শকুনের সংখ্যা কমায় ৫ বছরে ৫ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ভারতে! অবাক করা তথ্য গবেষণায়
Vulture Extinction: শকুনের সংখ্যা ব্যাপক কমে যাওয়াতে ৬৯.৪ বিলিয়ন ডলার বা ৫৮,৬২১ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ভারত।
ভারতবর্ষে অধিকাংশ পশু-পাখির সঙ্গেই ধর্ম, শুভ-অশুভ বিষয়টি জুড়ে গিয়েছে। সুপ্রাচীনকালের ধারণা অনুযায়ীই একই প্রকৃতির একই সৃষ্টি কখনও হয়ে ওঠে পূজনীয়, কখনও 'অশুভ'! চিল-শকুনের সঙ্গে যেমন এই 'অশুভ' ধারণাটি জুড়ে রয়েছে মৃত্যুর অনুষঙ্গে। চিল-শকুন মড়াখেকো। চোখের দৃষ্টিতে হাড়হিম হয়ে যাওয়ার মতোই অবস্থা হয়। ফলে ভারতীয় পক্ষীকূলে তাদের কদর নেই। অথচ এই শকুনের না থাকার জন্যই হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিল ভারতবর্ষ। আমেরিকান ইকোনমিক অ্যাসোসিয়েশন জার্নালে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা অনুসারে, ১৯৯০-এর দশকে ভারতে শকুনরা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছিল। ফলে মৃতদেহ থেকে মারাত্মক ব্যাকটেরিয়া এবং সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে, যার ফলে পাঁচ বছরে পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়।
দ্য সোশ্যাল কস্টস অফ কীস্টোন স্পেসিস কোল্যাপস: এভিডেন্স ফ্রম দ্য ডিক্লাইন অফ ভালচার ইন ইন্ডিয়া সমীক্ষা অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত শকুনের সংখ্যা ব্যাপক কমে যাওয়াতে ৬৯.৪ বিলিয়ন ডলার বা ৫৮,৬২১ কোটি টাকার অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ভারত। ফলে, শকুনের উপস্থিতি ‘অশুভ' নয়, শকুনের বিলুপ্তিই ভারতীয় অর্থনীতিতে অশনি সংকেত হয়ে দেখা দেয়। সমীক্ষকরা বারেবারে তাই উল্লেখ করেছেন যে, ভারতীয় বাস্তুতন্ত্রের জন্য শকুন অন্যতম অপরিহার্য পাখি।
আরও পড়ুন- মৃত ভাষায় কথা বলতে পারে তোতাপাখি! যে ঘটনা চমকে দিয়েছে বিশ্বকে…
রোগে ভুগছে এমন গবাদি পশুদের ডিক্লোফেনাক নামক একটি অ্যান্টিইনফ্লেমেটারি ওষুধ দেওয়া শুরু করেছিলেন কৃষকরা। এই ঘটনার পর থেকেই শকুনের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। শকুনের কিডনিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলে এই ডিক্লোফেনাক ওষুধটি। ওষুধটি গবাদি পশুর মৃতদেহের মধ্যে থেকেই যায় এবং শকুন যখন সেই মৃতদেহ খায়, তাদের জন্য মারাত্মক প্রাণঘাতী হয়ে ওঠে।
ভারত সরকার ২০০৬ সালে ডাইক্লোফেনাক ওষুধটি নিষিদ্ধ করেছিল। গবেষণায় বলা হয়েছে, এই একটিমাত্র ওষুধের প্রভাবে শকুনের সংখ্যা পাঁচ কোটি থেকে কমে দাঁড়ায় মাত্র হাজার। শকুনের সংখ্যা কমতে থাকায় পশুর মৃতদেহ পচে যেতে থাকে। যার ফলে সংক্রমণ ও অন্যান্য রোগ সহজেই ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
শকুনের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রভাব বোঝার জন্য, গবেষকরা ভারতের বিভিন্ন জেলায় শকুনের আবাসস্থলের মানচিত্রগুলিকে পরীক্ষা করেছেন। জলের গুণমান, আবহাওয়া এবং হাসপাতালের সংখ্যা খতিয়ে দেখে ৬০০টিরও বেশি জেলার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পরিসংখ্যানও খতিয়ে দেখেছেন তারা।
গবেষকরা দেখেছেন, ১৯৯৪ সালের আগে এই জেলাগুলিতে গড়ে মানুষের মৃত্যুর হার ছিল প্রতি ১,০০০ জনে ০.৯%। এই হিসেবটি একেবারে মূলগত, যা একটি নির্দিষ্ট জেলায় প্রচুর পরিমাণে শকুন আছে কিনা তা নির্ধারণ করে। ২০০৫ সালের শেষ নাগাদ, দেখা যায় যে এলাকায় প্রচুর সংখ্যক শকুনের আবাস ছিল সেখানে গড়ে মানুষের মৃত্যুর হার ৪.৭% বৃদ্ধি পেয়েছে, অর্থাৎ প্রতি বছর প্রায় ১,০৪,৩৮৬টি অতিরিক্ত মৃত্যু হয়েছে। গবেষণায় আরও দেখা যায়, যে জেলাগুলিতে সাধারণত শকুন পাওয়া যায় না সেখানে মৃত্যুর হার স্থিতিশীল, ০.৯%।
আরও পড়ুন- জলেস্থলে অবাধ বিচরণ! দেখা মিলল পৃথিবীর ভয়ঙ্করতম পাখির
শকুন সংখ্যা হ্রাসের কারণে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির হিসেব করার জন্য গবেষকরা পূর্ববর্তী গবেষণার উপর নির্ভর করেছিলেন। সেই গবেষণাগুলি বলেছে, ভারতীয় সমাজ একজন ব্যক্তির জীবন বাঁচাতে প্রায় ৫.৫৬ কোটি টাকা ব্যয় করতে ইচ্ছুক। ২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত বছরে শকুন সংখ্যা হ্রাসের ফলে মোট অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৯.৪ বিলিয়ন ডলার।
গবেষক অনন্ত সুদর্শন উল্লেখ করেছেন, ভারতের মতো একটি দেশে যেখানে গরুর মাংস খাওয়ার উপর আঞ্চলিক নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যেখানে বেশিরভাগ গবাদি পশুই মৃতদেহে পরিণত হয়। ইংল্যান্ডের ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সহযোগী অধ্যাপক সুদর্শন বলেছেন, শকুন বিনামূল্যে এই মৃতদেহ 'সৎকার' করে থাকে। একটি শকুন একটি গরুর মৃতদেহকে পুরো হাড়ে পরিণত করতে প্রায় ৪৫ মিনিট সময় নেয়।
শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের হ্যারিস স্কুল অফ পাবলিক পলিসির সহকারী অধ্যাপক, ও এই গবেষণার সহ-লেখক ইয়াল ফ্রাঙ্ক বিবিসিকে বলেছেন, শকুন প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে মৃতদেহের নিকেশ করে আমাদের পরিবেশ থেকে ব্যাকটেরিয়া এবং রোগজীবাণু ধারণ করে এমন মৃত প্রাণীদেরও সরিয়ে ফেলে। ফলে মানব স্বাস্থ্যে শকুনের ভূমিকা অপরিসীম। 'অশুভ' আসলে মানুষের প্রভাব, যাতে বন্যপ্রাণ নিঃশেষ হয়ে গেছে বহু। শকুনের মতো গুরুত্বপূর্ণ পাখিকে শেষ করে দিয়েছে মানুষেরই আবিষ্কৃত ওষুধ।