খুনের ভয় নিয়েই আফতাবের সঙ্গে শ্রদ্ধা, অত্যাচার সয়েও কেন সম্পর্ক থেকে বেরতে পারেন না মহিলারা?

Delhi Murder Case : এই ঘটনাগুলি একেকবারেই বিক্ষিপ্ত নয়, তা বিভিন্ন পরিসংখ্যান, মনোবিদ, সমাজতাত্ত্বিকদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। বরং, প্রতিটা ঘটনাই সরু কয়েকটি সুতোর মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত।

ঘটনা ১ : শ্রদ্ধা ওয়ালকর। প্রেমিক আফতাব পুনাওয়ালার সঙ্গেই থাকবেন, ঘর বাঁধবেন এই স্বপ্নই দেখেছিলেন বছর ২৭-এর এই তরুণী। কিন্তু বাড়িতে কেউ এই সম্পর্ক মেনে না নেওয়ায় দিল্লিতে প্রেমিকের বাড়িতে চলে আসেন। দু’জনে মিলে একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। কিন্তু শ্রদ্ধা বিয়ের কথা তুললেই আফতাব কেমন একটা হয়ে যেত। দু’জনের মধ্যে শুরু হতো অশান্তি। চলতি বছরের ১৮ মে সেরকমই ঝগড়া চলছিল আফতাব-শ্রদ্ধার মধ্যে। সেই সময়ই শ্রদ্ধাকে গলা টিপে খুন করে আফতাব পুনাওয়ালা। পরে তাঁর নিথর দেহ ঠাণ্ডা মাথায় টুকরো টুকরো করে সে কেটে ফেলে। নতুন ফ্রিজ কিনে এনে সেখানেই প্রেমিকার ‘টুকরো’ করা দেহ রেখে দেয়। পরে একটু একটু করে সেই দেহ লোপাটের কাজ শুরু করে। শ্রদ্ধার বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে গত নভেম্বর মাসে তদন্ত শুরু হওয়ার পর ঘটনাটি সামনে আসে। শিহরিত হয়ে ওঠে গোটা দেশ। পুলিসও হতভম্ব হয়ে যায়।

ঘটনা ২ : এটিও দিল্লিরই ঘটনা। ব্যাপারটি ঘটে শ্রদ্ধা হত্যার ঘটনাটি সামনে আসার পরই। দিল্লির গণেশ নগরে একটি ভাড়া বাড়িতে নিজের মেয়েকে নিয়ে থাকতেন রেখে রানি নামের এক মহিলা। মনপ্রীত সং নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর ভাব ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়। মনপ্রীত নিজে বিবাহিত, দু’টি সন্তানও রয়েছে। তবে রেখা রানি ও তাঁর মেয়ের সঙ্গে সাত-আট বছর ধরে গণেশ নগরেই থাকত সে। ১ ডিসেম্বর সেই বাড়ি থেকেই রেখা রানির রক্তাক্ত মৃতদেহ পাওয়া যায়। পুলিস দেখে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে তাঁকে কোপানো হয়েছে। তারপরই তদন্তের পর পলাতক মনপ্রীতকে গ্রেফতার করা হয়। তার দাবি, শ্রদ্ধার মতোই রেখার মৃতদেহও টুকরো করার চেষ্টা করেছিলেন। এদিকে মৃতার মেয়ের বক্তব্য, এর আগেও তাঁর মা-কে মারধোর করত মনপ্রীত। ক্ষতি করার চেষ্টাও করেছিল।

পরপর ঘটে যাওয়া দিল্লির দু’টি ঘটনা। এর বাইরেও এমন বহু হিংসার ঘটনা ভারতে অহরহ ঘটে চলেছে। গার্হস্থ্য হিংসার জেরে বলি হচ্ছেন মহিলারা। উত্তর প্রদেশের সীতাপুরেও নিজের স্ত্রীকে খুন করে তাঁকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলেছিল স্বামী পঙ্কজ মৌর্য। এই ঘটনাগুলি একেকবারেই বিক্ষিপ্ত নয়, তা বিভিন্ন পরিসংখ্যান, মনোবিদ, সমাজতাত্ত্বিকদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট। বরং, প্রতিটা ঘটনাই সরু কয়েকটি সুতোর মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত।

আরও পড়ুন : ভালোবাসার পরিণতি ৩৫ টুকরো, লিভ ইন সম্পর্কে যেভাবে খুন হলেন শ্রদ্ধা ওয়ালকর! 

এখানেই একজনের বক্তব্য একটু তুলে আনা দরকার। তাঁর নাম লক্ষ্মণ নাদার। পরিচয়, দিল্লি হত্যাকাণ্ডে মৃতা শ্রদ্ধা ওয়ালকরের বন্ধু। শ্রদ্ধার সঙ্গে আলাপের সূত্রে আফতাবকেও চিনতেন লক্ষ্মণ। পুলিসের কাছে ওই দু’জনের সম্পর্কে কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা জানিয়েছেন। ২০১৯ সালে শ্রদ্ধা আর আফতাবের পরিচয়, ঘটক একটি ডেটিং সাইট। তারপর দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়। তবে এই সম্পর্ক শ্রদ্ধার বাড়ির লোক মেনে না নেওয়ায় সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসেন শ্রদ্ধা। তাঁর বাবার বক্তব্য, বারবার ফোন করা সত্তেও শ্রদ্ধা তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেননি।

এই ঘটনা তো সবার জানা। তবে লক্ষ্মণ আরও একটি তথ্য তুলে ধরেন। প্রথমদিকে শ্রদ্ধা আর আফতাবের সম্পর্ক ভালোই ছিল। কিন্তু পরে শুরু হয় ঝগড়া। আফতাব যে সুযোগ পেলে তাঁর ক্ষতি করবে, এই কথাটি অনেক আগেই নাকি বুঝেছিলেন শ্রদ্ধা ওয়ালকর। ২০২০ সালে কোনও একটি ঘটনার জেরে তিনি ভয় পেয়ে যান। বাড়ি থেকে না বেরিয়ে এলে আফতাব তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলতে পারে, এই ভয়ের কথা বন্ধু-বান্ধবদেরও জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু বন্ধুরা পুলিসের কাছে যেতে চাইলে শ্রদ্ধাই বারণ করেন। প্রেমিককে জেলের ওপারে দেখতে পারবেন না তিনি। কিন্তু সম্পর্ক থেকে বেরিয়েও আসতে পারছেন না।

সমাজতাত্ত্বিক, মনোবিদরা এই বিশেষ ব্যাপারটির দিকেই বারবার ইঙ্গিত করছেন। এই ছবিটা আজকের নয়, বহুদিনের। পৃথিবী জুড়েও এমন অনেক ঘটনার কথা জানা যায়। নিছক খুন নয়’ নিজের কাছের মানুষ, পরিবারের লোকেদের দ্বারা অত্যাচারিত ও খুনের সেই ট্র্যাডিশন আজও চলছে। ২০১৮ সালে ইউনাইটেড নেশনস বা রাষ্ট্রপুঞ্জ একটি শিহরণ জাগান তথ্য দেয়। পৃথিবী জুড়ে ঘটে চলা হত্যার ঘটনা নিয়ে এই রিপোর্ট পেশ করা হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, বিশ্বে প্রতিদিন অন্তত ১৩৭ জন নারী, মেয়েরা তাঁদের পরিবারের কারও হাতে খুন হয়েছেন। প্রায় ৩০ হাজার মহিলা নিজের প্রেমিক বা স্বামীর হাতে নিগৃহীতা হন এবং তাঁদের খুন করা হয়। মানে প্রতিদিন প্রায় ৮২ জন মহিলা। দু’টি হিসেবকে একসঙ্গে মেলালে এই সংখ্যাটা দাঁড়ায় দিন প্রতি ২১৯ জনে। এরা তাদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন, যাঁদের অত্যন্ত ভরসা করতেন, বিশ্বাস করতেন, একসঙ্গে জীবনটা কাটাতেন।

আরও পড়ুন : প্রকাশ্য বাজারে কেটে নেওয়া হল স্তন, হাত-পা, বিহারের বীভৎসতায় কাঁপছে দেশ

পাঠকদের এও মনে পড়বে, ২০২০ সালে যখন করোনা মহামারি গোটা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন লকডাউনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সব। সেই সময় ফ্রান্স সহ বেশ কিছু দেশে মহিলাদের ওপর গার্হস্থ্য হিংসার পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। একটি মানুষ রাতারাতি একদিনের মধ্যে নৃশংস হয়ে ওঠে না। তাঁর স্বভাব বদলে যেতে থাকে, অত্যাচার ও দমন পীড়নও বাড়তে থাকে। যিনি ওই মানুষটির সঙ্গে রয়েছেন, তিনি সবার আগে এই ব্যাপারগুলি বুঝতে পারেন। তবুও মহিলারা কেন সেখান থেকে বেরোতে পারেন না? শ্রদ্ধারা কেন সেই জাঁতাকলে আটকে থাকেন বারবার?

মনোবিদ ও সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন, এর অন্যতম কারণ ভয়। আফতাবকে ছেড়ে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে সত্যিই ভয় পেয়েছিলেন শ্রদ্ধা। একবার নয়, বারবার। নয়তো ২০২০-র ওই রাতেই তিনি বেরিয়ে চলে আসতেন। কিন্তু তিনি তা করেননি। অত্যাচারের প্রতিবাদ করলে যদি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যায় অপর মানুষটি? যদি আর ফিরে না আসে? সেই ভয় আঁকড়ে ধরেই পথ চলা। এমনকী ২০২২-র সময়ও এমন ভাবনা অসম্ভব নয়, শ্রদ্ধা, রেখা রানিরা তাঁর প্রমাণ।

পাশাপাশি রয়েছে সংস্কার। যে সংস্কারের বীজ বহু বছর ধরে তৈরি করে রেখেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। কীরকম, তার একটি ছোট্ট উদাহরণ থাকল। বিয়ের পর সংসার তৈরি হলে সুখ দুঃখ, হাসি কান্না সবই থাকে। কিন্তু সেটাই যখন অত্যাচার, মারধোর ও গার্হস্থ্য হিংসার নৃশংসতার দিকে চলে যায়, তখন একটি মেয়ে সেখান থেকে সরে আসতে চায়। সরে যাবে কোথায়? নিজের বাবা-মার কাছেই যাবে সে। কিন্তু মা-বাবা ও পরিবারের বক্তব্য থাকে, “একটু মানিয়ে গুছিয়ে নাও।” ছোট থেকে এই মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার ‘সংস্কৃতি’র মধ্যেই বড়ো হয়েছে অনেকে। সেই ব্যবস্থা ছোট থেকেই দেখছে তাঁরা। হয়তো আফতাবও সেরকম পরিমণ্ডলের মধ্যেই বড়ো হয়েছে। আফতাবের মতো আরও বহু বহু মানুষ সেভাবেই নিজেদের ভাবিয়েছে। মানিয়ে গুছিয়ে নেওয়ার ভিড়েই বেড়ে চলেছে একের পর এক হিংসা ও হত্যার ঘটনা।

আরও পড়ুন : প্রকাশ্য বাজারে কেটে নেওয়া হল স্তন, হাত-পা, বিহারের বীভৎসতায় কাঁপছে দেশ

এই সূত্র ধরেই একটা কথা আবারও সামনে আনা যাক। সম্পর্ক থেকে সরে যাওয়াই যায়; কিন্তু যাবে কোথায়? এই প্রশ্ন হয়তো শ্রদ্ধা, রেখার মনেও বারবার এসেছে। শ্রদ্ধা নিজের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে আফতাবকে বেছে নিয়েছিলেন। আফতাব তাঁর ভরসার জায়গা হয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে সরে গেলে তো একা হয়ে যাবেন তিনি! বাড়িতেই বা কীভাবে যাবেন? কোথায় যাবেন? কিংবা রেখা রানির কথাই ধরুন। মনপ্রীত আসার পর তিনি একটি ভরসা পান। সেই ভরসাই তাঁর কাল হল। ‘হাতের ওপর হাত রাখা’ সহজ কাজ না হলেও, সেভাবেই একসঙ্গে পথ চলার অঙ্গীকারবদ্ধ হন সবাই। সমস্ত সম্পর্কের মূলেই থাকে এই ভরসা, বিশ্বাসের জায়গা।

কিন্তু বিশ্বাস সরে গেলেও, অত্যাচার সহ্য না করে বেরিয়ে আসা আজও হয়তো অনেকে পারেন না। কিংবা সমাজের ভয়ে অনেকে সেই প্রতিবাদ করারও সাহস পান না। ফলে অত্যাচারের ঘড়া আরও ভরতে থাকে। একসময় উপচে আসে, তবুও সেই অত্যাচার বন্ধ হয় না। নিজের কাছের মানুষদের থেকে একের পর এক কথা তাঁদের প্রতিবাদের শক্তিকেও স্তিমিত করে দেয়। শ্রদ্ধা, রেখাদের হত্যা সেই প্রশ্নই বারবার তুলেছে। ভারতীয় মূল্যবোধ আর মানিয়ে নেওয়ার ভিড়ে আর কত প্রাণ শেষ হবে?

More Articles