবিধা হয়।

আবার অনেকেই বলছেন। রাজ্যপাল আসলে প্রজাতন্ত্রে রাজার মতো। সাংবিধানিক প্রধান। নিয়মতান্ত্রিক পদে আসীন। সেখানে দাঁড়িয়ে বিধানসভায় বক্তব্য পেশ থেকে রাজ্যের আইনসভায় পাশ বিলে সই, সব ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকারের মুখাপেক্ষী থাকতে হয়। সেখানে দাঁড়িয়ে একজন প্রাক্তন দুঁদে আমলার তেমন কিছুই করার নেই। শুধুই খানিকটা খবরের খোরাক সৃষ্টি ছাড়া। তাই প্রথম থেকেই সহিষ্ণু ছবি তৈরি করতে চাইছেন সিভি আনন্দ বোস, এমনও বলছেন কেউ কেউ।

আর এখানেই শুরু হয়েছে তুলনা। তাহলে কি আনন্দে আকাশে বাতাসে ভাসবেন না জগদীপ ধনখড়? এই প্রশ্নের আবহেই রাজনৈতিক মহলের একাংশ বলছেন, ধনখড় এবং সিভি আনন্দ বোসের কাজের মধ্যে ফারাক থাকবে। একজন বরাবর রাজ্যের সরকারের ভুল ধরতে গিয়ে দাপুটে জয় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যা কিছু ক্ষেত্রে ভালো করেছে, কিন্তু আখেরে খুব একটা লাভ হয়নি। আর সিভি আনন্দ বোস তুফান নয়, ধীরে সুস্থে কাজটা করতে চাইছেন। যা প্রথম থেকে অন্যরকম ঠেকলেও পরে যে পূর্বসূরির মতো হবেই না, একথাও বলছেন না অনেকেই।

More Articles