সবচেয়ে বড় দুর্গা থেকে বুর্জ খলিফার লেজার শো! থিমের দাপটে বারবার ঘটেছে বিপর্যয়

Durgapuja 2022: এত বড় সত্যি থেকে বুর্জ খলিফা! পুজোয় চমক মানেই বিপর্যয়?

দেবীর বোধন হতে এখনও আরও কয়েকদিন বাকি। কিন্তু মানুষের উচ্ছাস বাঁধ মানছে না। দু'বছর পর সম্পূর্ণ বিধিনিষেধ তুলে দিয়ে পুজো হচ্ছে কল্লোলিনী তিলোত্তমায়। উপরন্তু এ-বছর দুর্গাপুজো ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের তকমা পেয়েছে, সুতরাং উচ্ছ্বাস তো একটু থাকবেই। মহালয়া থেকেই মানুষের মধ্যে ঠাকুর দেখার উৎসাহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ার মতো‌। তার মধ্যে অন্যতম সংযোজন শ্রীভূমির ভ্যাটিকান সিটি। সেই মহালয়ার আগের দিন থেকেই ভিড় উপচে পড়ছে শ্রীভূমি চত্বরে। দুর্গাপুজো নিয়ে মানুষের মধ্যে উন্মাদনা সারা বছর ধরেই লক্ষ করা যায়। পুজোর দিন যত এগিয়ে আসে, উন্মাদনা তত বাড়তে থাকে। আর বর্তমানে থিম পুজো মানুষের ঠাকুর দেখার ইচ্ছেকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। মোটামুটি মহালয়ার দিন থেকেই বাইরে চোখ রাখলে দেখতে পাবেন রাস্তায় মানুষের ঢল নেমেছে। তবে এসবের মাঝে আমাদের সকলের মাথায় রাখা উচিত সুরক্ষার কথা।

ইতিমধ্যেই শহরের একাধিক বড় পুজোর উদ্বোধন হয়ে গিয়েছে। যার অন্যতম আকর্ষণ অবশ্যই শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবের পুজোমণ্ডপ। প্রতি বছরই কিছু না কিছু আকর্ষণীয় কাজ করে দেখায় তারা, কখনও বাহুবলীর প্রাসাদ তো কখনও আবার বুর্জ খলিফা। গতবারের শ্রীভূমির বুর্জ খলিফা ভুলতে পারেননি অনেকেই। অমন উঁচু কাঠামোর ওপর অমন সুন্দর আলোর খেলা। কিন্তু এই পুজোর লেজার শোয়ের জন্য বিমান চলাচল ব্যাহত হয়েছিল কলকাতায়। আকাশপথে যতটা না অসুবিধে হয়েছিল, তার চেয়েও বেশি অসুবিধে হয়েছিল ভিআইপি রোডে। পঞ্চমী-ষষ্ঠী থেকে শুরু করে সেই জনজোয়ার সামলানো মুশকিল হয়ে পড়েছিল পুলিশের পক্ষে। ফলত লেকটাউনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ট্রাফিকে আটকে পড়েছিলেন অনেকে। এবার আবার শ্রীভূমির সুবর্ণজয়ন্তী। সেই উপলক্ষে শহরের বুকে ভ্যাটিকান সিটি তৈরি করেছে তারা। উত্তেজনা এবার আগের থেকেও বেশি। এখন সকাল-সন্ধে নির্বিশেষে মানুষ লেকটাউনমুখী। মহালয়া থেকেই দেখা যাচ্ছে দুপুরের পর থেকেই ভ্যাটিকান সিটির দোরগোড়ায় উপচে পড়ে ভিড়। সন্ধে ঘনিয়ে আসতেই সেই সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। যদিও মুখ্যমন্ত্রী শ্রীভূমির পৃষ্ঠপোষক তথা রাজ্যের দমকল মন্ত্রী সুজিত বসুকে কড়া নির্দেশ দিয়েছেন, যেন রাস্তা আটকানো না হয়। কিন্তু পুজোর প্রত্যেকদিন রেকর্ড গড়ছে শহরের ভিড়। যানবাহনের তুলনায় মানুষের ভিড় বাড়ছে শহরের রাস্তায়। প্রশাসন কিংবা পুজো উদ্যক্তোরা বিশেষ ব্যবস্থা নিলেও তারা উৎসাহী জনতার কাছে অসহায়। জনপ্লাবনে আটকে পরছে ভিআইপি রোড এবং সংলগ্ন সার্ভিস রোড।

এই অতি উৎসাহ কতটা বিপজ্জনক হতে পারে কয়েক বছর আগেই তার সাক্ষী ছিলাম আমরা। অনেকেরই মনে আছে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গা’-র কথা। দেশপ্রিয় পার্কের সেই পুজো সেবার বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। সেবার পুজোর সেল শুরুর বহু আগেই গড়িয়াহাটের মোড় থেকে ইএম বাইপাস, টালি থেকে টালা ছেয়ে গেল ‘এত বড় সত্যি’-তে। পরে সামনে এল এই ‘বড় সত্যি’ আসলে দেশপ্রিয় পার্কের পুজোর থিম। ২০১৫ সালে দেশপ্রিয় পার্কের বহু-বিজ্ঞাপিত ৮৮ ফুট উঁচু প্রতিমাকে ঘিরে তৈরি হয় নজিরবিহীন উন্মাদনা। পুজো উদ্বোধনের পর পরিস্থিতি আরও অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। চতুর্থী থেকেই পার্কে ভিড় করেন হাজার হাজার মানুষ। পঞ্চমীর সন্ধ্যায় বাঁধনছাড়া ভিড়ে স্তব্ধ হয়ে যায় দক্ষিণ কলকাতার ট্রাফিক ব্যবস্থা, চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা তৈরি হয় দেশপ্রিয় পার্ক চত্বরে। সেবার শুধু শহরের মানুষই নন, দূর-দূরান্ত থেকে অন্য জেলার মানুষ-ও এসে মিশে যান এই মহানগরের ভিড়ে। সেবার বড় দুর্গার এক ঝলক দর্শনের ঠেলায় নাভিশ্বাস উঠে যায় সাধারণ মানুষের এবং তাদের সামলাতে কলকাতা পুলিশের। এর মধ্যেই খবর আসে, পদপিষ্ট হয়েছেন বেশ কিছু জন। এরপর লালবাজারের পুলিশ কর্তারা বাইরে থেকে প্রতিমা দর্শন বন্ধ করে দিয়েছিলেন ষষ্ঠীতেই। দেশপ্রিয় পার্কের অত বড় দুর্গার মূর্তি যাতে কোনও মতেই পার্কের বাইরে থেকেও না দেখা যায়, তা সুনিশ্চিত করেছিল কলকাতা পুলিশ। পার্কের চার দিকে ৩০ ফুটেরও বেশি নীল কাপড় দিয়ে মুড়ে ফেলা হয়, যাতে কোনও অবস্থাতেই উঁকিঝুঁকি মেরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্গা দেখতে পাওয়া না যায়। মানুষের এই অতিরিক্ত উৎসাহের কারণে শেষমেষ বঞ্চিত হলো দর্শনার্থীরাই।

আরও পড়ুন: সাবর্ণদের ৪১৩ বছরের দুর্গাপুজো! পোড়া ল্যাটা মাছের ভোগে আজও অমলিন দুর্গার আরাধনা

তবে মোটেও ভাববেন না এরকম উপচে পড়া ভিড় শুধু কলকাতাতেই হয় বা হচ্ছে। এ-বছর এরকমই ভিড় হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের আরও একটি জায়গায়, কল্যাণীর আইটিআই মোড়ে। ৩০ বছর পূর্তিতে এবার তাঁদের মূল আকর্ষণ মালয়েশিয়ার টুইন টাওয়ারের আদলে তৈরি মণ্ডপ। জানা যাচ্ছে, গত তিন মাস ধরে প্রতিদিন ৬০ জন শ্রমিক ও শিল্পী মিলে তৈরি করছে টুইন টাওয়ারের আদলে পুজো মণ্ডপ। প্রায় ১২ হাজারেরও বেশি বাঁশের তৈরি স্ট্রাকচারের উপর তৈরি হচ্ছে টুইন টাওয়ার। ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ, প্লাইউড, কাচ। কল্যাণীর এই টুইন টাওয়ার দর্শনের জন্য ইতিমধ্যেই শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে উন্মাদনা লক্ষ করা যাচ্ছে। গতবারের বুর্জ খলিফার মতো এই পুজোর মূল আকর্ষণ লেজার শো, যা দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে আসছেন মানুষ। উদ্যোক্তারা যতটা সম্ভব চেষ্টা করছেন, ভিড় নিয়ন্ত্রণ করে যে-কোনও রকম অপ্রীতিকর ঘটনা এগিয়ে যাওয়ার।

এই উদাহরণগুলি ছাড়াও মাঝেমধ্যেই বড় বড় পুজোগুলিতে বিপর্যয়ের খবর আসে। কখনও কেউ পদপিষ্ট হচ্ছেন তো কখনও আবার কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। পুজো কমিটি এবং উদ্যোক্তারা যতই চেষ্টা করুন না কেন, সর্বোপরি মানুষকে সচেতন হতে হবে এরকম ঘটনা এড়ানোর জন্য। নিজের ও আশপাশের মানুষের খেয়াল রাখতে হবে ঠাকুর দেখার সময়। পুলিশ এবং সব পুজো কমিটিগুলি যথাসাধ্য চেষ্টা করছে বড় বড় পুজোগুলিতে, যেখানে মানুষের ঢল নামে, সেখানে অপ্রীতিকর ঘটনা আটকানোর। এহেন পরিস্থিতিতে আমরা যদি সচেতনতা অবলম্বন না করি, তাহলে সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে পুজো উপভোগ করা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

More Articles