মুঠোফোনেই দুনিয়া, প্রযুক্তির গ্রাসে কতটা ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ
Digitisation and Environment: পরিবেশের ওপর ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব বেশ উদ্বেগজনক।
আমাদের মুঠোফোন বা কম্পিউটার এখন ‘সব পেয়েছির দেশ’। ডিজিটাল যুগের এটাই হকিকত্। কাজকর্ম, পড়াশোনা, ঘুরতে যাওয়া, খাওয়া-দাওয়া, কেনাকাটা, সিনেমা দেখা- সবেতেই আমরা ইন্টারনেটের মুখাপেক্ষী। এছাড়াও আছে রকমারি সোশ্যাল মিডিয়ার হাতছানি। এ তো নয় গেল আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহার। তা বাদ দিলেও, পৃথিবীজোড়া ইন্ডাস্ট্রি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি-বেসরকারি পরিষেবা, সবেতেই ডিজিটাল প্রযুক্তি অনিবার্য। আর ডিজিটাইজেশন মানেই গাদা গাদা তথ্য, তথ্যের মহাসমুদ্র। এই যে সোশ্যাল মিডিয়ায়, ইন্টারনেটে এত তথ্য- সেগুলো যায় কোথায়? সবটাই কি ভার্চুয়াল, অর্থাৎ পৃথিবীতে তাদের কোনও অস্তিত্ব নেই?
ব্যাপারখানা আমরা যতই ভার্চুয়াল বা অপার্থিব জগৎ হিসেবে ভাবি, বাস্তবে ছবিটা একেবারেই আলাদা। যে-কোনও ধরনের ডিজিটাল মিডিয়া, সার্চ ইঞ্জিন অথবা ইন্টারনেটে আমরা যে সমস্ত তথ্য আদান-প্রদান করি, সেই কাজ সম্পন্ন হয় ডেটা সেন্টার বা তথ্যভান্ডারের মধ্য দিয়ে। ইন্টারনেটের যাবতীয় তথ্য জমাও থাকে ওই ডেটা সেন্টার-এ। এই ডেটা সেন্টারগুলিতে কয়েক লক্ষ কম্পিউটার প্রসেসর অর্থাৎ কম্পিউটার চালনাকারী মূল যন্ত্রাংশ থরে থরে সাজানো থাকে। এই প্রসেসরগুলি সাধারণ কম্পিউটার বা ল্যাপটপের থেকে কয়েক লক্ষ গুণ উচ্চশক্তিসম্পন্ন এবং তারা অহর্নিশ কাজ করে।
এই কাজের জন্য বহুল পরিমাণে বৈদ্যুতিক শক্তির দরকার হয়। এছাড়াও, এই ক্ষমতাশালী যন্ত্রগুলিতে কাজের ফলে প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন হয়। সেই কারণে তাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় অতিরিক্ত বিদ্যুতের জোগান প্রয়োজন। বর্তমানে পৃথিবীর সবথেকে বড় ডেটা হলো সেন্টার চায়না টেলিকম-ইনার মঙ্গোলিয়া ইনফরমেশন পার্ক যার আয়তন ১০,৭৬৩,৯১০ স্কোয়ারফিট। অর্থাৎ, মধ্যবিত্ত একটি ফ্ল্যাট বা বাড়ির হাজার গুণ জায়গা নিয়ে রয়েছে এই ডেটা সেন্টার। এই ডেটা সেন্টারটির বৈদ্যুতিক ক্ষমতা ১৫০ মেগাওয়াট, যা আমাদের ব্যবহারিক ১০ ওয়াটের একটি বাল্বের লক্ষ গুণ বেশি। এই তথ্যগুলো থেকে আমরা আন্দাজ করতে পারি যে, একটি ডেটা সেন্টারের আয়তন এবং সেখানে ব্যবহৃত বিদ্যুতের পরিমাণ কতটা বিপুল হতে পারে।
আরও পড়ুন: মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা বিপদ এড়াল নাসা-র অস্ত্র! যেভাবে বিলুপ্তি থেকে বাঁচল মানুষ
আমাদের দেশের ছবিটাও আলাদা নয়। ‘Financial Express’-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী ভারতে মোট ডেটা সেন্টারের সংখ্যা ১৩৮টি এবং ২০২৫-এ সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়াবে ১৮৩। একটি বাণিজ্যিক আবাসন সম্পর্কে পরামর্শদাতা কোম্পানি JLL-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২১ সালে ভারতে ডেটা সেন্টারগুলি দ্বারা ব্যবহৃত মোট বৈদ্যুতিক ক্ষমতা ৫৬৫ মেগাওয়াট। ওই রিপোর্টে আরও জানানো হয় যে, ২০২৪ সালে এই বৈদ্যুতিক ক্ষমতা হবে ১,৩৬৯ মেগাওয়াট। এর সঙ্গে যদি আমরা আমাদের ব্যক্তিগত কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট ব্যবস্থার পরিকাঠামো-সহ সামগ্রিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবস্থার চিত্রটিকে দেখি, তবে দেখা যাবে যে, এই বৈদ্যুতিক চাহিদা আরও কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে।
ডেটা সেন্টার তথা সমগ্র ডিজিটাল প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের জোগান মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির (কয়লা বা পেট্রোলিয়াম) ওপর নির্ভরশীল। এর ফলস্বরূপ, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে ব্যাপক হারে কার্বন (কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস) নিঃসৃত হচ্ছে। যা আদতে কার্বন নিঃসরণজনিত জলবায়ু পরিবর্তনের যে সমস্যা, তাকে ত্বরাণ্বিত করচ্ছে। সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত ‘The Hindu’-র একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালে সারা পৃথিবীতে জলবায়ু পরিবর্তন ও বিশ্ব-উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্যাসগুলির নিসঃরণের মোট পরিমাণের ৪% ঘটেছে শুধুমাত্র ডিজিটাইজেশনের কারণে। সাধারণত, বিমান পরিবহণ ব্যবস্থায় জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের দরুন বাতাসে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ সবথেকে বেশি। কিন্তু, উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে ডেটা সেন্টার কর্তৃক নিসৃঃত কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ, সমগ্র বিমান পরিবহণ ব্যবস্থা দ্বারা কার্বন নিঃসরণের পরিমাণকে ছাপিয়ে গেছে। তাই, তাই ডিজিটাইজেশন মানেই ঝকঝকে, পরিষ্কার সবুজ ও দূষণমুক্ত একটি ভবিষ্যতে ধারণা একেবারেই ভ্রান্ত। বরং, প্রথাগত কলকারখানা, পরিবহণ ব্যবস্থার মতোই ডিজিটাল প্রযুক্তি বিশ্ব উষ্ণায়ণের জন্য দায়ী।
যদিও এই সমস্যার সমাধান হিসেবে এখন অনেক তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা এবং ডেটা সেন্টারগুলি পুনর্বীকরণযোগ্য শক্তির উৎস থেকে তৈরি বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়াচ্ছে, অথবা কার্বন নিঃসরণ প্রশমনে অন্যান্য পদ্ধতির সাহায্য নিচ্ছে। তবে, ক্রমবর্ধমান ‘ডিজিটাইজেশন’-এর সঙ্গে এই ধরনের বিদ্যুতের জোগান এখনও পাল্লা দিতে অক্ষম। এই ব্যর্থতা হয়তো ভবিষ্যতে মানবসভ্যতাকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ তৈরির দিকেই ঠেলে দেবে। ডেটা সেন্টার ও ডিজিটাল প্রযুক্তি-সংক্রান্ত বৈদ্যুতিক পরিকাঠামোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অন্যদিকে, পরিবেশের ওপর ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রভাব বেশ উদ্বেগজনক। তাই বিষয়টির মূল্যায়ন অত্যন্ত সময়োচিত। নাহলে, ডিজিটাল প্রযুক্তি পরিবেশ রক্ষার অন্তরায় হয়ে উঠবেই।