আচার আগলানো কনকসুন্দরী, রিফিউজি মাইনসের খিদের গল্প

মানুষের মন তো! সে যে আসলে কখন কী চায় তা বোঝা দায়। এই ধরা যাক সক্কাল সক্কাল চড়চড়ে রোদ্দুর দেখে এক খাবলা কলাই ডাল ভিজিয়েছিল মৌরীবাটা দে রানবে বলে। এখন রোদ্দুর নরম হয়ে আচমকা মেঘলা হয়ে গেলে মানুষ কী করে! তখন কি তার কলাই ডাল আর আলু পোস্ত দে ভাত খেতে মন যায়? মোটে না। তার তখন প্যাঁজ ফোঁড়ন দে মুসুরির ডাল আর আলু প্যাঁজকলি ভাজা খেতে সাধ যায়। চাইলেই কি আর হয় সে সব? হয় না। মানুষের জেবনই ওরকম, সে চায় এক আর তার মন বলে আর এক। এই নিয়েই তো সংসারখানা চলছে বাপু। এই যে আমাদের দিদিঠাকরুণ বসে বসে আচারের বয়ম পাহারা দেচ্ছেন, এর কি কোনো দরকার আছে? নেই তো, না দিলেই বা ক্ষেতি কী! তাও লম্বা করে পা মেলে দে উনি বসে থাকবেন আর বকর বকর তো চলছেই। কান ঝালাপালা করে দিল। বললে আবার দুঃখু পায়।

বলে, এই ত আছি কদিন, তারপরেই পাখি ফুড়ুৎ। নাতি পুতিরা তাই আর বেশি কিছু বলে না। তাই না তাই, মানুষটা আর কদিনই বা আছে। এই ত গেল শিবরাত্তিরে সুভাষপল্লীর মাঠে যাত্রা গানের দল এল। আর কেউ যাক আর না যাক দিদিঠাকরুণের যাওয়া চাই। বলে, উপোসে আর কী হয় রে ছেমড়ি! কত উপোস করসি। তগো তার জানস কী! বাপে বিয়া দিসিলো ভাতের লাইগ্যা। দ্যাশে থাকতে কি জানসি উপাস কারে কয়! ভাতই ভাত, মাইনসে খাইলেও সে ভাত ফুরায় না। নাতিপুতিরা এসব গল্প হাজারবার শুনেছে, ওরা আর শুনতে চায় না এসব। বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি, আর বলতে হবে না। খেয়েছ তুমি? খাওয়া হয়েছে? এসব কথায় বুঝি বুড়ির ভাতের কথা পেরিয়ে খিদের কথা মনে পড়ে যায়। বুড়ি তখন হাঁক পাড়ে, কি রে বউ! ভাত হইসে? ফ্যানডা রাখছোস? ছাগলিডা পোয়াতি, তগো সে খেয়াল আসে!

এই সব নিয়ে এ বাড়ির চৌহদ্দি রোজ রোজ সরগরম হয়ে ওঠে একেক সময়ে। সেই উচ্চকিত স্বর আর ভাতের গন্ধের মধ্যে ডুবে যেতে যেতে বুড়ি এখনও বাঁচার আনন্দ টের পায়। তাই না সে বসে বসে আচারের বয়ম পাহারা দেয় পুরনো অভ্যাসে! গরম ভাতের গন্ধে বুড়ির বুঝি বা মৌতাত লাগে, নইলে সে আর কেন অমন করে স্মৃতির মধ্যে তলিয়ে যাবে? চিরকাল সে শুনে এসেছে, বউ মানুষের অত ভাত খেতে নেই। মাগো, এ কী হাভাতের ঘরের মেয়ে গো! ভাত নেয় এই উঁচু করে, ও তো বেড়ালও ডিঙোতে পারবে না গো! এসব শুনতে শুনতে কনকসুন্দরী মাথা নীচু করে ঠুসে ঠুসে ভাত খেয়েছে। যুদ্ধ খেত্তর ছেড়ে কে পালায়! যারা পালায় তারা কাপুরুষ। বুকে বর্ম এঁটে মাথা গোঁজ করে তীরের ফলায় সব রুখে দিতে চেয়েছে কনকসুন্দরী। সে কেবল ভাতের জন্যই তো, বলো! এই ছ্যামড়া ছেমড়ির দল তার আর কী বুঝবি তোরা! মিনসে গত হলে, এক সূয্যে ভাত বরাদ্দ রইল একবার। একাদশীর দিনে কী যে কষ্ট! এসব তোরা বুজস না। তোরা ভাত খাইতে চাস না ক্যান কী জানি! তিতা বলো মিঠা বলো ভাতের যুগ্যি আর কে!

মনে মনে গজর গজর করে বুড়ি। সকলে জানে এসব। লোকে কি আর তা বলে তীর ছুড়তে ভুলে যায়? বলে, সগ্‌গে গেলে কে তোমায় ভাতের থালা সাজিয়ে দেবে দিদুন? মিঠুর দিদুন এ’কথায় সাড়া করে না। লোকে ভাবে বুড়ি বুঝি কানে খাটো। চার কুড়ি বয়স পেরোনো মানুষের এত ভাতের নোলা কী বাপু! এ বাড়ির মানুষের সে ভারী বিষ্ময়। যার তিন কূল গিয়ে এক কূলে ঠেকেছে তার কি এখন এমন খিদে মানায়! বুড়ি তবু বলবে, কেমন কচি কচি ছিম পাড়সে বিনু, নিম দে ছিম ভেজে দে তো বউ! পাকা কুলের অম্বলে চুমুক দিতে দিতে বুড়ি বলে উঠবেই, আহ্‌ কলজে খান জুড়ায় গেল রে। লোকে এসব শুনে মুখ ফিরিয়ে হাসি চাপবে। এমনটাই ঘটে তো রোজ! ওই চলেছে বুড়ির বড় নাতি। বুড়ি বলে, যাস কই? রুইদাস এ কথায় উত্তর করতে চায় না, বুড়ি কিন্তু ছাড়ে না। রুইদাস আর কী করে! ওকে তাই বেমক্কা বলতেই হয়! বলে, আছো ভালো। চিন্তা নেই পাতি নেই। পেটের চিন্তা নিয়েই তো আছো! যুদ্ধ বেঁধেছে। সে খবর রাখো? তেলের দাম বাড়বে এবারে। দেখি, খানিক যদি সূর্যমুখী লাগানো যায়। তোমায় বলেই বা আর কী! তুমি আর কী বুঝবে এসব! রুইদাস চলে গেলে বুড়ি খানিক গোঁজ হয়ে থাকে। বুকের বর্মখানা এঁটে নিয়ে এবার বুঝি যুদ্ধু খেত্তের মাঝখানতায় গিয়ে দাঁড়াবে বুড়ি। বলে, বুঝুম না ক্যান! তরা কি ভাবোস আমি খবর রাহি না! পিপলুর মাইয়্যা বোলসে তো আমারে। ফডো দেখাইসে। কী সুন্দর দ্যাশখান। ব্যাবাক আমাগো দ্যাশের লাখান। গমের খ্যাত তো না, সোনার গাঁও য্যান। উচা উচা উনানে গোল গোল রুটি বানায় কেমন! পিপলুর মাইয়্যা কইসে তো। আহা গো, তাগো রুটির গন্ধ বুজি ভাতের গন্ধের মতো মিডা। যুদ্ধু হইলে মাইনসে খাইবো কী! আমাগো দ্যাশ তো তরা দ্যাখোস নাই। রূপশাইলের ভাত দিয়া ফলুই মাসের ঝোল খাইতে বড় সুখ রে। যুদ্ধু হইলে, মাইনসে খাইবো কী! পোলাপানেরা করবো কী! মাইনসের খিদা তো লাগবো! তরা ভাবিস সুয্যুমুখির কথা, আমি ভাবি গরম রুটির কথা। রিফিউজি মাইনসের খিদার তরা কী জানোস?

আচার আগলানো কনকসুন্দরী একা একা এমন করে কথার মধ্যে ডুবে যান একেকদিন। বুকের বর্মখনা বুঝি আজ খুলে রেখেছেন তিনি। একেকদিন আর যুদ্ধ করতে ভালো লাগে না ওর। বউ বলে, ভাত নামাইসি। খাইবা না? বুড়ি বলে তরা খা, খিদা নাই। বুড়ির বউ এ কথায় হাসে না। মিষ্টি রে ডাক পাঠায়। কয়, বুড়া মানুষরে ওসব ফডো দ্যাখাস ক্যান? বুড়া মানুষ কষ্ট পায়, বুজিস না! মিষ্টি আসলেই অত বোঝে না। কনকসুন্দরী বসে আছেন ওই। একা। ভাতের খিদেখানা পাশে নামিয়ে রেখেছেন বুঝি আজ। বর্ম আর তীরখানাও তো। যুদ্ধক্লান্ত মানুষের কি খিদে পেতে আছে?

More Articles