‘মুসলিম বন্ধুদের মধ্যেই বড় হয়েছি!’ মনোনয়ন জমা দিয়েই কেন পাল্টি মোদির?
Lok Sabha Election 2024: দু'দিন আগেই বেনারসে গিয়ে মনোনয়ন জমা দিয়ে এসেছেন নরেন্দ্র মোদি। তার পর থেকে মোদির একাধিক আবেগপ্রবণ ভিডিও ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। ভোট যত এগোচ্ছে, ততই যেন সুর বদলাচ্ছে মোদির।
ভোট আসার মুখে মুখেই সিএএ আইন কার্যকর করার কথা ঘোষণা করেছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। যা নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল দেশের বড় অংশ। তার পর ভোট যত এগিয়েছে, ততই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সুর চড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁকে যথাযোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন সেনাপতি তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। কখনও সংখ্যালঘুদের ঘুসপেটিয়া বলে তোপ দেগেছেন মোদি, কখনও আবার বেশি সন্তান সংখ্যার কথা বলে আক্রমণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ছেড়ে কথা বলেননি অমিত শাহও।
কংগ্রেসকে তাদের ইস্তেহারে ঘোষণা করেছে, তারা ক্ষমতায় এলে ভারতে অতিধনীদের সম্পত্তির একাংশের পুনর্বণ্টন করা হবে। সে বিষয়টিকে হাতিয়ার করে কংগ্রেসের প্রতি আক্রমণ শানিয়েছে বিজেপি। জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে হিন্দুদের থেকে সোনাদানা, মঙ্গলসূত্র, সম্পত্তি ছিনিয়ে নিয়ে তাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে চাইছে, যাদের প্রচুর সন্তান। বুঝতে অসুবিধা হয়নি, মোদির নিশানায় আসলে কারা?
আরও পড়ুন: বাড়ি নেই, গাড়ি নেই, জমি নেই, ঠিক কতটা ‘গরিব’ দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি?
দু'দিন আগেই বেনারসে গিয়ে মনোনয়ন জমা দিয়ে এসেছেন নরেন্দ্র মোদি। তার পর থেকে মোদির একাধিক আবেগপ্রবণ ভিডিও ভাইরাল সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। ভোট যত এগোচ্ছে, ততই যেন সুর বদলাচ্ছে মোদির। মুসলিমদের এতদিন যাবৎ 'ঘুসপেটিয়া', 'অনুপ্রবেশকারী' বলে তোপ দাগলেও এবার সেই অবস্থান থেকে একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে গেলেন মোদি। বললেন, 'বেশি সন্তান' বলতে মোটেও শুধুমাত্র মুসলিমদের বোঝাতে চাননি মোদি। বরং তিনি প্রতিটি দারিদ্র পরিবারের কথা তুলে ধরতে চেয়েছেন। এখানেই শেষ নয়, আরও এক ধাপ এগিয়ে মোদি বলেন, যেদিন থেকে তিনি হিন্দু-মুসলিম ভাগ করা শুরু করবেন, সেদিন থেকে তিনি আর বাইরের জীবন যাপন করার যোগ্য থাকবেন না।
২০২৪ সালে লোকসভা ভোট। সেই ভোটকে পাখির চোখ করেই গোড়া থেকেই সমস্ত কর্মসূচী সাজিয়েছিল বিজেপি। রামমন্দির নির্মাণ থেকে শুরু করে উদ্বোধনের এলাহি অনুষ্ঠান, সবেতেই পাখির চোখ ছিল লোকসভা ভোট। আর সেই ভোটপ্রচারে নেমে বারবারই হিন্দুভোটব্যাঙ্ককে নিজেদের দিকে টানতে চেয়েছে বিজেপি। তার জন্য কোনও কসুরই বাকি রাখেনি তারা। তবে এতদিন বাদে মোদি বলছেন, তিনি নাকি ভোট ব্যাঙ্কের দিকে চেয়ে কাজ করেন না। 'সবকা সাথ, সবকা বিকাশে'ই বেশি আস্থা তাঁর। ফলে ভোটব্যাঙ্ক টানার জন্য় মুসলিমদের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তুলছেন, এমন কোনও ব্যাপার নাকি আদতেই নেই।
রাজস্থান থেকে শুরু করে বাংলা, একাধিক জায়গা গিয়ে সিএএ, এনআরসি নিয়ে হুমকি দিয়ে গিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। একই সুর বারবার শোনা গিয়েছে দেশের প্রধানমন্ত্রীর গলাতেও। একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে কীভাবে মোদি সেই দেশেরই সংখ্যালঘু বাসিন্দাদের বারবার নিশানা করতে পারেন, সে নিয়ে নির্বাচন কমিশনে জমা পড়ে একাধিক অভিযোগও। সে নিয়ে নির্বাচন কমিশন অবশ্য তেমন কোনও পদক্ষেপ করার কথা ভাবেনি এখনও।
গত কয়েকদিন ধরেই মোদি বারবার অসংলগ্ন হচ্ছেন। যে আদানি-আম্বানিদের সঙ্গে মোদি-ঘনিষ্ঠতার চর্চা গোটা দেশ জুড়ে, সেই অম্বানি-আদানিদের তিনি জুড়ে দিতে চাইছেন কংগ্রেসের সঙ্গে। বলছেন, তাদের থেকে ঘুষ নিয়েই নাকি আদানি-অম্বানির মতো শিল্পপতিকে আক্রমণ করা থামিয়েছে কংগ্রেস। এবার যে সংখ্যালঘুদের নিশানা করে এতদিন হিন্দুভোট পকেটে পুরবার চেষ্টা করেছেন, সেই মোদি কেন সুর বদলাচ্ছেন তাঁর কেন্দ্রে ভোটের ঠিক আগে আগেই।
সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারে মোদি জানান, "আমি হতবাক। কে আপনাদের বলেছে যে যখনই কেউ বেশি সন্তানদের নিয়ে কথা বলে, তারা মুসলিমদের কথাই বলছে? কীভাবে আপনারা মুসলিমদের প্রতি এমন অবিচারী হতে পারেন? দরিদ্র পরিবারগুলিরও তো এখন একই অবস্থা। যেখানে গরিবি আছে, সেখানেই দেখবেন শিশুদের সংখ্যা বেশি। সমস্ত জাতি-ধর্মের উর্ধ্বে উঠেই বলতে চাই, যে প্রতিটি নাগরিকেরই সেই সংখ্যক সন্তান ধারণ করা উচিত, যত জনকে তারা ভালো ভাবে মানুষ করতে করতে পারবে। এমন কোনও পরিস্থিতি আসতে দেবেন না, যাতে সরকারকে আপনার সন্তানের দায়িত্ব নিতে হয়।"
গোধরা হিংসার পর থেকেই মুসলিমদের কাছে মোদির ভাবমূর্তি নষ্ট করে আসার চেষ্টা চলছে বলে দাবি করে আসছেন তিনি। তখন অবশ্য তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী। মোদি সম্প্রতি দাবি করেছেন, তিনি নাকি ছোট থেকেই মুসলিম প্রতিবেশীদের মাঝে বড় হয়েছেন। ছোটবেলায় তাঁর বাড়িতেও ইদ পালন হত। এমনকী ইদের দিন তাঁর বাড়িতে হাঁড়ি চড়ত না। খাবার দাবার আসত মুসলিম বন্ধুদের বাড়ি থেকে। মোদির কথায়, "মহরমের সময় তাঁকে শেখানো হয়েছিল, কাজিয়ার সঙ্গে হেঁটে আসতে।" তেমনই একটি পরিবেশে বড় হয়েছেন তিনি। তাঁর অসংখ্য বন্ধুবান্ধব মুসলিম। অথচ ২০০২ সালে গোধরা কাণ্ডের পর থেকে তাকে মুসলিমবিরোধী হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করে চলেছে বিজেপি। মোদি জানিয়েছেন, তিনি দেশের মুসলিমদের তাঁকে ভোট দিতে বলছেন না। কারণ তিনি জানেন গোটা দেশ তাঁকে ভোট দেবে।
আরও পড়ুন: ভণ্ড সেনা প্রেম! ইজরায়েলের হাতে ভারতীয় কর্নেলের মৃত্যুতে কেন মুখে কুলুপ মোদির?
কিন্তু লোকসভা ভোটের শেষ পর্যায়ে এসে কেন এমন ভোলবদল মোদির? বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছে, এসবের নেপথ্যে আসল কারণ ভোটবাক্স। আগামী ১ জুন বারাণসীতে ভোট। আর সেদিনই অগ্নিপরীক্ষা মোদির। আর বারাণসীতে যে শুধু হিন্দু ভোটের উপর ভরসা করে ভোটদরিয়া পার হওয়া যাবে না, তা ভালোই বুঝতে পেরেছেন প্রধানমন্ত্রী। বারাণসীর মোট ভোটের প্রায় ১৪ শতাংশ জুড়ে রয়েছে মুসলিম ভোট। সেই ভোটটুকু যাতে মোদির সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তির নিচে গলে বেরিয়ে না যায়, তা নিয়ে নিশ্চিত হতেই শেষ লগ্নে বয়ান বদলাচ্ছেন মোদি। তবে সত্যিই কি চিঁড়ে ভিজবে তাতে? এতদিন ধরে মোদির কাছ থেকে যে অপমান, অসম্মান সহ্য করতে হয়েছে এ দেশের সংখ্যালঘুদের, সেই সমস্ত কিছু ভুলে ফের মোদিতেই ফিরবে মুসলিম ভোট? উত্তর মিলবে ৪ জুন।