বাংলার নিজস্ব সিন্ড্রেলার ক্যাসল রয়েছে এখানে, পুজোর ছুটির ঠিকানা 'প্রাসাদ গ্রাম' ধান্যকুড়িয়া

Dhanyakuria Village Tour: পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়িকে লোকে ধান্যকুড়িয়ার ক্যাসল বলে চেনে। এটি আসলে বিদেশি দূর্গের আদলে তৈরি একটা বাগানবাড়ি।

পুজো সমাগত, আর পুজো মানেই ছুটি, খাওয়া দাওয়া আর চুটিয়ে আড্ডা মারা। পুজো শেষ হয়ে গেলেও এই বছর দু’তিনদিনের বাড়তি ছুটি আছে। এই সময়টা বাঙালি কাছে-দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে না, তা হয়? ভ্রমণ বাঙালির নেশা। সময় পেলেই অবাধ্য মন বেরিয়ে পড়তে চায় ইতিহাসের টানে, রূপকথার রাজ্যে। এই রকমই এক রূপকথার গ্রাম ধান্যকুড়িয়া। সিন্ড্রেলা, ডিজনি ওয়ার্ল্ড দেখে ছোটবেলায় যারা বড় হয়েছে তাদের শৈশব জুড়ে রয়েছে সেইসব রূপকথার রাজ্য। বিশেষ করে সিন্ড্রেলার সেই আইকনিক ক্যাসেল যেন চোখ বুজলেই আমাদের স্বপ্নের রাজ্যে পৌঁছে দেয়। আর ক্যাসেলের প্রবেশ পথে থাকা অতিকায় টুইন টাওয়ার! এই সমস্ত স্মৃতিচিহ্ন চাইলে পাওয়া যেতে পারে কলকাতারই খুব কাছে। একে এক কথায় বাংলার নিজস্ব সিন্ড্রেলার ক্যাসেল বলা যেতেই পারে। ধান্যকুড়িয়া ‘প্রাসাদ ঘেরা গ্রাম’ নামেও পরিচিত। নানা রকম দুর্লভ স্থাপত্যের অদ্ভুত সব কারুকার্য নিয়ে এই গ্রামে অপেক্ষা করছে রূপকথার মতো প্রাসাদ।

বাংলা এবং ঔপনিবেশিক স্থাপত্যকলার সর্বশ্রেষ্ঠ কিছু নিদর্শন লুকিয়ে আছে এখানে। প্রাক-স্বাধীনতাকালে বাংলার বহু জমিদার এবং বাবুদের গথিক শৈলীতে নির্মিত প্রাসাদোপম নানা বাড়ির ঠিকানা এখনও কিন্তু এই ধান্যকুড়িয়া। গ্রামবাংলার পথঘাট দিয়ে যাওয়ার সময় ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া যায় না যে এমন একটি গ্রাম চোখের সামনেই লুকিয়ে আছে, যেখানে পড়ে আছে একের পর এক অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান স্থাপত্যের বিস্ময়।

পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়িকে লোকে ধান্যকুড়িয়ার ক্যাসল বলে চেনে। এটি আসলে বিদেশি দূর্গের আদলে তৈরি একটা বাগানবাড়ি। ধান্যকুড়িয়ার বাড়িটি ধুঁকছে, কিন্তু এখনও আভিজাত্য বজায় রেখে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এই প্রাসাদ। প্রোমোটারের হাতুড়ির ঘা এখনও তার শরীরে পড়েনি। ওই ক্যাসেল ছাড়া ধান্যকুড়িয়াতে আরও অনেক সুদৃশ্য জমিদার বাড়ি রয়েছে, যেগুলো দেখতে অনেকেই আসেন। বাড়িগুলোর অবস্থা বেশ ভালোই। কয়েকটাতে লোকও বসবাস করে, অন্যগুলোতে পুজো পার্বণে বাড়ির মালিকরা বেড়াতে আসেন।

 

ধান্যকুড়িয়া রাজবাড়ি দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে শিয়ালদা হাসনাবাদ লাইনের ‘কাঁকড়া মির্জানগর’ স্টেশনে। দু’ধারে দিগন্ত পর্যন্ত ধানক্ষেত, প্ল্যাটফর্মে জনাকয়েক লোক, বাতাসে গ্রাম্য সুগন্ধ। এই লোকালয়টির নাম মির্জানগর। এখানে রাজবাড়ি কিন্তু একটা নেই, আছে তিনটি, গায়েনদের, বল্লভদের ও সাউদের। প্রধানত লোকজন গায়েনদের রাজবাড়িটিই দেখতে আসে দূর দূরান্ত থেকে।

আরও পড়ুন- বাগানের মাটিতে শিশুকন্যার অলীক পায়ের ছাপ! যেভাবে শুরু হল শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো

গায়েন রাজবাড়ি

রাস্তা জুড়ে বিশাল ফটক, দু’পাশে বৃত্তাকার স্তম্ভ। তার মাঝে ধনুকাকৃতি বিরাট ছাদ, যার মাথায় কোনও এক সাহেবের ছোরা দিয়ে সিংহ বধের মূর্তি। পুরো ভিক্টোরিয়ান গড়নে তৈরি এই রাজবাড়ি যেন স্বপ্নরাজ্য। ধান্যকুড়িয়ার সবচেয়ে প্রাচীন গায়েন বাড়ির ফটক দিয়ে প্রবেশ করলেই প্রকাণ্ড এক রাজবাড়ি, তবে রাজবাড়ির থেকে দুর্গ বলা ভালো। প্রায় ৩০ একর জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাজবাড়ির মধ্যে রয়েছে একটা আস্ত পুকুর, যার মধ্যে রাজবাড়ির ছবি ঝলমল করছে। গোটা দুর্গকে ঘিরে আছে সুবিশাল বাগান।

দুর্গের ভিতরে বিভিন্ন ধরনের ভিক্টোরিয়ান কারুকাজ থেকে শুরু করে রয়েছে ইতালিয় কাঁচের তৈরি আসবাব যা দেখলে চোখ ধাঁধিয়ে যেতে বাধ্য। বাড়ির ডিজাইন ইউরোপীয় মধ্যযুগের দুর্গ থেকে অনুপ্রাণিত।

খাঁজকাটা দেওয়াল ঘেরা ছাদ যার পূর্বদিকে একটা টারেট বা ক্ষুদ্রাকৃতি গম্বুজ এখনও বর্তমান। ছাদের পশ্চিমদিকে মনে হয় কোনওকালে ঘড়ি ছিল। দেওয়ালে দুটো ফাঁকা গোলাকার আকৃতি চোখে পড়ে। একটি দক্ষিণমুখী, অন্যটি পশ্চিমদিকে রয়েছে। দু’টি আকৃতির নিচে একটি করে গায়েন বংশের পরিচায়ক চিহ্ন দেওয়ালে খোদাই করা আছে। সে সময়ের জমিদারেরা ব্রিটিশদের অনুকরণে নিজেদের পরিচায়ক চিহ্ন তৈরি করতেন। বাড়িটির পূর্ব দিকের দিকের দেওয়ালেও এইরকম চিহ্ন রয়েছে।

 

রাজবাড়ির পাশেই শ্যামসুন্দর জিউর মন্দির। বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে একটি সুদৃশ্য তিনতলা মিনার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এর নাম নজর মিনার। এটির স্থাপত্য শৈলী মিশ্র প্রকৃতির। প্রথম দু’টি তলা কোরিন্থিয়ান থাম (গ্রিক স্থাপত্য রীতি) সমেত ইউরোপিয়ান স্থাপত্যের ওপর ভিত্তি করে, কিন্তু তিন তলাটা ইসলামীয় ধাঁচে নিৰ্মিত। এমনকি গম্বুজটাও পুরোপুরি ইসলামীয় স্থাপত্যের উদাহরণ।

রাজা আর রাজ্যপাট কোনওটাই আজ আর আগের মতো নেই। সুপ্রাচীন জমিদার বাড়িগুলি একে একে চলে আসছে সরকারি নিয়ন্ত্রণে। কলকাতা থেকে একটু দূরেই উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় অবস্থিত ধান্যকুড়িয়ায় আজও তার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে ইতালিয়ান স্থাপত্যের জমিদার বাড়ি, যা ইতিমধ্যেই নথিভুক্ত হয়েছে রাজ্যের পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। তবে এ গ্রামে যেটা সবচেয়ে পুরনো তা হল প্রায় ২০০ বছরের পাটের ব্যবসা। গায়েন বাড়ির পাটের ব্যবসা সেকালের নিদর্শন বলা যেতে পারে।

গায়েন বাড়ির ইতিহাস জানতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় আড়াইশো বছর আগে। ইতিহাস অনুযায়ী, আজ থেকে প্রায় ২৫০ বছর আগে জমিদার মহেন্দ্রনাথ গায়েন তৈরি করিয়েছিলেন এই রাজবাড়ি। সেই থেকে এ বাড়ি গায়েন বাড়ি নামে পরিচিত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য সে সময়ে রাজবাড়ির জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ। জমিদারদের সঙ্গে সাহেবদের সম্পর্ক ভীষণ ঘনিষ্ঠ না হলেও শত্রুতা ছিল না। রাজবাড়ির পাটের ব্যবসা তাই চলত রমরমিয়ে। মূলত ইংরেজদের সঙ্গেই চলত লেনদেন, যার ফলে ব্যবসা বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছিল। আর বলাই বাহুল্য, এ সমস্ত কারণে উত্তর চব্বিশ পরগনার এই প্রান্তে লেগে থাকত সাহেবদের আনাগোনা।

সাউ রাজবাড়ি

গায়েন বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা মিনিট দু’য়েক হাঁটলেই ডান দিকে আরেকটা বাড়ি চোখে পড়ে। সাদা রঙের এই বাড়ির বাইরেটা গায়েন বাড়ির মতো ঝাঁ চকচকে না হলেও এর জানালার উপর স্টাকোর কাজ বেশ আকর্ষণীয়। জানালাগুলোও বেশ বাহারি। সবকটাতেই সাবেক আমলের খড়খড়ি আছে। এ বাড়িও প্রায় দু’শো বছরের পুরোনো। এটিই হল সাউ বাড়ি।

এই বংশের পতিত পাবন সাউ এ বাড়ি তৈরি করেন। এখন এ বাড়িতে সাউ পরিবারের কেউ থাকেন না। বর্তমান প্রজন্মের অশোক সাউ কলকাতায় থাকেন। সাউ বাড়ি দেখাশোনা করেন একজন কেয়ারটেকার। চারধারে কোরিন্থিয়ান থাম দিয়ে সাজানো মাঝের বড় উঠোনটি দেখার মতো। পুরনো বাংলার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল পরিবারগুলোর মতো সাউ ম্যানসনেও আছে থাম দিয়ে ঘেরা ঠাকুরদালান এবং নাটমন্দির। এতদিন পরেও এই অংশ দু’টি কিন্তু বেশ ভালভাবেই আছে। স্থানীয়রা জানালেন, প্রতি বছর দুর্গাপুজোর সময় এখানে পুজো হয় এবং সাউ বংশের প্রাচীন এবং নবীন প্রজন্ম এই সময়ে এক ছাদের তলায় সকলে জড়ো হন।

বল্লভ বাড়ি

সাউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হেঁটে তেমাথায় নেতাজির একটি মূর্তি আছে সেখান থেকে ডান দিকে মিনিট দু’য়েক হাঁটলেই বাঁদিকে পড়বে বল্লভদের বাড়ি। সবুজে সাদায় রঙ করা এই বাড়িটি এখনও যত্ন সহকারে সংরক্ষিত। বল্লভদের বাড়ির প্রাক্তন প্রজন্মরা জুটের ব্যবসায় প্রচুর লাভবান হয়েছিলেন। বাড়ির ছাদের প্রতি কোণে একটি করে ইউরোপীয় স্ট্যাচু দেখা যায়। ঢোকার ঠিক মুখে, উপরদিকে আছে মাথায় মুকুট পরা সম্ভবত কোনও ইউরোপীয় রাজার মূর্তি, তার দু’পাশে দু’জন এশীয় ব্যক্তি। সম্ভবত ব্রিটিশ রাজের প্রতি বাংলার জমিদারদের আনুগত্য দেখানোর জন্যেই এই মূর্তির উপস্থাপনা। এই সমস্ত মূর্তিগুলোর জন্যে বাড়িটিকে পুতুলবাড়িও বলা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুন- এভারেস্টের চেয়ে খাটো, তবু আজও কেন ‘অজেয়’ কৈলাস, রহস্যে মোড়া শিব ঠাকুরের আপন দেশ!

বল্লভদের বাড়ির এক তলায় সারি দিয়ে বেশ কিছু ভগ্নপ্রায় ঘর আছে পরপর, যা মূল বাড়িটির সঙ্গে একেবারেই বেমানান। হয়তো আগে ঘরগুলো চাকরদের থাকার জন্যে ব্যবহার করা হত। জমিটির বাঁ দিকের অংশটি তুলনামূলক ভাবে আরেকটু অনাদরে পড়ে রয়েছে।

বল্লভ বাড়ি থেকে আরও মিনিট দু’য়েক হাঁটলেই রাস্তার ডানদিকে একটা সাদা রংয়ের সুবিশাল দোতলা নবরত্ন রাসমঞ্চ চোখে পড়বে। রাসমঞ্চের চারিদিকে পাঁচ খিলানের প্রবেশ পথ রয়েছে। শুরুর দিকে এ অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্মের প্রভাব ছিল। কালের হাতছানি উপেক্ষা করে এটি এখনও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধান্যকুড়িয়ার স্থাপত্যগুলি আজ ধ্বংসের মুখে৷ এই স্থাপত্যগুলির দ্রুত রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন। ধান্যকুড়িয়াকে ঘিরে নজরকাড়া এক পর্যটন কেন্দ্র গড়ে উঠতে পারে৷ স্থাপত্যগুলির নান্দনিক ছোঁয়া এই গ্রামে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের বারেবারে ছুটে আসতে বাধ্য করে৷ কলকাতার কাছে এমন প্রাসাদ ঘেরা গ্রাম খুবই দুর্লভ। ইতিহাস, স্থাপত্য বা গ্রাম বাংলার রূপ স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছে থাকলে যে কোনও দিন ঘুরে আসতে পারেন ধান্যকুড়িয়া থেকে। বাংলার বণিকদের জৌলুস, জাঁকজমক আমরা কোনওদিন স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করা হয়নি ঠিকই তবে তাঁদের সম্পত্তি হয় ভূলুণ্ঠিত হয়ে মাটিতে মিশে গেছে, না হয় আমাদের স্মৃতিতে বিরাজ করছে।

কীভাবে যাবেন- ট্রেনে শিয়ালদহ থেকে হাসনাবাদগামী ট্রেনে কাঁকড়া মির্জানগর স্টেশন। তারপর সেখান থেকে অটো রিজার্ভ করে ধান্যকুড়িয়া। বাসে যেতে চাইলে বারাসাত বাসস্ট্যান্ড থেকে বসিরহাটগামী বাসে ধান্যকুড়িয়া স্টপেজ।

More Articles