হাতে লং উইকেন্ড, শহর থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে পুরুলিয়ায় কাটুক এবারের দোল
Holi 2024 Long Weekend: সত্যিই সে দেশ লাল পলাশের। রাতের ট্রেন সকালের জবাকুসুম আলো মেখে যে-ই না আদ্রা স্টেশন পেরোবে, দেখতে পাবেন সেই লালের হাতছানি।
বসন্ত মানেই প্রকৃতির সেজে ওঠা নানা সাজে। আর কিছুদিন পরেই দোল। নানা রঙে সেজে উঠবেন আপনিও। তবে যদি শুধুই আবির-বাদুড়ে রঙে না সেজে প্রকৃতির রঙে রং মেলাতে চান, তাহলে কিন্তু দারুণ সুযোগ। এবার দোল এসেছে লং একটা উইকেন্ড নিয়ে। শনি-রবির পর সোমবার দোল, মঙ্গলে হোলি। ফলে দিব্যি মিলে যেতে পারে দিন চারেকের একটা ফুরসৎ। আর এই ফুরসতে কিন্তু হারিয়ে যেতেই পারেন লাল পলাশের দেশে।
সে দেশ আক্ষরিক অর্থেই লাল পলাশের। রাতের ট্রেন সকালের জবাকুসুম আলো মেখে যে-ই না আদ্রা স্টেশন পেরোবে, দেখতে পাবেন সেই লালের হাতছানি। কলকাতা থেকে হাওড়া স্টেশন হয়ে ট্রেনে পুরুলিয়া পৌঁছে যেতে পারেন খুব সহজেই। তার পরে অবশ্য অযোধ্যা পাহাড়ে পৌঁছতে নিতে হবে চারচাকা গাড়ি। কলকাতা থেকে বাসেও অযোধ্যা পাহাড় পৌঁছে যেতে পারেন। গাড়ি চালানোর নেশা থাকলে লং ড্রাইভের গন্তব্যও হতে পারে কিন্তু এই স্বপ্ন রাজ্য।
এ রাজ্যের দ্বিতীয় পাহাড়ি শহর পুরুলিয়া। অথচ পাহাড় বললেই আমরা যেমনটা কল্পনা করি, এ পাহাড় তার চেয়ে আলাদা। অযোধ্যা পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু শৃঙ্গ গোরগাবুরু। পুরুলিয়া যেন প্রাকৃতিক বৈভবে ঠাসা। তার উপর রয়েছে তার ঐতিহাসিক সম্পদ। তবে এই বসন্তে সেই সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে যায় পলাশের আগুন জ্বালা রং। যে দিকে তাকাবেন, যেন কেউ আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। অথচ এ আগুন জ্বালায় না, পোড়ায় না। বরং হৃদয়কে রাঙিয়ে দেয় এক আশ্চর্য রঙে।
আরও পড়ুন: ভারতের চেয়ে বেশি বাঁদুরে রঙ খেলেন বিদেশিরা! বিশ্বের দোল উৎসবে ঠিক কী ঘটে?
পুরুলিয়া জুড়েই প্রচুর বেড়ানোর জায়গা। তবে সেসবের রানি অযোধ্যা পাহাড়। বাকি জায়গাগুলির চেয়ে এই অংশটুকু যেন একটু আলাদা। খয়রাবেড়া বাঁধ, মার্বেল লেক, টুর্গা লেক, পাখি পাহাড়, ময়ূর পাহাড়, পার্দি লেক, বামনি প্রপাত, জয়চণ্ডী পাহাড়। ঘুরতে চাইলে ভ্রমণের জায়গার অভাব নেই এই চত্বরে। রয়েছে বিখ্যাত ছৌ-মুখোশের গ্রাম চড়িদা। গ্রামে পা দিয়েই দেখবেন, অজস্র মুখ আর মুখোশ ছড়িয়ে রয়েছে আনাচে-কানাচে। বাংলার নিজস্ব শিল্প, নিজস্ব এক নৃত্যভঙ্গি এই ছৌ। যাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন এঁরাই। শ'দেড়েক ছৌ–শিল্পী পরিবার বাস করে; তৈরি করে মুখোশ। কীভাবে কাগজের মণ্ড দিয়ে বুনে তোলা যায় একের পর এক দুর্দান্ত সব মুখোশ, তা চড়িদায় দিয়ে সচক্ষে না দেখলেই নয়। এখান থেকেই দেশ-বিদেশে পাড়ি দেয় সেই সব মুখোশ। শোভা পায় অভিজাত-ড্রয়িং রুমে।
পুরুলিয়া এক সময় পশ্চিমবঙ্গের অংশ ছিল না। তখন সে ছিল বিহারের মানভূম জেলার সদর মহাকুমা। পরে বাংলা ভাষার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বাংলার সঙ্গে যুক্ত হয় পুরুলিয়া। পুরুলিয়ার তিন দিক জুড়ে ঝাড়খণ্ড। সেই সীমারেখা এতটাই ক্ষীণ যে বোঝা কঠিন, এই মুহূর্তে আপনি বাংলায় আছেন না বিহারে। পুরুলিয়া একসময় লাক্ষা, গালা ও তসর শিল্পের জন্য বেশ বিখ্যাত ছিল। আজও সেখানকার গালা ও চুড়িশিল্পের বেশ নাম ডাক রয়েছে।
যে রামজন্মভূমি নিয়ে দেশের এত মাথাব্যথা, সেই অযোধ্যা তো উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত। কিন্তু এই অযোধ্যা পাহাড়কেও কিন্তু রামায়নের ইতিহাস বিজড়িত বলে মনে করেন স্থানীয় মানুষ। মনে করা হয়, চোদ্দো বছর বনবাসের সময়ে এই অযোধ্যা পাহাড়েই থাকতে এসেছিলেন দশরথপুত্র। এই পাহাড়ে বেশ কিছুদিন ছিলেন রাম-লক্ষ্মণ ও সীতা। অবশ্য ভৌগোলিক ভাবেও তা এমন কিছু অসম্ভব নয়। ময়ূর পাহাড়ে ইতিমধ্যেই তৈরি হয়েছে রামের একটি মন্দির। চরাচর জুড়ে শূন্যতা মোড়া অবসন্ন বিকেলে সেই ময়ূর পাহাড়ের সূর্যাস্ত কিছু কম আকর্ষণীয় নয়। তৃষ্ণার্ত সীতার জন্য তির মেরে মাটির নিচের জলের উৎস বের করে এনেছিলেন রামচন্দ্র। সেই সীতাকুন্ড রয়েছে কাছেই। পর্যটকদের কাছে সেটাও এক দর্শনস্থল। এখানকার তুন্দ্র সম্প্রদায়ের মানুষ এখনও বনে শিকারে যাওয়ার সময় সীতাকুণ্ডের জল পান করে যান। পুজো দেওয়ার চল রয়েছে রামমন্দিরেও।
অযোধ্যা পাহাড়েই রয়েছে ৪০ ফুট গভীর এক কৃত্রিম জলাশয়। যার নাম দুর্গাবেড়া। রয়েছে মুরুগুমা বাঁধ।পুরুলিয়া শহর থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরের কংসাবতী নদীর জল আটকিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি করা হয়েছে এই বাঁধ। আরও কিছুটা দূরে খয়রাবেড়া বাঁধ। পুরুলিয়া শহর থেকে ৭০ কিলোমিটার দূরে বাঘমুন্ডির অযোধ্যা পাহাড় এলাকায় সেচকাজের জন্যই মূলত তৈরি করা হয়েছিল এই বাঁধটি। মুরুগুমায় সুইসাইড পয়েন্ট বলে একটি জায়গা রয়েছে। সেখানে কে কবে আত্মহনন করেছিল জানা নেই। তবে কোনও বিকেলে সেখানে পৌঁছলে গা ছমছম করে উঠবেই। ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দেবেন খানিক দূরে। বাকি পথ হণ্টন। নিজের পায়ের শব্দ কানে এসে বিঁধবে নিজেরই। পাহাড়ের উপর থেকে বেঁধে দেওয়া ওই নদীর জল অনির্বচনীয় ঠেকবেই।
পাহাড়ের গা ঘেঁষে রয়েছে লহড়িয়া শিবমন্দির। তবে পুরুলিয়ার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ সম্ভবত মার্বেল লেক। পাহাড়ের গা কেটে কেটে তৈরি হওয়া ওই লেক আজ সিনেমার শুটিংয়ের জন্য বিখ্যাত। পাহাড় থাকলে প্রপাত না থাকলে কি হয়! রয়েছে টুর্গা লেক ও বামনি ফলস। পাহাড় বেয়ে দাপিয়ে নামছে উশৃঙ্খল জলরাশি। সেই বামনি প্রপাত অবধি পৌঁছতে অবশ্য বেশ খানিকটা পথ ট্রেক করে নামতে হয়। সেটাও কিন্তু একটা দুর্দান্ত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এছাড়াও বেশ কয়েকটি ছোটখাটো প্রপাত রয়েছে আশপাশে।
গুপি গাইন বাঘা বাইনে সেই হাল্লা রাজার সেনার যুদ্ধের কথা ভোলেননি নিশ্চয়ই। সেই ছবির অনেকটা শুটিংই কিন্তু হয়েছিল পুরুলিয়ার জয়চণ্ডী পাহাড়ে। ট্রেক করে চাইলে উঠতে পারেন পাহাড়ের মাথায়, সেখানে একটা মন্দির তো রয়েইছে। তার সঙ্গে রয়েছে গোটা এলাকার একটা বার্ডস আই ভিউ। ধীরেসুস্থে চলে যাচ্ছে দীর্ঘ ট্রেন, দেখতে পাবেন পাহাড়চুড়ো থেকে। হাতে সময় থাকলে সেখান থেকে ঘুরে আসতে পারে বড়ন্তি থেকেও।
আরও পড়ুন: কোথাও ন্যাড়া পোড়া, কোথাও হোলিকা দহন, বিজ্ঞান নাকি মিথ? কোন সত্যি লুকিয়ে আছে এই প্রথায়?
পুরুলিয়ার ময়ূর পাহাড়ের কথা তো আগেই বলেছি। আগে অসংখ্য ময়ূরের রাজত্ব ছিল এই তল্লাটে। তবে সেই দিন আর নেই। পার্দি লেকে জল খেতে আসত পশুর দল। এই অযোধ্যা পাহাড়েই রয়েছে পাখি পাহাড়। গোটা পাহাড়ে আঁকা রয়েছে অসংখ্য পাখি পাহাড়। অযোধ্যার লোয়ার ড্যামের থেকেও আপার ড্যাম মন কাড়বে পর্যটকদের। তবে এ সব কিছুর সঙ্গেই এই সময়ে আপনার সঙ্গী হবে মাইলের পর মাইল জুড়ে পলাশের বন। সারা শরীর থেকে আগুনে লাল ঝরিয়ে স্বাগত জানাবে আপনাকে। দোল উপলক্ষে এখন পুরুলিয়ায় আয়োজন করা হয় পলাশ পরবের। চাইলে সেই অভিজ্ঞতারও সাক্ষী হতে পারেন। তবে তার জন্য চটপট টিকিট কেটে উঠে পড়তে হবে চক্রধরপুর এক্সপ্রেস বা অন্য কোনও পুরুলিয়াগামী ট্রেনে। থাকার জায়গার অভাব নেই এখন পুরুলিয়ায়। রয়েছে বিলাসবহুল রিসর্ট। চাইলে থাকতে পারেন সরকারি গেস্ট হাউজ নিহারিকাতেও।
দোল মানেই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে উৎসবের আমেজ। সকলের সঙ্গে মেতে ওঠা আবির-ফাগ কিংবা ভূতুড়ে রঙে। দোল মানেই শান্তিনিকেতন শুনে শুনে যারা ক্লান্ত, তারা কিন্তু ঘুরে আসতেই পারেন এই পলাশ উপত্যাকা থেকে।