ফুলের ঘা থেকে লাঠির মার! জানেন এইসব ছক ভাঙা হোলির কিসসা?
Holi 2024: বসন্তে নানা ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। সেই সমস্ত ফুল আর রং দিয়েই এখানে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে ফুলের হোলি। হোলির আগের রাতে হোলিকা দহন করার চল রয়েছে এখানে।
বসন্ত, রঙের উৎসব। প্রকৃতিও এসময় সেজে ওঠে নতুন সাজে। দেশের অন্যতম উজ্জ্বল এবং রঙিন উৎসব বোধহয় এই দোল বা হোলি। যা প্রায় দেশের সব জায়গাতে একই সময় একই সমারোহে পালিত হয়। জীর্ণ, পুরনো যা কিছু তার উপর থেকে মলিনতার পর্দাটুকু তুলে যা কিছু ভালো, যা কিছু শুভ, তার আবাহনে মেতে ওঠেন মানুষ। এই দোলের সঙ্গে মিশে রয়েছে একেক অঞ্চলের একেক রকম ঐতিহ্য, পরম্পরা। আদতে রঙের উৎসব হলেও সেই সব আঞ্চলিকতা নিয়েই এই রঙের উৎসব হয়ে ওঠে রঙিন, বৈচিত্র্যময়। কোথাও এই রঙের উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে থাকে রাধাকৃষ্ণের পুজো, তো কোথাও অন্য কোনও সংস্কার, অন্য কোনও উপাচারে পালিত হয় রঙিন এই উৎসব। ফলে এই দেশেরই বিভিন্ন এলাকায় আয়োজন করা হয় বিভিন্ন রকম হোলির। সাধারণ ভাবে হোলি মানেই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে রংখেলায় মেতে ওঠা। ফাগ-আবির থেকে শুরু করে বাদুড়ে রঙের ভুতুড়ে সাজ, কী নেই সেখানে। সকাল থেকেই বালতি বালতি রং গুলে পিচকিরি নিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়া খুদেদের।
কিন্তু দেশের সর্বোত্র কিন্তু হোলির একই রম আমেজ নয়। যদি সেই সব অন্যরকম রঙের উৎসবের হদিস পেতে চান, তাহলে কোথায় যাবেন? এ দেশের আনাচে-কানাচে অঞ্চলভেদে পাল্টে পাল্টে যায় এই উৎসবের রীতিনীতি। যা শুনলে বা দেখলে চমকে যেতে পারেন আপনি। হোলির সেই অনোন্য স্বাদ পেতে কোথায় যাবেন, রইল সুলুক সন্ধান।
আরও পড়ুন: হাতে লং উইকেন্ড, শহর থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে পুরুলিয়ায় কাটুক এবারের দোল
মথুরা, উত্তরপ্রদেশ
উত্তরপ্রদেশের মথুরা। রাধাকৃষ্ণের অনুসঙ্গ অন্যরকম ভাবেই মিশে রয়েছে এই এলাকার সঙ্গে। এখানকার হোলির আমেজও কিন্তু একেবারেই আলাদা। মথুরার বারসানা এলাকা বিখ্যাত লাঠমার হোলির জন্য। এ সময়টায় এখানকার পুরুষরা হয়ে ওঠেন গোপ, আর নারীরা সেজে ওঠেন গোপিনী। রং খেলা তো হয়ই, তার সঙ্গে থাকে একেবারে অন্যরকম এক খেলা। মনে করা হয়, এই লাঠমার হোলি মথুরায় শুরু হয়েছিল দ্বাপর যুগে। হোলির ঠিক এক সপ্তাহ আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় লাঠমার হোলি। সেই মতো ১৮ মার্চ থেকেই এ বছর শুরু হয়ে গিয়েছে উৎসব। ১৮ তারিখ বারসানায় লাঠমার হোলির শুরু, এবং তার পরের দিন থেকে নন্দগাঁওয়ে লাঠমার হোলি খেলা হবে। ব্রজে হোলির সঙ্গে মিশে রয়েছে রাধা-কৃষ্ণ প্রেম। পূরাণ ও বিশ্বাস বলে, নন্দগাঁও থেকে নাকি কৃষ্ণ ও তাঁর বন্ধুরা রাধারানির গ্রাম বারসানায় যেতেন ও গোপিনীদের নানাভাবে উত্যক্ত করতেন। আর সেই কাজকর্মে রেগে গিয়ে লাঠি নিয়ে কৃষ্ণ ও তাঁর বন্ধুদের প্রহার করতেন রাধা ও তাঁর সখীরা। সেখান থেকেই বারসানায় হোলিতে এই প্রথা চলে আসছে। বারসানার প্রধান শিরজি মন্দিরে খেলা হয় লাঠমার হোলি। আর লাঠমার হোলির ঠিক একদিন আগেই পালিত হয় লাড্ডু হোলি। বারসানার মন্দিরের মূল অধিষ্ঠাতা দেবতা শ্রীকৃষ্ণকে হোলি খেলার জন্য আমন্ত্রণ পত্র পাঠানো হয়। ফাল্গুন মাসের শুক্লপক্ষের নবমী তিথিতে পালিত হয় লাড্ডু হোলি। লাঠমার হোলিতে রাধা-কৃষ্ণের সেই প্রথা মেনেই এলাকার মহিলারা লাঠি নিয়ে চড়াও হন পুরুষদের উপরে। তাঁরা ঢাল নিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। এটাই খেলা। তবে শুধু লাড্ডু বা লাঠি নয়, আবির এবং রঙখেলাও হয় মথুরা ও বৃন্দাবন জুড়ে। প্রায় সপ্তাহখানের ধরে চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। দেশ-বিদেশ থেকে এই লাঠমার হোলি প্রত্যক্ষ করতে এ সময় ভিড় জমান পর্যটকেরা।
বৃন্দাবন, উত্তরপ্রদেশ
মথুরার মতোই কৃষ্ণের অনুসঙ্গে ভরপুর বৃন্দাবনও। সেখানকার বাঁকে বিহারী মন্দিরে চল ফুলের হোলি খেলার। বসন্তে নানা ফুলে সেজে ওঠে প্রকৃতি। সেই সমস্ত ফুল আর রং দিয়েই এখানে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে চলতে থাকে ফুলের হোলি। হোলির আগের রাতে হোলিকা দহন করার চল রয়েছে। হোলির আগের দিন বিকেল চারটে নাগাদ খুলে দেওয়া হয় মন্দিরের ফটক। পুরোহিতেরা ভক্তদের দিকে ফুল ছুড়ে খেলার উদ্বোঘন করে দেন। হোলি আর রঙের মায়াবি সাজে তখন শহরটাকে চেনা দুষ্কর। শুধু দেশেই নয়, বিদেশ থেকেও অনেকেই আসেন এই হোলির পরম্পরা সচক্ষে দেখতে। প্রায় একসপ্তাহ ধরে চলে এই উৎসব।
শান্তিনিকেতন, বাংলা
একসময় দোলের শান্তিনিকেতনের ছবিটাই ছিল একেবারে আলাদা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় থেকেই শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গনে বসন্তোৎসব পালনের শুরু। নাচ, গান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে উঠতেন কলাভবনের ছাত্রছাত্রীরা। আবির এবং ফাগ মেখে চলত প্রভাতফেরি। তবে শান্তিনিকেতনের সেই বসন্তোৎসবের আমেজ বিগত কয়েক বছরে অনেকটাই স্তিমিত। তবে এই বসন্তে শান্তিনিকেতনের প্রকৃতির আবেদনও কিছু কম নয়। পলাশ, শিমুলে ছাওয়া রাঙামাটির পথে আবির খেলায় মেতে উঠতেই এই সময়টায় শান্তিনিকেতনমুখী হন বহু পর্যটক।
আনন্দপুর সাহেব, পঞ্জাব
পঞ্জাবের শিখ সম্প্রদায় এ সময়টায় পালন করে থাকেন হোলা মহল্লা। ক্যালেন্ডারে হোলির পরে পরেই থাকে এই উৎসব। ফলে বহু সময়েই দুটি উৎসব কীভাবে যেন মিলেমিশে যায়। হোলা মহল্লা আসলে এক ধরনের মার্শাল আর্ট। এই উৎসব উপলক্ষে এই মার্শাল আর্টের প্রদর্শন হয়, এবং এলাকায় বিশাল মেলা বসে। পাঞ্জাবের মহান গুরু গোবিন্দ সিং শিখদের সামরিক অনুশীলনের জন্য হোলা মহল্লা মেলা শুরু করেছিলেন। তিন দিনের এই উৎসবে নকল যুদ্ধও অনুষ্ঠিত হয়। শিখ সম্প্রদায় গুরুদ্বারে নিশান সাহেবদের নেতৃত্বে এই মার্শাল আর্ট প্যারেড অনুষ্ঠান দেখে এবং তাতে অংশও নেয়। আর এই মেলা দেখতে ভিড় জমান হোলিতে বহু পর্যটক।
উদয়পুর, রাজস্থান
হোলিকা দহন দিয়ে শুরু হয় রাজস্থানের উদয়পুরের হোলির উৎসব। বৃন্দাবন বা মথুরার থেকে কোনও অংশে কম জাঁকজমকপূর্ণ নয় এখানকার অনুষ্ঠান। আতশবাজির প্রদর্শনী থেকে শুরু করে রঙখেলা, সবটাই এক অন্য়রকম অভিজ্ঞতা এই উদয়পুরে। বেশ কিছু স্থানীয় মিষ্টি দিয়ে হোলি পালন করা হয় উদয়পুরে। আর ঠান্ডাই তো রয়েইছে সঙ্গে। ভাং খাওয়ারও চল রয়েছে এখানে। উদয়পুর এমনই এক শহর, যেখানে প্রতিটি রিসর্ট এবং হোটেলেও পর্যটকদের জন্য আলাদা করে হোলি খেলার ব্যবস্থা করা হয়।
বারাণসী, উত্তরপ্রদেশ
এমনি ফুল এবং আবিরের হোলি তো রয়েইছে। তার পাশাপাশি বারাণসীর মণিকর্ণিকা ঘাটে পালিত হয় মাসান-হোলি। না, ফুল বা ফাগ নয়, শ্মশানের ভস্ম মেখেই হোলি খেলার চল। সাধারণ ভাবে রঙ্গভরী একাদশীর দিন খেলা হয় এই হোলি। শ্মশানচারী শিবের অন্যতম প্রিয় বস্তু এই ছাই। কথিত রয়েছে, রঙ্গভরী একাদশীর দুই দিন পরে ভোলানাথ মনিকর্ণিকা ঘাটে নন্দীভৃঙ্গীসমেত তাঁর গণ অর্থাৎ অনুচরদের নিয়ে হাজির হন। সেখানে ভক্তদের ডাকে সারা দেন মহাদেব। তাদের আশীর্বাদ করে তাদের সঙ্গে হোলি খেলায় মেতে ওঠেন ত্রিলোকেশ্বর। সেই খেলাতেই ছাইয়ের ব্যবহার হয়েছিল। আর সেই থেকেই ছাই দিয়ে এই খেলার রীতি রয়েছে। আবার অন্য একটি সূত্র মতে, বিবাহের আগে শিব-পার্বতী দেবদেবীদের সঙ্গে হোলি খেলেছিলেন। রঙ্গভরী একাদশীর দিনই সেই খেলা হয়। কিন্তু সেই খেলায় উপস্থিত ছিলেন না মহাদেবের অনুচর অর্থাৎ ভূত প্রেতাত্মারা। তাই এর পর দিন তিনি মনিকর্ণিকা ঘাটে চলে আসেন। সেখানে হোলি খেলেন। সেই থেকেই হোলিটির নাম মশান হোলি। ইদানীং সেই ছকভাঙা হোলি দেখতেও বিভিন্ন জায়গা থেকে ছুটে আসেন বহু পর্যটক।
আরও পড়ুন: ভারতের চেয়ে বেশি বাঁদুরে রঙ খেলেন বিদেশিরা! বিশ্বের দোল উৎসবে ঠিক কী ঘটে?
অন্যরকম হোলি, অন্য রকম রঙের উৎসবের স্বাদ পেতে, এ দেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিকে উপভোগ করতে কিন্তু দোল বা হোলি উপলক্ষে ঘুরে দেখাই যেতে পারে এইসব হোলির শহরগুলি। যেখানে নিজস্ব সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে রয়েছে অন্য রকম লোকাচার। আসলে সব হোলি বা দোলেরই আসল কথা, সমস্ত অশুভের উপর দিয়ে শুভের জয়। আর সেই জয়কেই রঙে, ফুলে কোথাও আবার ছাই দিয়ে আবাহন জানানো হয় এই বসন্তের উৎসবে।