রোগীর ছুটি, নার্সের নয়! দিবারাত্র সেবার বদলে পুজোয় মেলে সামান্যতম নিরাপত্তা?

Durgapujo of Nurse: পুজোর রোস্টার আসতেই শুরু হয়ে যায় ছুটির দরখাস্তের পালা। কিন্তু যতই নিখুঁত করে চিঠি লেখা হোক না কেন হাসপাতালে বাতিল হয়ে আসে সেসব।

‘তোমাদের পুজো আমাদের নয়’। সত্যিই তো পুজো বলে তো আর পাঁচটা দিনের থেকে আলাদা নয় নার্সদের জীবন। বরং উৎসবের সন্ধ্যায় ঝকঝকে পাটভাঙা নতুন জামার বদলে গায়ে গলিয়ে নিতে হয় অনুজ্জ্বল পুরনো সাদা পোশাক। উৎসবের আমেজেও দুই হাত শুশ্রুষা দেয় মুমূর্ষু কোনও রোগীকে। পুজো আসে পুজো যায় কিন্তু এই ছবি বদলাতে দেখা যায় না। টেবিলে বসে বসে ছোটবেলার একগুচ্ছ স্মৃতি ভেসে আসে তখন। মনে পড়ে স্কুলছুটি, পুজোর ভিড়ে শহরের এক মণ্ডপ থেকে অন্য মণ্ডপে প্রতিমা দর্শনের স্মৃতি, কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে দেদার আড্ডা, খাওয়া দাওয়া। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে হাত ওঠে স্যালাইনের বোতল বদলে দিতে। এভাবেই কাটে নার্সদের দুর্গাপুজোর রাতগুলো।

করোনা অতিমারির চোখরাঙানি কমতেই বাঙালি পুরনো ছন্দে ফের একবার গা ভাসিয়েছে দুর্গাপুজোর আনন্দে। উৎসবের আনন্দ দ্বিগুণ করেছে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি। অন্যদিকে হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস বলছে পুজোর দিনগুলিতে বৃষ্টিতে ভাসবে কলকাতা। তাই আর ঘরে বসে অপেক্ষা করেনি বাঙালি। মহালয়ার দিন থেকেই বেরিয়ে পড়েছে প্রতিমা দর্শনে। তবে করোনা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ছুটি নেই নার্সদের। দিন রাত ডিউটি করে মানুষের সেবায় নিয়োজিত তাঁরা। পুজোর দিনগুলিতে যখন দেশ বিদেশের মানুষ ঘরে ফিরে আসে, পরিবার পরিজনদের সঙ্গে সময় কাটান তখন তাঁদের কাজে যোগ দিতে হয়। চিকিৎসা পরিষেবা স্বাভাবিক রাখতে ও মানুষকে যথাযোগ্য সেবা দিতে প্রস্তুত হন তাঁরা। কিন্তু পুজোর আনন্দ? পুজোর রোস্টার আসতেই শুরু হয়ে যায় ছুটির দরখাস্তের পালা। কিন্তু যতই নিখুঁত করে চিঠি লেখা হোক না কেন হাসপাতালে বাতিল হয়ে আসে সেসব। সুবিধামতো সহকর্মীদের সঙ্গে চলে ডিউটি ভাগ করে নেওয়ার কাজ। মান অভিমান, দিনরাতের খাটুনি এভাবেই চলতে থাকে দুর্গাপুজোর দিনগুলি। এ প্রসঙ্গে অশোকনগর স্টেট জেনারেল হাসপাতালের নার্স শ্বেতা কর জানালেন, “৬ ঘণ্টা, ৬ঘণ্টা মোট ১২ ঘণ্টার শিফটিং ডিউটি করতেই হয়। তবে আমাদের হাসপাতালে একটা ভালো ব্যাপার হল অন্য ধর্মের মানুষরা এক্ষেত্রে আমাদের সাহায্য করে। সহকর্মীদের অনেকে মুসলিম, খ্রিস্টান হওয়ায় তাঁরা নাইট ডিউটিগুলি করে দেন।” সকলেই দুর্গাপুজোয় নিজেদের মতো করে এগিয়ে আসেন সহকর্মীকে সাহায্য করতে।

কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত হাসপাতাল নীল রতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল। হাসপাতালের অন্যতম ব্যস্ত ডিপার্টমেন্ট পুরুষদের সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে কর্মরত নার্স তিয়াষা কুণ্ডুর অবশ্য সে সুযোগ নেই। যখন গোটা কলকাতার মানুষ সারা রাত প্রতিমা দর্শনের আনন্দে মজে উঠবে তখন ষষ্ঠী, সপ্তমী ও অষ্টমীর রাত কাটবে হাসপাতালে। ছুটি বলতে নবমী আর দশমী। তাতেই মন ভরে যথাসম্ভব আনন্দ করবেন তিনি। কলকাতা কর্পোরেশনের ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডের হেলথ সেন্টারে কর্মরত লিপিকা দে-র গলাতেও শোনা একই কথা। তাঁর কথায়, “পুজোর দিনগুলিতেও আউটডোর, আরটিপিসিআর সবই খোলা থাকে মানুষের জন্য। সকাল আটটা থেকে চারটে কাজ করে তারপর ঠাকুর দেখতে বেরোই পরিবারের সঙ্গে।” পার্ক সার্কাসের জেফার হাসপাতালে এক কর্মরত নার্সের কথায়, “পুজোতে কেউ কোনও ছুটি পায় না। নিজেদের মধ্যে ঠিক করে কাজ করতেই হবে। এবছর নবমীতে ২৪ ঘণ্টা ডিউটি রয়েছে।” তবে সাগরদিঘি হাসপাতালের ইনচার্জ নার্স মধুরিমা রায়চৌধুরীর জন্য এ বছর পুজো খানিকটা আলাদা। পুজোর ছুটি পেয়েছেন পুরোটা। তাই প্রথম থেকে শেষ দিন অবধি কাটাবেন পরিবারের সঙ্গে। তাঁর কথায়, “কোনও বছর এমন টানা ছুটি পাই না। এবার পুজোর আলাদা করে কোনও প্ল্যান নেই, যতটা সম্ভব বাড়িতে সময় কাটাব। ছেলে এবং স্বামীর সঙ্গে অবশ্যই সন্ধ্যেবেলা ঠাকুর দেখতে বেরোব।”

আরও পড়ুন- আফ্রিকায় বোধন দেবী দুর্গার! কীভাবে সম্ভব হলো?

পুজো বলে তো আর হাসপাতাল বন্ধ দেওয়া যায় না বরং কাজের চাপ দ্বিগুণ হয়ে যায়। পুজোর দিনগুলিতে বেশিরভাগ হাসপাতালেই পর্যাপ্ত চিকিৎসক থাকেন না। জুনিয়র ডাক্তার দিয়েই বেশিরভাগ কাজ সামলে নিতে নয়। এমনকি প্রাইভেট নার্সিংহোম এবং হাসপাতালের আউটডোর পরিষেবা বন্ধ থাকে ফলে সরকারি হাসপাতালগুলিতে রোগীর চাপ অনেক বেড়ে যায়। তাই পরিবার পরিজন অপেক্ষা করে থাকলেও নার্সদের হাত পা এক প্রকার বাঁধা। অশোকনগর হাসপাতালের নার্স শ্বেতার কথায়, “এই সময় রাতের দিক করে রোগী আসতেই থাকে। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই সময় দুর্ঘটনা ঘটে। তাই নাইট ডিউটিই বেশি করে দেওয়া হয়। পুজোর দিনগুলি আলাদা কিছু নয়। নতুন জামা পরে কাজে যাই। গিয়ে সাদা পোশাক পরে নিই। ব্যাস! এভাবেই মানিয়ে নিয়েছি। এবছর শহরে যে হারে ডেঙ্গু বাড়ছে তাতে আলাদা করে পুজোর যে আনন্দ সেটা খুব অনুভব করছি না।” এনআরএস হাসপাতালের তিয়াষা কুণ্ডুর কথায়, “রাতের দিক করে প্রচুর অ্যাক্সিডেন্ট কেস। তাঁদের অনেকরই অবস্থা বেশ ক্রিটিক্যাল। অনেকে ক্ষেত্রে রোগীকে আনতেও দেরী হয়ে যায়। তবু এসময় চেষ্টা করি রোগীকে আনার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানোর। বাকি চিকিৎসার জন্য ডাক্তারের অপেক্ষা করতেই হয়।”

তবে এসময় নার্সদের যথাযোগ্য নিরাপত্তা থাকে না। ফলে অনেকক্ষেত্রেই পান থেকে চুন খসলেই রোগীর পরিবার চড়াও হয় হাসপাতালে। মধুরিমা রায়চৌধুরীর কথায়, “পুজোর দিনগুলিতে কিন্তু নার্সিং স্টাফদের হাসপাতালে থাকতেই হয়। ডাক্তারের সংখ্যা কম থাকায় রোগী এবং রোগীর পরিজনদের আমাদেরকেই সামলাতে হয়। আর এমার্জেন্সি কেসের ক্ষেত্রে পুজোর সময় বাইরে পরিষেবা বন্ধ থাকায় সকলেই সরকারি হাসপাতালগুলিতে ছুটে আসেন। মন মতো পরিষেবা না পেলেই ঝামেলা শুরু করেন। আমরা এতদিন ধরে যে পরিষেবা দিচ্ছি তা তো করবোই কিন্তু এই সময় নিরাপত্তা পাইনা একেবারেই। যে পরিমাণ সিকিউরিটি গার্ড থাকে তা পুরো হাসপাতালকে সামাল দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। জেলার হাসপাতালে এই সমস্যা খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়। পুজোর সময় রোগীর আত্মীয়রা ঝামেলা করে এটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এখন আমাদের কাছে। পুজোর সময় কাজ করতে গিয়ে এই বড় একটা সমস্যার সম্মুখীন হই আমরা।”

আরও পড়ুন- বাগানের মাটিতে শিশুকন্যার অলীক পায়ের ছাপ! যেভাবে শুরু হল শিবপুরের রায়চৌধুরী বাড়ির পুজো

করোনা কালে যখন গোটা দুনিয়া কাঁপছে তখনও পরিবার থেকে দূরে সমানভাবে পরিষেবা দিয়েছেন তাঁরা। কলকাতার কর্পোরেশনের নার্স লিপিকা দে-র কথায়, “ভয় ছিল ঠিকই কিন্তু সেভাবেই কাজ করতে হয়েছে। কাজ সেরে বাড়ি ফিরে ভালো মতো স্নান করে তারপর পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছি। তাই ভয় পেলেও জানতাম কাজটা করতেই হবে। পিছিয়ে আসার জায়গা নেই।” তবে সকলেই মেনে নিয়েছেন, পুজোতে যে দিনগুলি ছুটি থাকবে তাতে চেটেপুটে পুজোর আনন্দ উপভোগ করে নিতেই হবে। অনেকেই সন্তানের মুখ চেয়ে বেরিয়ে পড়েন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। আবার তো এক বছরের অপেক্ষা শুরু বাঙালির। তবে পেশার তাগিদে যে পুজোর ছুটিতে অন্যদের মতো ঠাকুর দেখা যাবে না একথা সকলেই নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে শ্বেতা জানিয়েছেন, “ট্রেনিংয়ের সময় থেকেই নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছি এ কথা যে পুজোর ছুটি পাব না।” সবাই মেনে নিয়েছেন, এই কাজ করতে গেলে তো পুজো দেখলে চলবে না! আগে রোগী তারপর সবকিছু। তবে তিয়াষার কথায়, “আক্ষেপ খানিক লাঘব পায় রোগীদের সুস্থ দেখলে। তাঁদের প্রাণ বাঁচাতে পারলে তখন মনে হয় রাত জাগাগুলো সার্থক।”

এমন নিস্বার্থ ভাবে মানুষের প্রাণ বাঁচানোর কাজ যারা করছেন, হাসপাতাল, পরিবার সামাল দিয়ে ওঠা এই নার্সদের সমাজ দশভুজারই প্রতিরূপ করে তুলেছে। সর্বসম্মতভাবে রোগীদের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করা এই দশভুজাদের পুজোনামচায় তাই উৎসব নেই, কেবলই কর্তব্য।

More Articles