ইয়াস, আমফানের চেয়েও বীভৎস! ১০০০ জনের সলিল সমাধি হয় কলকাতার যে ঘূর্ণিঝড়ে
Old Kolkata Cyclones: ১৭৫৬ সালে জুন মাসে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কলকাতা অবরোধের পরের দিন এক প্রবল ঝড়, বৃষ্টির তথ্য জানা যায়।
হাওড়া ব্রিজের কাছে স্ট্র্যান্ড্র রোড ধরে হাঁটা পথেই পৌঁছে যাওয়া যায় ছোটেলাল দুর্গাপ্রসাদ ঘাটে। এই ঘাটে একটি ফলকে লেখা আছে যে, ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে, ঝড়ে স্যার জন লরেন্স জাহাজের সঙ্গে যে সকল তীর্থযাত্রী, যাদের মধ্যে অধিকাংশই স্ত্রীলোক ছিলেন, জলমগ্ন হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য কয়েকজন কোমল হৃদয় ইংরেজ মহিলা এই ফলক উৎসর্গ করলেন। বহু মানুষ এই ঘাটে এলেও ফলকটি সবার নজরে আসে না। যাদের নজরে আসে তাদের মধ্যে বেশিরভাগ মানুষই এই ফলকের ইতিহাস জানার প্রয়োজনও বোধ করেন না। উপরন্তু বেদনাদায়ক স্মৃতি মানুষ নিজের থেকে দূরে সরিয়েই তো রাখতে চায়। ঠিক সেই কারণেই কলকাতার উপর নেমে আসা বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কথা মানুষ এক অথবা দুই প্রজন্ম অবধি মনে রাখে। তারপর সেই স্মৃতি স্থান পায় ফলকে, কোনও মানুষের দিনলিপিতে অথবা ইতিহাসের কোনও উপেক্ষিত অধ্যায়ে।
গ্রাম থেকে শহর এবং ক্রমে মহানগরী হওয়ার পর্যায়ে কলকাতা বহুবার প্রকৃতির তাণ্ডবলীলা দেখেছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো যে তথ্য পাওয়া যায় সেটি ১৭৩৭ খ্রিস্টাব্দের। কলকাতা তখন গ্রাম থেকে শহর হওয়ার পথে এগোচ্ছে। যদিও সেই ঝড়ের তারিখ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। নথি থেকে জানা যায়, সেই ঝড়ে কলকাতার বহু বাড়ি ধ্বসে পড়েছিল। সেই সময়ে নদী থেকে পূর্বদিকে ধর্মতলা এলাকা হয়ে লবণ হ্রদের দিকে যেই খালটা ছিল সেখানে বহু নৌকা ডুবে গিয়েছিল। সেই খালে নৌকাডুবি এবং ঝড়ের ফলে নৌকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণেই খালের একটি অংশের এলাকার নাম হয়েছিল ডিঙাভাঙা। কথিত আছে, এই ঝড়েই গোবিন্দরাম মিত্রের তৈরি নবরত্ন মন্দিরটি ভেঙে পড়েছিল।
আরও পড়ুন- নীলদর্পণের সঙ্গে জড়িয়ে কলকাতার রাস্তা! জেমস লং সরণির নামকরণ হয়েছিল কার নামে?
১৭৫৬ সালে জুন মাসে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার কলকাতা অবরোধের পরের দিন এক প্রবল ঝড়, বৃষ্টির তথ্য জানা যায়। সিরাজ-উদ-দৌলার কলকাতা আক্রমণের সময়ে দুই পক্ষের যে বহু মানুষের মৃত্যু হয় তাদের মৃতদেহ সেই বৃষ্টির জলে ডুবে এবং পরে পচে গিয়ে কলকাতায় মহামারী ঘটিয়েছিল।
১৭৮৭ সালের ২ নভেম্বর অ্যাটর্নি উইলিয়াম হিকির লেখা দিনলিপি থেকে প্রবল ঝড় বৃষ্টির বর্ণনা পাওয়া যায়। সেই বছর বর্ষা অতিরিক্ত সময়ের জন্য স্থায়ী হয়। সেইবার দিনে দুইবার ঝড় কলকাতার বুকে আঘাত হানে। হিকির লেখা থেকে জানা যায়, কলকাতার বহু বাড়ি ধুলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছিল। কোর্ট থেকে নদীর যেই এলাকা দেখা যায় সেখানে আটখানা বড় জাহাজ নোঙর উপড়ে নদীর পশ্চিম তীরে গিয়ে আছড়ে পড়েছিল। বহু ছোট এবং মাঝারি নৌকা ভেঙে অথবা ডুবে গিয়েছিল। তাঁর লেখা থেকেই জানা যায় যে, কলকাতা থেকে দক্ষিণে বারুইপুর অবধি রাস্তার দু'পাশে থাকা ইউরোপিয়দের বাড়িগুলোর মধ্যে ছয় খানা বাদ দিয়ে আর একটাও দাঁড়িয়ে ছিল না।
আরও পড়ুন- দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তা! হরিশ মুখার্জি রোডের নেপথ্যের মানুষকে চিনলই না বাঙালি
১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর কলকাতায় প্রবল ঝড় তাণ্ডব চালিয়েছিল। সেই ঝড়ে বহু ঘর, বাড়ি, জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এই ঝড়ে উত্তর কলকাতার বাগবাজারের কাছে মদনমোহনতলার সামনে একটি মন্দির ধ্বসে পড়েছিল। কথিত আছে, এই ঝড়ের প্রাবল্য এত বেশি ছিল যে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারের খাল থেকে নৌকা উড়ে গিয়ে উল্টোডাঙাতে পড়েছিল। এইক্ষেত্রে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই সময়ে উপন্যাসের একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা যায়, ঝড়ে নৌকা উড়ে গিয়ে উল্টোডাঙাতে পড়ে এলাকার নাম সার্থক করল। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, ঝড়ে উড়ে আসা নৌকা থেকে উল্টোডাঙা নিজের নাম পায়নি। এই ঝড়ের আগেই এলাকার নাম উল্টোডাঙা ছিল।
১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মে বঙ্গোপসাগরে উদ্ভূত ঘূর্ণিঝড় বাংলা এবং ওড়িশার কিছু অংশে তাণ্ডব চালিয়েছিল। তখনও কলকাতা এবং পুরীর মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপন হয়নি। তাই রথযাত্রা দেখবার জন্য শহরের অভিজাত পরিবারের ৮০০ এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের ২০০ মহিলা এবং পুরুষ যাত্রী স্যার জন লরেন্স নামক জাহাজে চেপে বালেশ্বর যাচ্ছিলেন। জলপথে ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে জাহাজ ডুবে যায় এবং সকলেরই সলিল সমাধি হয়। এই দুঃখজনক ঘটনায় শোক প্রস্তাব করার জন্য ছোটেলাল দুর্গাপ্রসাদ ঘাটে ফলকটি উৎসর্গ করা হয়েছিল। এই ঝড়ের তথ্য পরিবেশন করতে গিয়ে ইংলিশম্যান নামে সংবাদপত্র ছেপেছিল যে, আর একটু বেশি বৃষ্টি হলেই হেয়ার স্ট্রিট দিয়ে নৌকা চলাচল করাতে হবে। তখন কিছু নির্দিষ্ট এলাকা ছাড়া কলকাতার কোথাও বৃষ্টিতে জল জমে থাকত না। তাই এই সংবাদ থেকেই ঝড় বৃষ্টির তাণ্ডবলীলা সম্পর্কে কিছুটা আন্দাজ করা যায়।
তথ্য ঋণ : ৩০০ বছরের কলকাতা : পটভূমি ও ইতিকথা - ডা: অতুল সুর, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত (প্রথম খণ্ড)- বিনয় ঘোষ, গঙ্গার ঘাট - ডা: শিশুতোষ সামন্ত।