আমাদের সকলের মধ্যেই কি লুকিয়ে রয়েছে একজন করে সুশান্ত?
সুশান্ত চৌধুরী আর সুতপার ঘটনা নিয়ে আমাদের কৌতূহলও কি আসলে সমস্যাজনক?
খুব বেশিদিন নয়, কোভিডের ঠিক আগেই 'কবীর সিং' নামক একটি ছবি মুক্তি পায়। পরিচিত মহলে এই সিনেমা দেখেনি, এমন লোক পাওয়া মুশকিল। বক্স অফিসে সাফল্য আনে সিনেমাটি এবং জনপ্রিয় হয় বিপুলভাবে। আসল দক্ষিণ ভারতীয় ছবিটি 'অর্জুন রেড্ডি', যেটিও কিনা চূড়ান্ত সফল হওয়ার পরেই বলিউড এই সিনেমাটি হিন্দিতে রিমেক করার সিদ্ধান্ত নেয়।
এবার একটু বর্তমানে ফিরি। খবরের কাগজের পাতা খুললেই যা এখন প্রবলভাবে চোখে পড়ছে, তা হলো সুশান্ত ও সুতপার ঘটনা, বহরমপুর মার্ডার কেস। এই ভয়ংকর ঘটনার প্রভাব কীভাবে মানুষকে ভীত ,আতঙ্কগ্রস্ত করেছে, তা কারওরই অজানা নয়। কিন্তু কেন? প্রশ্ন প্রায় সকলেরই। সেই উত্তর খোঁজার তাগিদেই এই প্রতিবেদন। শুরুতেই জানাই, যে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ আমি করতে পারব, তার পুরোটাই কিছু খবরের ভিত্তিতে। তাই এই বিশ্লেষণ সম্পূর্নভাবে সঠিক সেই দাবি রাখছি না। কারণ প্রতিনিয়ত অপরাধী ও অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বয়ান নেওয়া হবে এবং নতুন বয়ানে আগামী কয়েকদিন আরও অনেক নতুন তথ্যও উঠে আসবে। তাই এখনও অবধি যা জানা গেছে, তা নিয়েই আলোচনা এগোতে পারে।
শুরুতেই 'কবীর সিং'-এর উদাহরণ দিয়েছিলাম, তার একটি বড় কারণ, সিনেমাটিতে যা খুব বেশি করে দেখানো হয়েছে তা হল toxic masculinity, পিতৃতান্ত্রিকতার চূড়ান্ত আস্ফালন। তবে তফাৎ যা ছিল, মেয়েটি সেক্ষেত্রে বিষয়টি মেনে নেয়। সত্যিকারের জীবনে সুতপা তা মেনে নেয়নি। সে প্রত্যাখ্যান করে সুশান্তকে, যার চূড়ান্ত ফল হয় মৃত্যু। এখানে একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সম্পর্ক তৈরি হয় এবং এগিয়ে চলে দু'জন মানুষের সম্মতিতে। যে কোনও একজনের সম্পূর্ণ অধিকার আছে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার। সম্পর্কের অনেক ঊর্ধ্বে স্বাধীনতা। কিন্তু অপর পক্ষ তা মেনে না নিতে পারার জন্য তাকে ব্যর্থতা হিসেবে দেখতে পারে। মনে হতে পারে, আমার পৌরুষ ব্যর্থ হলো নারীর কাছে। সেই ব্যর্থতাই আসলে শাস্তি হিসেবে পৌঁছচ্ছে প্রেমিকার কাছে, যা কিনা প্রতিশোধমূলক এবং হিংসাত্মক। তার চূড়ান্ত ফল সুতপাকে ভয়ংকরভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া। তবে সকলেই সুশান্তের মতো চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছয় না। হুমকি অবধি বিষয়টা থেকে যায়। তাহলে কোন কারণে সুশান্তের এই অস্বাভাবিকতা?
আরও পড়ুন: মানুষের মতো করেই ব্যথা পায় গাছ || যুগান্তকারী আবিষ্কার বাঙালি বিজ্ঞানীদের
মনোবিজ্ঞানে মনোরোগের বেশ কিছু ভাগ আছে, ঠিক যেমনটা শরীরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। পেটের সমস্যা যেমন বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, জ্বর যেমন বিভিন্ন অসুখের লক্ষণ হতে পারে, মনোবিদ্যায় ব্যক্তিত্বের অসুখও হতে পারে বিভিন্ন রকমের। Criminal behaviour বা psychopath- এই শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা অনেকেই কম-বেশি পরিচিত। তবে মনোবিদ্যার ভাষায় একে বলা হয় Antisocial personality disorder। আরেকটু আক্ষরিক করে বললে cluster B personality type। ঘাবড়াবেন না, এটা খুবই সহজ বিষয়। Personality cluster ৩ ধরনের হয়। A, B, C। যারা B cluster-এ পড়েন, তাঁদের মধ্যে আবেগ ও ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে সমস্যা দেখা যায়, এবং মনোযোগ আকর্ষণ করার একটা চেষ্টা লক্ষ করা যায়। মূলত ৪ ধরনের ভাগ হয়– Narcissistic personality disorder, Antisocial personality disorder, Boderline personality disorder এবং Histrionic personality disorder। সুশান্তের মধ্যে Antisocial personality disorder-এর লক্ষণ সবচেয়ে বেশি (এখনও অবধি পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে), তার মানে যে বাকি disorder-এর বৈশিষ্ট্য নেই, তেমন দাবি রাখছি না। এই সমস্যায় ভুগতে থাকা রোগীর যা যা উপসর্গ দেখা যায় তা হল- এঁদের উচিত বা অনুচিতের ধারণা থাকে না, চূড়ান্ত আবেগপ্রবণতা থাকে, বিপজ্জনক ব্যবহার বা risk নেওয়ার প্রবণতা ভীষণ বেশি থাকে, aggression এবং violence খুব বেশি হয়, কোনওকিছুর নেতিবাচক ফলাফলকে এঁরা গ্রহণ করতে বিশেষভাবে সক্ষম হন না, ব্যক্তিগত স্বার্থে অন্যকে ব্যবহার এঁরা করতেই পারেন, সহানুভূতিশীল এঁরা একেবারেই নন এবং বিবেকবোধ ও এঁদের থাকে না।
এবার আপনি ভাবতেই পারেন, এরকম কেন হয়? পৃথিবীতে প্রত্যেক শিশু যখন জন্মায় তখন সে নিষ্পাপ, ফুলের মতোই সুন্দর, তাহলে কী কী কারণে তাঁরা সুশান্ত চৌধুরী হয়ে উঠছে? এভাবে ভেবে দেখেছেন কি? যদি খতিয়ে দেখেন, দেখবেন এরকম বহু সুশান্তের ছোটবেলা কী ভীষণভাবে ভয়ংকর, অথবা ক্রমাগত বাবা-মায়ের থেকে অবহেলা বা অনেকসময় অত্যন্ত আদরে সবকিছু পেয়ে যাওয়াও, তাদের সবকিছু পেতেই হবে- এই মানসিকতার জন্ম দেয়, এছাড়াও থাকে জিন বা অস্বাভাবিক মস্তিস্কের ক্রিয়া। অনেকসময় বীজ বপন হয় ছোটবেলায়, অবাধ্যতা, মিথ্যে বলা, চুরি করা, সঠিক শিক্ষার অভাব, বন্ধুদের প্ররোচনা- এই সমস্তকিছু এবং এর থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে শিশুকে না বুঝিয়ে তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নিগ্রহ করা। ভেবে দেখুন, যন্ত্রণার শিকড় তৈরি হয়ে যাচ্ছে শৈশব থেকেই।
এবারে আসি নিজেদের কথায়, একথা ঠিক, মানুষের অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে আমরা যেমন ভীষণ ভীত, তেমন আবার কৌতূহলীও। একটা জিনিস লক্ষ করবেন, এ-ক'দিনে ঘটে যাওয়া অসংখ্য ঘটনার মধ্যে আপনার মন কিন্তু এই খবরেই বেশি ধাবিত হচ্ছে। অনেকে আবার রাস্তায় সুতপাকে খুন করার ভাইরাল হওয়া ভিডিও কেন স্বচ্ছ নয়, তা নিয়েও বেশ হতাশ। অনেকে আবার হয়তো এটা ভেবে ফেলছেন, ‘বেশ হয়েছে’ , কোথাও যেন তার প্রেমিকার কাছ থেকে পাওয়া ব্যর্থতা, প্রত্যাখ্যানের প্রতিশোধ সুশান্ত নিয়ে নিয়েছে। কাজেই পুরোপুরিভাবে সুশান্ত চৌধুরী আপনার মধ্যে না থাকলেও, খানিক জায়গায় অল্প অল্প করে সে কি কোথাও লুকিয়ে নেই? আর ভয়টা এখানেই। রাগ ও যৌনতা এই দু'টি আমাদের কাছে প্রাথমিক বিষয়। না চাইলেও মন ধাবিত হয় সেদিকেই। প্রত্যাখ্যান, ব্যর্থতাও আমাদের ভয়ংকর aggressive করে তোলে, অনেক না-পাওয়াকে, হেরে যাওয়াকে মনে করিয়ে দেয়, তাই এই দুইয়ের গ্রহণযোগ্যতা সময়সাপেক্ষ ও জটিল প্রক্রিয়া এবং এই মেনে নেওয়া যন্ত্রণাদায়ক তো বটেই। তবে কোনওকিছুই অসম্ভব নয়, আমরা জানি। তাই আমাদের মধ্যে লুকিয়ে থেকে যাওয়া সুশান্তদের নিয়ে, কবীর সিংদের নিয়ে আমরা যেন সচেতন হতে পারি, চিহ্নিত করতে পারি, নিজেকে এবং অন্যদেরও। দরকার পড়লে মনোবিদদের সাহায্য নিতে পারি (সোশ্যাল মিডিয়ার দরুন এই সাহায্য বিশেষ দুর্লভ নয়), সর্বোপরি নিজে ভাল থাকতে পারি, ক্রমাগত প্রতিশোধপরায়ণ, অহেতুক aggression পুষে রেখে আমিও তো ভালো নেই, তাই না?