বিয়ে ভাঙা মেয়েকে তুমি কাঁটা চচ্চড়ি রেঁধে খাওয়াবে না?

এই ফাগুন মাস পড়ছে কি পড়েনি বিয়ের সানাই বাজতে লেগেছে। এ পাড়ার মেয়ে বুড়ো সকলের মুখে আর কথা নাই। পাড়ার মেয়ে এই আর কদিন পর শ্বশুর ঘর যাবে তাই নে আর বকবকানি মোটে থামে না! কেবল মেয়ের বাপে উবু হয়ে বসে হিসেবের ফর্দ মেলাচ্ছে। তা বললি হবে? মেয়ের বে বলে কতা। লাখ কথা চালাচালি না হলে কি বিয়ে হয় বাপু! মেয়ের পিসি তাই বসে বসে বিয়ের পত্রে হলুদ সিঁদূরের ফোঁটা লাগাচ্ছে। এই তো আর কদিন পরেই ড্যাং ড্যাং করে মেয়ে চলে যাবে। সে গেলেপ্পর এই ঘর, এই দ্যাল যেন আঁধার। মেয়ের মা এই কথা ভাবেন আর খুন্তি দে নেড়ে চেড়ে মাখো মাখো কাটাচচ্চড়ি রাঁধেন। আনমনা হয়ে খানিক নুন বেশিই দিয়ে ফেলেছেন বুঝি। অত কী আর পারা যায়! মানুষের মন তো বাপু। এ তো আর কলে বানানো যন্তর নয় তোমাদের। মেয়ে আমার কোথায় গে পড়বে তার নেই ঠিক , মায়ের কি এখন তেল নুনের হিসেব বাতলাবার সময়! তবু, মেয়ে যদি খানিক বুঝতো। সে বলে, মা অত ভাবিস কেন! ওরা কি খারাপ নাকি! তোর মেয়েকে কি না খাইয়ে রাখবে? এসব কথা মায়ের কানে সহজে ঢোকে না। মা তো জানে, মেয়ে আমার কাঁটা মাছ বেছে খেতে শেখেনি। বাপে তাকে পাত থেকে তুলে তুলে পাকা মাছ খাইয়েছে। খাওয়াবে নাই বা কেন! এই মেয়েই তো সব। মেয়ে কোলের মাছ ভালোবাসে, বাপে জানে। বাপ সোহাগী মেয়ে নিয়ে এখন কী যে করেন! এই ক'দিনে তিনি তাই ভেবে ভেবে রান্না করেন। ভাবেন, নতুন বাড়িতে গিয়ে যদি সে চেয়ে খেতে না পারে, যদি তাকে তারা কোলের মাছখানা তুলে না দেয়! লোকে তো বলেই খালাস, সে আর আগের মতো দিনকাল আছে মেজবউ! তোমার মেয়ে জলে পড়বে না। তবু, মায়ের মন তো! ঘরে ঘরে কত 'শিকখিত' মানুষ দেখা হলো, চেনা হলো!

বাসি মাংস লোকে ভালোবেসে খায় কিন্তু বাসি ভাত, বাসি চচ্চড়ির সদগতি করে কে! এসব ভাবলে মনখানা খানিক থমকে যায়। সেই থমকে থাকা মনখানাকে আবার যুত করে গুছিয়ে নিতে নিতে তেল গরম হয়ে যায় কড়াইয়ে। খোসলের বড়াখানা ভেজে নিতে নিতে একবার মেয়েকে তলব করেন মা। কিন্তু মেয়ে কোথায়! তার কি এখন খোসলের বড়ায় মন আছে! সে এখন কোন চুলোয় গে আড্ডা দেচ্ছে দেখো গে যাও। বড়া কখানা এবারে তিনি ছোটো কাসিখানায় তুলে রাখেন। ডালের সম্বরা দেওয়া হলে বাটি পোস্ত করবেন। ব্যাস। ওবেলা মাংস হবে। সে রান্না করবে মেয়ের বাপে। এবেলাই নিতাইয়ের দোকান থেকে খাসি নিয়ে এসেছে সক্কাল সক্কাল। মেয়ের আবার বাপের হাতের এই ঝোলখানা ভারী পছন্দ। আদা বাটায় জিরে বাটায়, লঙ্কাবাটায়, তুকুন খানিক গরম মল্লায় কী যে সোয়াদ হয়। বাপ বেটিতে জোগাড় করে নেবে এখন, মেয়ের মা বরং বাটি পোস্ত নামিয়ে বাসি টকখানা নামিয়ে নেন সিকে থেকে। এমন পুরনো তেঁতুলের টক কে না ভালোবাসে! তবু, টক বাসি না হলে ভালো লাগে না বাপু। সব মিটলে পর মায়েতে মেয়েতে বাপেতে পিসিতে মিলে খেতে বসে। খেতে খেতে ওদের গপ্পো আর ফুরোয় না। গপ্পে গপ্পে হাত শুকিয়ে চড়চড় করে কিন্তু গপ্পের যেন শেষ নেই আজ। বাপে উঠে যায় খানিক পর, মহিলা মহলের আড্ডা চলতিই থাকে চলতিই থাকে।

সে আড্ডায় ঢুকে পড়ে খেরো দে মাছের ডিমের টক, মাছের ডিমের টক পেরিয়ে মোচ্ছবের খেচুড়ি। গল্পের লাটাই যেমন গড়ায় আর কী। কাঁটা চচ্চড়ি চিবোনো মেয়ে এখন মায়ের মনে মন ডুবিয়ে গল্প শুনছে। বিয়ের গল্প, ভোজের গল্প। সে সব ভোজে আর কিছু না থাক হারু ঠাকুরের ভিয়েন বসবেই। বোঁদে রসগোল্লা গড়া শেষ হলে জোড়া মণ্ডা গড়া হবে। ছেলেপুলেরা পেট পুরে মণ্ডা না খেলে আর বিয়ে কী! সেজ পিসেমশাই নিজে মিষ্টির ঘরের চাবি নিয়ে ঘুরে বেরাচ্ছেন, কী জানি কখন খানিক খানিক মিষ্টি যদি হাওয়া হতে যায়! রাত থাকতে জল সইতে যেতে হবে, সেসব হলে পর ঘরে ঘরে জ্ঞাতি কুটুমের ভিড় বাড়তে থাকবে। সকাল সকাল তখন শালপাতার থালায় মুড়ি বোঁদে আর ডিংলির তরকারি না হলে চলবে কেন! সেজ খুড়ির আবার মুখ খুব। ঠিক বলে উঠবেন, কি গো ডিংলির তরকারিতে কি ছোলাটোলা পরেনি নাকি! পেলুম না যে!

মাধু তখন কাচিয়ে কাচিয়ে এক খাবলা ছোলা আবার ওনার পাতে তুলে দিয়ে আসবে। সকালের পব্ব মিটলে দুপুরের রান্না। সে রান্নায় ওই বাঁধা খাবার। হারু ঠাকুরের হাতে ঝোল ঝোল সূক্তো, কলাই ডাল, কুমড়ি, ছ্যাচড়া আর মাছের ঝালদা। ওবেলায় তো খাসি হবেই! উফ কাঁটা, তেল, পোটা সব দে যা ছ্যাচড়া রাঁধে না হারু ঠাকুর! এসব শুনে মেয়ে বলে আমি কিন্তু দুপুরে খানিক ছ্যাচড়া দে ভাত খাবো মা। একথা শুনে মেয়ের মা, মেয়ের পিসি চোখ কপালে তোলেন। বলেন, বিয়ের দিনে খাবি কিরে! ওদিন যে খেতে নেই মা। মেয়ে এসব শুনতে রাজি না। মনে মনে লোভ চেপে উপোস করা বুঝি খুব ভালো? তাতে বুঝি ঠাকুর পাপ দেয় না? এসব তর্কে মেয়ের মা ঢুকতে চান না। যত অবান্তর কথা। বিয়ে কি আর চোদ্দবার করবি? একবারই তো করবি। মেয়ে এবারে হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে, চোদ্দবার না করলেও এ বিয়েই শেষ বিয়ে কিনা কী করে বলি মা? করতেও তো পারি! আইবুড়ো মেয়ের এমন কথা শুনলে আর কি মায়ের মাথার ঠিক থাকে! এ কি শহর! মফস্বলের মানুষ এমন কথা ভাবতেও পারে না। শুভ কাজের আগে, এ কী অলুক্ষুণে কথা! বিয়ে ভাঙা কি অতই সোজা! বাপে লাই দিয়ে দিয়ে মেয়ের মাথাটা খেয়েছে এক্কেবারে। মেয়ে জানে, মায়ে এসব কথায় দুঃখু পায়। এবারে তাই মায়ের চোখের দিকে তাকিয়ে সে নরম হয়ে কথা বলে। বলে, বিয়ে ভাঙবোই তো বলিনি! তবে যদি প্রয়োজন হয় ভাঙতেও তো পারি! অসুবিধা কি মা? বিয়ে ভাঙা মেয়েকে তুমি কাঁটা চচ্চড়ি রেঁধে খাওয়াবে না?

More Articles