পথের কাঁটা চিনেই সিঙ্গুর অস্ত্রে শান মমতার

Mamata Banerjee: মমতা জানেন সিপিএম, বিজেপি কেউই নয়, তার পথের কাঁটা হলেও হতে পারে জনরোষ। যে জনরোষ একদা তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন জমিকে সামনে রেখে।

জনস্মৃতি অতি-ক্ষীণ। দেড় দশক আগের কথা কে আর মনে রাখবে! অতএব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, টাটাকে তিনি নন, সিপিএম তাড়িয়েছিল।

সেদিন যে ছিল উদ্ধত যুবা, ঝড়ঝাপটা সয়ে আজ সে মধ্যবয়স্ক, তরীটা তীরের দিকে নিয়ে যেতে চাইছে স্রেফ, রাগ তার পড়ে গেছে, জীবনটাকে সে মেনে নিয়েছে একপ্রকার, মানিয়ে নিয়েছে। আর সে ফোঁস করবে না। তাছাড়া প্রশ্ন করলেই তুমি হয়ে উঠতে পারো নগর-নকশাল। কে চায় ঝামেলা বাড়াতে, তার চেয়ে কনকলঙ্কা ডুবছে ডুবুক। নেতার যা ইচ্ছে বলুক। আপনি বাঁচলে পরের নাম! এই সুযোগেই নেতানেত্রীরা গল্পের গরু গাছে তোলেন। যেমন খুশি তেমন বলেন। ইতিহাস বিকৃত হয়, মানুষ বিভ্রান্ত হয় আকছার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে অন্যতম। রাজনীতিতে আসতে, মন্ত্রী হতে, জয়েন্ট এন্ট্রান্স দিতে হয় না, আসতে পারেন যে কেউ। আর বলতে পারেন যা খুশি তাই। এই স্বেচ্ছাচারের কোনও ঊর্ধ্বমাত্রা নেই। এই যে মিথ্যে কথা, আগলখোলা আজগুবি কথার পৃথিবী, একেই পোস্ট ট্রুথ বা উত্তর-সত্যর বিশ্ব বলে। এই বিশ্বের লাগাম রাজনৈতিক নেতাদের হাতেই। ডোনাল্ড ট্রাম্প, নরেন্দ্র মোদি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- সবাই একই পথের পথিক।

উত্তর-সত্য সত্যর চেয়ে বেশি দামি। অনেকটা ফেক নিউজের মতোই তার গতি। দীপাবলির রাতের রকেটের মতো ছড়িয়ে পড়ে স্থানীয় আকাশে। ফলে মমতার এই টাটা উবাচ নিয়ে বাজার গরম। কে সি নাগের অঙ্কের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে বিষয়টা। এ ১৬ বছর আগে বন্ধু বি-এর সাহায্যে একটি কাজ করতে চেয়েছিল। সি সেই কাজে বাধা দেয়, লোক খ‍্যাপায়। এ কাজ বন্ধ করে জানিয়ে দেয় সি-এর জন্য কাজ হলো না। বি-ও বলতে থাকে সি-এর জন্য কাজ হলো না। ১৬ বছর পর সি বলছে কাজ হল না বি-এর জন্য। আসলে কাজ হলো না কার জন্য? এই ধাঁধার উত্তর লুকিয়ে আছে সময়ের গর্ভে, মানে এই ১৬ বছরে। অঙ্ক কষতে হবে এই সংখ্যাটাকে সামনে রেখেই।

এরই মধ্যে বামেদের শূন্য করে দিয়ে তিনবার ভোটে জিতেছেন মমতা। কেউ বলতেই পারেন, তিন মরশুম ক্ষমতার ভার বইতে পারা সহজ নয়। গদির সঙ্গে মমতার বোঝাপড়া ১৬ বছরে এতই অটুট হয়েছে যে, তিনি ভেবেছেন সত্যর থেকেও বড় তিনি, তাঁর উত্তর-সত্য। ফলে তিনি নিজের মতো করে একটি মনগড়া কথা বললেন। ঠিক যেমনটা বলেন নরেন্দ্র মোদি, একদা তাঁর একটি বক্তব্যে শুনেছিলাম, স্বামী বিবেকানন্দ জামশেদজি টাটাকে অনুরোধ করছেন, ভারতে মেক ইন ইন্ডিয়া করার জন্য। অথচ স্বামীজির জন্মের কয়েক বছরের মধ্যেই টাটার হাতে এই ব্যবসার গোড়াপত্তন। আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে বিকৃত তথ্য পেশ করা কঠিন কাজ, মমতা-মোদিরা পারেন। নিরঙ্কুশ ক্ষমতা, স্তাবক-পারিষদদের সৌজন্যবাচক মৌনতার সুযোগে গান্ধীর অনশন ভঙ্গ করেন মৃত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু মমতা কি স্রেফ বলার জন্যই একথাটা বললেন?

আরও পড়ুন: আসল সুভাষকে ভুলিয়ে দিতেই স্ট্যাচু নির্মাণ, কর্তব্যপথ খুঁজে নিন নেতাজিপ্রেমীরাই

মমতা জানেন সিপিএম, বিজেপি কেউই নয়, তার পথের কাঁটা হলেও হতে পারে জনরোষ। যে জনরোষ একদা তিনি তৈরি করতে পেরেছিলেন জমিকে সামনে রেখে। পাড়ায় পাড়ায় দেওয়াল লেখা হয়েছিল, বুদ্ধ আসছে জমি কাড়তে। আজ সেই রোষের আগুনের উত্তাপ সামান্য হলেও টের পাওয়া যাচ্ছে কর্মসংস্থানকে কেন্দ্র করে। সারদা-নারদাও যে ভোটব্যাঙ্ককে ছুঁতে পারেনি, তাতে সর্পছিদ্র- কাজের অভাব, চাকরিপ্রার্থীদের অনশন, প্রশাসনিক দুর্নীতি। ঠিক এইখানেই, শান্ত হয়ে যাওয়া লোকগুলো বাসে-ট্রামে বলছে, বুদ্ধবাবু কিন্তু কাজের কথা বলেছিলেন, বলেছিলেন আমাদের রাজ্যের ছেলেদের বাইরে কাজ করতে যেতে হবে না। কিন্তু কাজ কই? 'শ্রী' দিয়ে আর কতকাল চলবে! একথা যেমন শহরাঞ্চলে হচ্ছে, তেমনই হচ্ছে গাঁ-গঞ্জে। অতএব একটি লাগসই কথা মমতাকে খুঁজতেই হতো। তাই তিনি টাটা বিদায় প্রসঙ্গে সিপিএম-এর ওপর দোষ চাপিয়ে দিলেন। তাঁর কথার নির্যাস এমনটাও হতে পারে যে, ভুল জমি বেছে এই নিয়তি ডেকে এনেছিল সিপিএম। কিন্তু সেক্ষেত্রেও মমতা হাত ধুয়ে ফেলতে পারবেন না। কারণ সিঙ্গুরের আজ পর্যন্ত কোনও সদগতিই করতে পারেননি তিনি। বালি, স্টোনচিপে ভরা জমিতে চাষ সম্ভব না। জমি পুনর্বন্টনও কার্যত অলীক স্বপ্ন। কোমর বরাবর উচ্চতার ঘাসজমিতে ভরা ব্যবহারের অযোগ্য জায়গা হয়ে পড়ে আছে একফালি স্বপ্নাঞ্চল।

এখানে নতুন প্রজন্মের স্বার্থে, উত্তর-সত্যকে রেয়াত না করার স্বার্থে বলে রাখা জরুরি, ২০০৬ সালের নির্বাচনে সিপিএম লড়াই-ই করেছিল শিল্পায়নে জোয়ারের প্রতিশ্রুতিতে। জয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই সিঙ্গুরে জমি অধিগ্রহণ শুরু করে সিপিএম। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পমন্ত্রী নিরূপম সেন সেই সময়ে তথ্য দিয়ে তুলে ধরেছিলেন বঙ্গদেশে ভূমিহীন কৃষক পশ্চিমবঙ্গে বাড়ছে, চাষযোগ্য জমি কমছে। শিল্পায়নের বার্তা দেওয়া হয় তখনই৷ ২৫ মে, ২০০৬, রাজ্য শিল্পোন্নয়ন নিগম এবং টাটা মোটরস জরিপের কাজে যান। কৃষিজমি রক্ষা কমিটি তৈরি হয় এই সময়েই। সিঙ্গুরের জমিতে মোটের ওপর সেসময় হেক্টর-প্রতি ধান উৎপাদন রাজ্যের গড় উৎপাদনের সমান ছিল। আলু উৎপাদনের ক্ষেত্রে পরিমাণ ছিল গড়ের চেয়েও বেশি। সিঙ্গুরে শিল্পায়ন প্রক্রিয়ায় ফাঁক ছিল একটাই। সিঙ্গুরের জমির মালিকরা বেশিরভাগই থাকতেন বাইরে। চাষ করতেন সিঙ্গুরের বাসিন্দা ভাগচাষিরা, বর্গাদাররা। এদের পরবর্তী প্রজন্ম অন্য শহরে কাজের খোঁজে গেলেও, আয় ছিল জমিনির্ভর। একদা পাট্টার প্রশ্নে এরা বামেদের ভোটব্যাঙ্ক হয়ে উঠলেও সিঙ্গুরে এরাই অস্তিত্বের সংকটে বামেদের বিরুদ্ধে যায়। মে-জুন থেকে আন্দোলন শুরু হয়। তক্কে তক্কে থাকার পর, অগাস্ট মাস থেকে ন্যাশানাল হাইওয়ে-র দখল নেন মমতা। আত্মপ্রত্যয়ী বুদ্ধদেব প্রথমে এই বিশৃঙ্খলাকে আমলই দেননি, প্রচার করতে থাকেন, মমতা উন্নয়নের গতি স্তব্ধ করছেন। অনেকে বলেন, বুদ্ধদেবের ভুল ছিল, তিনি সংগঠনকে কাজে লাগাননি। স্বয়ং জ্যোতি বসু প্রশ্ন তুলেছিলেন, সিঙ্গুরে কৃষক সভা নেই কেন। এদিকে এই সময়েই বিডিও অফিসে লাইট নিভিয়ে দেওয়ার ঘটনা মমতার পালে হাওয়া দেয়। বিনা বাধায় বিধানসভা ভাঙচুর হয় এই সময়। দেখা যায়, একটা সিপিএম-বিরোধী হাওয়া তৈরি হয়েছে। এই হাওয়াই নন্দীগ্রামে সালেম গোষ্ঠীর প্রকল্প-বিরোধিতায় নতুন ভরবেগ পায়। বিরোধিতার মধ্য দিয়ে উঠে আসেন মমতা।

উঠে তিনি এসেছেন। কিন্তু যাদের হাত ধরে এসেছেন, অনুদান বাদে তাদের কিছুই তিনি দিতে পারেননি। আজ তাই প্রশ্ন করছে গ্রহণে ক্লান্ত দ্বিধান্বিত সেই সমাজ। চাকরি কই? যোগ্য লোক কেন পথে বসে? এহেন অবস্থায় ইতিহাস গুলিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী বা করার আছে সেদিনের জননেত্রীর?

More Articles