বাজার আগুন, বুকিংয়ের চাপ! যেভাবে পুজো কাটে গাড়িচালকদের
Durgapuja of Drivers: উৎসব উদযাপন বলতে 'ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া' টুকুই। পেট আর ঠাকুর দর্শনের মধ্যে কার টান বেশি তা বোঝাই যাচ্ছে।
এক সারথির অঙ্গুলিহেলনে মহাভারতের যুদ্ধ পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে, জরাসন্ধ চিরে ফেলেন ভিম, কর্ণে বেঁচে যান অর্জুন। অপরদিকে সূতপুত্র বলে কর্ণের কী করুণ পরিণতি। জন্ম দিয়ে দেবতা তাঁকে স্বীকার করেন না। কবজ কুণ্ডল দিয়ে কাজ সারেন। কিন্তু আজীবন অপমানের জ্বালা সহ্য করার ক্ষমতা সেই কবজের ছিল কি? গুরুর জন্য বিষাক্ত কীটের দংশন যিনি সহ্য করতে পারেন, অপমানে তাঁর অমন রুদ্ররূপ দেখা যেত কেন? এ প্রশ্ন দেবতা নিজেকে করেছেন কখনও? কুন্তী ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন, কিন্তু আবার লজ্জার মাথা খেয়ে ভিক্ষাও চেয়েছেন। এই দু'জনের একজনেরও ক্ষমতা ছিল না ভরা সভায় বা ক্রীড়াঙ্গনে যখন অপমানের পর অপমান সইতে হচ্ছে ছেলেটিকে, তখন তাঁর মাথায়, কাঁধে স্নেহের হাত বুলিয়ে দেন। ক্ষমতা ছিল না স্বীকৃতির। অপরদিকে যে মানুষেরা পিটুলিগোলা খাইয়ে কত কষ্টে সন্তানকে পালন করলেন, তাঁদের নামোচ্চারণে কী বিষম ঘৃণা কুরুকুলের, পাণ্ডবদের, রাজরাজড়াদের, গুরুদের। সতীত্বের ভয়ে সন্তান বিসর্জন দিতে তাদের বাধে না। বাধে সারথির ছেলেকে সমমর্যাদা দিতে। যুদ্ধে রথের চাকা বসে গেলে তবেই কর্ণকে বধ করতে পারেন পৃথিবীশ্রেষ্ঠ বীর। কর্ণ গোটা মহাকাব্যে ক্ষমতায় আসীন হয়েও অপরায়িত হন। সারথিদের এই অদ্ভুত বোঝাপড়া এদেশে দীর্ঘদিন। তারই ছাপ বয়ে বেড়ায় কিংবদন্তি।
রাত বারোটায় পুজো দেখে ফিরছেন। "টোটো, অ্যাই টোটো"! হয়তো পঞ্চাশ টাকা ভাড়া চাইল। দেবেন না। কুড়ি টাকাই দেবেন। তার উপর ভিড়। তার উপর বৃষ্টি। রয়েছে রাস্তাবন্ধের জ্বালা। ঠাকুর দেখা, উৎসব, সন্তানসন্ততিকে ক্ষীরে বিরিয়ানিতে রাখা সবই হল ভদ্রবিত্তের। কিন্তু যারা দিনরাত এক করে সেই উদযাপনের ব্যবস্থা করে গেলেন, সেই সারথিরা আজও কি উপেক্ষিতই থাকবেন? নাকি তাঁরা কিঞ্চিৎ সুযোগ সুবিধা পান? পরিবার এবং জীবিকার মধ্যে কি উৎসব ছায়া ফেলে কোথাও? বাগবাজারের জয়ন্ত রক্ষিতের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল ইনস্ক্রিপ্টের পক্ষ থেকে। চারচাকা চালান। জানা গেল, পুজোতে দিনের বেলা একটু কম সময়ে বেশি ভাড়া খেটে পুষিয়ে নিয়েছেন, রাতেও খাটতে হয়েছে। তারই মাঝে সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পরিবারকে নিয়ে বেরিয়েছেন, ঠাকুর দেখিয়েছেন। বাজার করেছেন, ঘরের আরও দশরকম কাজ সামলেছেন। গত দু'বছরের থেকে এবারে ভালো কেটেছে। দৈনিক রোজগার একই রেখেছেন। মদ খেয়ে গাড়ি চালাতে পারবেন না বলে, খানিক সময় রেখেছেন আলাদা করে, আয়েশ করে মদ খেয়েছেন, আনন্দ করেছেন। মানুষের ভিড় ঘোরার সময় ভালো লাগে, কিন্তু গাড়িতে উঠলেই খুব অপছন্দ। রাতের বেলা বাইকে নিজের কন্যাটিকে নিয়ে বেরিয়েছিলেন। পাঁচটি ঠাকুর দেখাতে পাক্কা পাঁচ ঘণ্টা লেগেছে। সিঁথির প্রেমমন্দির থেকে শ্রীভূমি। রাত সাড়ে এগারোটায় বেরিয়ে ফিরেছেন ভোর পাঁচটায়। গাড়ি তাঁর নিজের। কাজেই তেমন চাপ নেই। নিজের একটি ফ্ল্যাটও রয়েছে। তবে পুজো কেটেছে, এবার শান্তিতে কাজ করতে পারবেন, খানিক শান্তি।
আরও পড়ুন- আর্তের পাশে দাঁড়ানোই ধর্ম: একান্তে মালবাজার বিপর্যয়ের ‘হিরো’ মহম্মদ মানিক
এ গেল শহর কলকাতার একজন ড্রাইভারের উদযাপন। ড্রাইভারের পুজো উদযাপন মানেই যে একেবারে বেচারা, উপেক্ষিত তা নয়। দেখা যাচ্ছে, কেউ কেউ প্রিভিলেজড। বিশেষত শহরে যাঁরা নিজের গাড়ি চালান। তাঁদের পুজো উদযাপনের অবকাশ রয়েছে। ভদ্রবিত্তের থেকে খাটনি একটু বেশিই। সমাজে 'গাড়ির ড্রাইভার' হিসেবে অপরায়ণ খানিক রয়েইছে, তবু এঁদের পুজো উদযাপন বেশ অন্যরকম।
এবার একটু অন্যদিকে চোখ ফেরানো যাক। ইনস্ক্রিপ্টের তরফ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছিল রূপনারয়াণপুরের অশোক বোসের সঙ্গেও। অশোকের বাড়ি সীমান্তপল্লী। অজয় এবং বরাকরের মাঝে একফালি উপত্যকা ঘিরে এককালে যেখানে গড়ে উঠেছিল চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ, হিন্দুস্তান কেবলসের মতো কারখানা, তার পাশের একটি শহরতলি সীমান্তপল্লী। এককালে গ্রাম ছিল, টুকটাক চাষ আবাদও ছিল। কারখানার ছোঁয়ায় দু'টি শিল্পনগরী গড়ে উঠল। একদিকে ডাবর কোলিয়ারি অন্যদিকে শিল্পনগরী— এদের ছোঁয়ায় চাষাবাস ঝরে গেল, বাজার ফুটল। অর্থনীতি পুরোপুরি এইসব নগরীর শ্রমিকদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। দেশের উন্নতির ঠেলায় আজ কেবলস্ বন্ধ। চিত্তরঞ্জন টিমটিম করছে। বাজার নেই, লোকজন নেই, নতুন প্রজন্ম কেউ থাকে না। সবাই রোজগারের আশায় বাইরে। এমন এক শ্মশানে টোটো চালান অশোক। বয়স বাহান্নর কাছাকাছি। আগে সবজি বিক্রি করতেন। সেই ব্যবসা করে কিছু টাকা জমিয়ে, কিছু ধারদেনায় একখানা টোটো কিনেছেন। পুজো কেমন কাটল তাঁর? জেনে নিই তাঁর বয়ানেই—
"পুজোটা এবার বড্ড তাড়াতাড়ি কেটে গেল। তার মধ্যে জল। জলটা হওয়ায় লোকের সমস্যা হয়েছে। আমাদের তো হয়েইছে। পুজোর সময় বাড়িতে তো আর বসে থাকতে পারি না। কাজেই জলের মধ্যেও টোটো বের করতে হয়েছে, কিন্তু তেমন খদ্দের ছিল না ওই দু'দিন। বাকি দুটো দিন রোজগার মোটামুটি ঠিকই হয়েছে। পুজোর সময় তো পরিচয় হিসেবেই চলে। সেই অনুযায়ী ঠিকই ছিল। কিন্তু রূপনারায়ণপুরের পুজো আর আগের মতোন নেই। কেবলস্ যাওয়ার পরে একেবারেই টিমটিম করে কটা পুজো। কিন্তু ভিড় হয়েছিল এবার।
আরও পড়ুন- শান্তির নোবেল পেলেন বেলারুশের জেলবন্দি! বেলেৎস্কির জয় কেন এত গুরুত্বপূর্ণ
পুজোয় পাবলিকের কথাই বেশি চিন্তা করতে হয়, নিজেদের আর দেখা হয় না। ঘোরা বলতে ওই পঞ্চমীর দিন যদি কেউ যায়, তাহলে দুটো ঠাকুর দেখি। তারপরের দিন থেকে লাইন পড়তে শুরু করে। সেই লাইনে তো আর ঢোকা সম্ভব না। পার্কিংয়ে তেমন সিকিওরিটি নেই। কাজেই গাড়িতেই থাকতে হয়। বাড়ির কাউকেই নিয়ে যেতে পারি না। এ নিয়ে অশান্তিও হয়, দশ রকম কথাও শুনতে হয়, কিন্তু কী করব বলো তো! একটা লোক টাকা দিয়ে টোটো বুক করেছে তাঁকে নিয়ে যাব না পরিবারকে ঠাকুর দেখতে নিয়ে যাব? তার উপর শুধু তো ঠাকুর দেখার ব্যাপার না, খরচা আছে। সেই খরচা জোগাড় করব কোত্থেকে? দু'দিন বৃষ্টিতে গেল। বাকি দু'দিনে আমাকে তো পুজোর একটু ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়ার পয়সাটাও তুলতে হবে। পুজোর মধ্যে বাঙালির একটু খরচা হয়ই! বাজারের যা অবস্থা। পটল চল্লিশ টাকা কিলো, ঝিঙা পঞ্চাশ, শশা আশি টাকা কেজি, টমেটো আশি টাকা কেজি, কাজেই বাজারের চিন্তাটা তো করতে হবে। পুজোর মধ্যে সেই পয়সাটা আমাকে রোজগার করতে হবে। রোজগারের বদলে খরচ বেড়ে গেলে না খেয়ে থাকতে হবে। কাজেই নিজের ঘোরাঘুরি বলতে কিছু হয় না পুজোতে।"
বললেন খুব স্বাভাবিক ভাবেই। ভদ্রবিত্তের গদগদ সেন্টিমেন্ট ছাড়া। বোঝাই যাচ্ছে এতে তিনি বেশ অভ্যস্ত। স্বপ্ন বলতে কিছু নেই। তাই মনখারাপ বলতেও কিছু নেই। উৎসব উদযাপন বলতে 'ঠিকঠাক খাওয়া-দাওয়া' টুকুই। পেট আর ঠাকুর দর্শনের মধ্যে কার টান বেশি তা বোঝাই যাচ্ছে। এবং দেখা যাচ্ছে এ যুগে সারথিদের পিঠের চামড়া বেশ মোটা। বাড়ির অশান্তি, দশ রকমের কথাটাও রোজগারের জন্য দিব্যি শরীরে ধারণ করার ক্ষমতা রাখেন। ক্ষত হয়তো হয়, টের পান না তেমন। বরং ভদ্রবিত্তের চোখের আরামের কারণে সেই সব ক্ষত বিভূতির তলায় ঢেকে তাঁদের ঠাকুর দেখিয়ে ফেরেন অশোক, এক উদগ্র শ্মাশানপুরীতে। যেখানে বাজার আগুন, কিন্তু রোজগারের উপায় দিনের দিন কমে আসছে। ছাইভস্মের আড়াল থেকে সেই সব মেহসুস না করা ক্ষত, পেট ও শখের দ্বন্দ্ব মেখে কিন্তু ঠায় তাকিয়ে থাকে আমার আপনার মতো সওয়ারির দিকেই।